আমাদের গৌরবময় অধ্যায়ের অংশ মুনীর ভাই

খন্দকার মুনীরুজ্জামানছবি সংগৃহীত

প্রায় পাঁচ দশক আগে জুলাই মাসের শুরুর দিকে যুদ্ধে যোগ দেওয়ার জন্য সীমান্ত পার হয়ে আগরতলার উদ্দেশ্যে যাওয়া আমাদের ছোট দলটিতে ছিলাম আমরা ছয়জন। থাকার কথা ছিল সাতজনের, তবে সপ্তম সদস্য বাড়ি থেকে বের হতে না পারায় ওকে ছাড়াই আমাদের যাত্রা করতে হয়েছিল। তার সেই না যাওয়ার কারণ অনেক পরে আমরা জানতে পারি। মা তার আদরের সন্তানের যুদ্ধে যোগ দেওয়ার মতলব আঁচ করতে পেরে ঘরে তালা–চাবি দিয়ে তাকে আটকে রাখেন। ফলে যুদ্ধে যোগ দেওয়া ওর পক্ষে আর সম্ভব হয়নি, আর এ নিয়ে তার আক্ষেপের শেষ ছিল না।

চারদিকে তখন বিপদের ঘ্রাণ। ফলে কোথাও যাত্রাবিরতির সুযোগ একেবারেই ছিল না এবং দলবদ্ধভাবেও আমরা ঢাকা থেকে রওনা হইনি। আমাদের বলা হয়েছিল দাউদকান্দি ফেরিঘাট পার হয়ে নির্দিষ্ট একটি স্থানে যেন আমরা মিলিত হই। দলে আমরা কতজন থাকছি, সেটাও আমাদের জানা ছিল না। একমাত্র দলনেতা জানতেন কে কে থাকছে দলে। পূর্বনির্ধারিত জায়গায় পৌঁছে একে অন্যের দেখা পেয়েছিলাম। সেখানেই বুঝতে পারলাম যে সবাই ছিলাম আমরা পূর্বপরিচিত, সম্ভবত কেবল একজন বাদে। একসঙ্গে মিলিত হওয়ার পর আমরা জেনেছিলাম আমাদের দলনেতা মুনীর ভাই। এটা জেনে এ কারণে আশ্বস্ত হয়েছিলাম যে ছাত্র ইউনিয়নের নেতাদের একজন তিনি হওয়ায় তাঁর সাহস আর মেধার সঙ্গে আগেই আমরা পরিচিত ছিলাম।

মুনীর ভাই মানুষটি ছোটখাটো হলেও তখন থেকেই ছিলেন তিনি অসম্ভব কর্মঠ, সাহসী আর ধীরস্থির স্বভাবের। তাঁর এসব গুণ দেখার সুযোগ হয়েছিল ১৯৭০–এর ঘূর্ণিঝড়ের পর ভোলা পার হয়ে চরফ্যশনে ত্রাণকাজে যোগ দিতে গিয়ে। সেখানেও আমাদের নেতা ছিলেন মুনীর ভাই।

মুনীর ভাই মানুষটি ছোটখাটো হলেও তখন থেকেই ছিলেন তিনি অসম্ভব কর্মঠ, সাহসী আর ধীরস্থির স্বভাবের। তাঁর এসব গুণ দেখার সুযোগ হয়েছিল ১৯৭০–এর ঘূর্ণিঝড়ের পর ভোলা পার হয়ে চরফ্যশনে ত্রাণকাজে যোগ দিতে গিয়ে। সেখানেও আমাদের নেতা ছিলেন মুনীর ভাই।

পাকিস্তানিদের চোখ ফাঁকি দিয়ে ফেরিঘাট পার হওয়ার পর মুনীর ভাই স্বাভাবিকভাবেই আমাদের সেই দলটির নেতৃত্বের হাল ধরেছিলেন। কোন পথে কীভাবে সীমান্ত পার হতে হবে, এর আগে কোথায় রাত্রি যাপন করতে হবে, এর কিছুই আমাদের জানা না থাকলেও মুনীর ভাই আগে থেকেই সব ঠিকঠাক জেনে এসেছিলেন। তাঁর নির্দেশনায় এরপর আমরা রওনা হই আমাদের সেই রাত্রিবাসের জায়গার উদ্দেশ্যে।

বাংলাদেশের সীমান্ত বরাবর এ রকম বিভিন্ন জায়গায় সেই সময় ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়নের নিবেদিতপ্রাণ বেশ কিছু কর্মী ছিলেন, যাঁদের দায়িত্ব ছিল দলের সদস্যদের সীমান্ত পার হতে সাহায্য করা এবং ট্রেনিং শেষ করে দেশে ফিরে আসা যোদ্ধাদের পথ দেখিয়ে গন্তব্যে নিয়ে যাওয়ার। অনেকেই দলের নির্দেশে সরাসরি যুদ্ধে যোগ দেননি। তবে এঁদের পালন করে যাওয়া সেই দায়িত্ব ছাড়া মুক্তিযুদ্ধ সম্ভব হতো বলে আমার মনে হয় না। আমি নিশ্চিত আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগের বেলাতেও একই বক্তব্য প্রযোজ্য।

আমাদের সেই আশ্রয়দাতার সঙ্গে যোগাযোগের দায়িত্ব মুনীর ভাইয়ের ওপর ন্যস্ত ছিল এবং পরদিন খুব ভোরে আমাদের নিয়ে সেই ব্যক্তি যাত্রা করেছিলেন সীমান্তের পথে। পথের সবচেয়ে বিপজ্জনক অংশ ছিল সিঅ্যান্ডবি রোড নামে পরিচিত ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে সিলেট যাওয়া সড়ক। পাকিস্তানি বাহিনীর কনভয় ও জিপ কিছুক্ষণ পরপর সেই পথ ধরে আসা–যাওয়া করায় সাবধানে সেই সড়ক পার হতে হতো।

আমাদের বেলায় অবশ্য কোনো অঘটন ঘটেনি এবং আশ্রয়দাতা আমাদের সীমান্তের একেবারে কাছে নিয়ে গিয়ে নিজে ফিরে গিয়েছিলেন, সম্ভবত আরও একটি দলের আগমন প্রতীক্ষায়। এরপর থেকে পুরোপুরি আমরা মুনীর ভাইয়ের ওপর নির্ভরশীল। আমাদের মধ্যে বয়সে সবচেয়ে বড় ছিলেন তিনি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ ক্লাসের ছাত্র। সবচেয়ে ছোট সদস্য ছিলেন এম এম আকাশ, বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির অধ্যাপক এবং সেই সময়ে সপ্তম কিংবা অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। আমি তখন ঢাকা কলেজে এইচএসসি দ্বিতীয় বর্ষে। ছোটদের মধ্যে আরও ছিলেন আহমেদ জামাল, বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসের অধ্যাপক। আরও ছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের দুজন।

সীমান্ত পার হয়ে ভারতের মাটিতে আমরা যখন পা রাখি, তখন বিকেল। আগের দিন দাউদকান্দি ফেরিঘাট ছেড়ে আসার পর কিছুটা পথ আমরা গিয়েছি নৌকায়, বাকি সবটা ছিল পদযাত্রা। ফলে ইতিমধ্যে ক্লান্ত হয়ে পড়া আমাদের দলটি অপেক্ষায় ছিল আগরতলায় পৌঁছে জায়গামতো নিজেদের উপস্থিতির জানান দিতে। এ কারণেই সবাই আমরা চাইছিলাম যত দ্রুত সম্ভব আগরতলা পৌঁছে যেতে। তবে ভাগ্য তখন আমাদের সহায় হয়নি।

সীমান্ত পার হয়ে এসে আমরা যখন কোন পথে আগরতলা যেতে হবে, সেই খোঁজে ছিলাম, সেখানকার লোকজন তখন আমাদের বলেছিলেন, এমপি সাহেবের অনুমতি না নিলে পথ পার হওয়া যাবে না। এমপি সাহেব মানে কুমিল্লার আসন থেকে জাতীয় পরিষদে নির্বাচিত সদস্য। আমরা ভেবেছিলাম কঠিন কাজ, এটা মোটেও হওয়ার কথা নয়। আমরা তো যাচ্ছি যুদ্ধ করতে, ফলে এমপি সাহেবের এতে আপত্তি থাকতে পারে, আমরা তা মোটেও ভাবিনি। সীমান্তসংলগ্ন একটি জায়গায় এমপি সাহেব তাঁর ক্যাম্প চালাচ্ছেন।

সেখানে গিয়ে এমপি সাহেবের দরবারে হাজির হলে আমাদের প্রত্যেককে তিনি এক এক করে আপাদমস্তক দেখে নিয়ে বলে উঠেছিলেন, তোমরা তো বাম ঘরানার লোক এবং এখানে এসেছ মুক্তিযুদ্ধে বাগড়া দিতে। ফলে অনুমতি তোমাদের আমি দেব না, বরং ফায়ারিং স্কোয়াডে তোমাদের পাঠানো যায় কি না, সেটা আমাকে ভেবে দেখতে হবে। যুদ্ধে যোগ দিতে এসে পাকিস্তানি দুশমনদের চোখ এড়িয়ে ভারতের মাটিতে পা দেওয়ার পর সেটা ছিল আমাদের জন্য প্রথম ধাক্কা খাওয়া।

আমরা ছোটরা এতে ঘাবড়ে গেলেও মুনীর ভাই খুব ঠান্ডা মাথায় এমপি সাহেবকে বোঝাতে চেষ্টা করেছিলেন আমরা কারা এবং কোন উদ্দেশ্য নিয়ে সেখানে উপস্থিত হয়েছি। তবে তারপরও তিনি শান্ত না হয়ে একই কথা বলে যাচ্ছিলেন এবং মুনীর ভাইও পাল্লা দিয়ে ধীরস্থিরভাবে তাঁকে বোঝানো অব্যাহত রেখেছিলেন। একপর্যায়ে কী মনে করে একটি কাগজে নিজের দস্তখতসহ কিছু একটা লিখে মুনীর ভাইয়ের হাতে দিয়ে বলেছিলেন, এখনই তোমরা এখান থেকে চলে যাও। অনেকটা হাঁপ ছেড়ে বাইরে এসে আমরা জানতে পারি যে কিছুক্ষণ পর সীমান্তের সেই এলাকায় কারফিউ শুরু হবে এবং অনুমতি ছাড়া বিএসএফ কাউকে বাইরে থাকতে দেবে না।

এমপি সাহেবের দরবারে হাজির হলে আমাদের প্রত্যেককে তিনি এক এক করে আপাদমস্তক দেখে নিয়ে বলে উঠেছিলেন, তোমরা তো বাম ঘরানার লোক এবং এখানে এসেছ মুক্তিযুদ্ধে বাগড়া দিতে। ফলে অনুমতি তোমাদের আমি দেব না, বরং ফায়ারিং স্কোয়াডে তোমাদের পাঠানো যায় কি না, সেটা আমাকে ভেবে দেখতে হবে।

কী করা যায় তা নিয়ে আমরা যখন ভাবছি, এক ট্যাক্সিচালক তখন এগিয়ে এসে বলেছিল, বিএসএফের সঙ্গে তার ভালো জানাশোনা আছে এবং এ ছাড়া এমপি সাহেবের কাগজ হাতে থাকায় কোনো অসুবিধা আমাদের হবে না। ফলে সে আমাদের আগরতলা নিয়ে যেতে পারে, তবে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে দ্বিগুণ ভাড়া দিতে হবে। আমরা চাইছিলাম যত দ্রুত সম্ভব সেই জায়গা ছেড়ে চলে যেতে।

তাই ভাড়া বেশি হওয়া সত্ত্বেও ট্যাক্সি নিয়ে আমরা রওনা হয়ে যাই আগরতলার পথে। মিনিট তিরিশেক যাওয়ার পরই বাঁশি বাজিয়ে বিএসএফ আমাদের ট্যাক্সি থামিয়ে দেয় এবং কারফিউ ভাঙার অভিযোগে ছোট একটি ছাপরা ঘরে আমাদের বন্দী করে রাখে। আকাশ এবং জামাল খুবই ভেঙে পড়লেও মুনীর ভাই বারবার তাদের বোঝাতে চেষ্টা করছিলেন খারাপ কিছু হওয়ার কথা নয়, কেননা খারাপ কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে আমরা সীমান্ত পার হইনি। তবে কখন আমাদের ছাড়া হবে কিংবা আদৌ ছেড়ে দেওয়া হবে কি না, তার কিছুই আমরা তখন সেই অন্ধকার ছাপরা ঘরে বসে বুঝে উঠতে পারিনি। খাওয়াদাওয়া তো দূরের কথা, এমনকি টয়লেটের ব্যবস্থাও সেখানে ছিল না।

আকাশ এক ফাঁকে বাঁশের বেড়ার ফাঁক দিয়ে প্রহরারত বিএসএফ জওয়ানের কাছে টয়লেটে যাওয়ার অনুমতি চাইলে হিন্দি ভাষায় গালি ওকে খেতে হয়েছিল। গালি খেয়ে আসলেই কান্না শুরু করেছিল সে। আমার নিজেরও তখন কান্না পাওয়ার অবস্থা। একমাত্র মুনীর ভাই ছিলেন শান্ত-অবিচল। আকাশকে তিনি বোঝাতে চাইছিলেন সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।

এভাবে রাত কেটে যেতে থাকা অবস্থায় একসময় ছাপরা ঘরের দরজার চাবি খোলার শব্দে সবার তন্দ্রা গিয়েছিল কেটে। বিএসএফের দুই সেপাই ঘরে ঢুকে হেঁড়ে গলায় হাঁক দিয়ে বলে উঠেছিল, ‘তোমকা লিডার কৌন হায়?’ মুনীর ভাই উঠে দাঁড়াতেই একজন তাঁর হাত চেপে ধরে এবং অন্যজন একটি কাপড় দিয়ে চোখ বেঁধে নিয়ে বলে ওঠে, ‘চলো।’ আমাদের জন্য সেটা ছিল কিছু না বুঝে মস্ত বড় হোঁচট খাওয়া। আমাদের দলের মেডিকেলের ছাত্র ডালু ভাই আমার কানের কাছে মুখ এনে বলেছিলেন, ‘মুনীর ভাইকে দিয়ে শুরু এবং এরপর এক এক করে আসবে আমাদের সকলের পালা।’ অনেকটা স্বগতোক্তির স্বরে তিনি আরও বলেছিলেন, ‘এলাম দেশের জন্য যুদ্ধ করতে, আর এখন কিনা বিএসএফের হাতে প্রাণ যায়।’

সম্ভবত ঘণ্টাখানেক পর আবারও দরজা খোলার শব্দে আমরা সজাগ হয়ে উঠি। বিএসএফ সদস্যের হাতে ধরে রাখা হারিকেনের আলোতে চোখে পড়ছিল দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মুনীর ভাইয়ের হাস্যোজ্জ্বল মুখ। সেই মুখ আমাদের বলে দিচ্ছিল সবকিছু ঠিক আছে।

ঘটনা কী হয়েছিল সেই বর্ণনা মুনীর ভাই তখন দিয়েছিলেন। না, আমরা যা আশঙ্কা করেছিলাম, সেই ফায়ারিং স্কোয়াডে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়নি, বরং বিএসএফের মেজর তাঁকে ডেকেছিলেন কথা বলার জন্য। ঘটনাক্রমে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি পিকআপ মেলাঘর ক্যাম্প থেকে সীমান্তের দিকে যাওয়ার পথে বিএসএফ কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলার জন্য সেখানে থেমেছিল এবং বিএসএফের মেজর বাংলাদেশের সেনা কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন হায়দারকে তাঁর শিবিরে আটক কয়েকজন তরুণের কথা বললে ক্যাপ্টেন হায়দার জানতে চেয়েছিলেন কারা সেই তরুণ। আর সে জন্যই চোখ বেঁধে মুনীর ভাইকে নিয়ে যাওয়া। মুনীর ভাই ক্যাপ্টেন হায়দার এবং বিএসএফ মেজরকে কারা আমরা তা বুঝিয়ে বলায় দুজনেই তাঁরা নিশ্চিত হতে পেরেছিলেন যে শত্রুপক্ষের লোক আমরা নই এবং আমরা সেখানে এসেছি যুদ্ধে যোগ দিতে। ক্যাপ্টেন হায়দার তখন মুনীর ভাইকে বলেছিলেন, যেহেতু তিনি তখন সীমান্তের পথে যাচ্ছিলেন, তাই আমাদের সঙ্গে নেওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। আমরা যেন বিএসএফ ক্যাম্পেই রাত কাটাই এবং ভোরে তিনি না আসতে পারলেও তাঁর অন্য কোনো সহকর্মী সেই পথ দিয়ে যাওয়ার সময় আমাদের সেখান থেকে তুলে মেলাঘর ক্যাম্পে নিয়ে যেতে তাঁকে তিনি বলবেন।

খুব ভোরে সূর্য ওঠার আগে পিকআপের শব্দে আমাদের ঘুম ভেঙে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘরের দরজা খোলার শব্দ কানে আসে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অন্য এক কর্মকর্তা, সম্ভবত ক্যাপ্টেন মাহবুব আমাদের দেখে বলেছিলেন, আমরা যেন পিকআপের পেছনে উঠে যাই এবং তিনি আমাদের মেলাঘর ক্যাম্পে নিয়ে যাবেন। মেলাঘর ক্যাম্পে পৌঁছে যাওয়ার পর সেনা কর্মকর্তা আমাদের বলেছিলেন, ক্যাম্পে যোগ দেওয়ার আগে মেজর খালেদ মোশাররফ আমাদের সঙ্গে কথা বলবেন। আমরা তখন পড়ে যাই দোটানায়। আগরতলায় আমাদের রওনা হওয়ার খবর পৌঁছে গেছে। ফলে সেখানে অপেক্ষায় আছেন আমাদের দলের নেতা–কর্মীরা। তাই মুনীর ভাই একা খালেদ মোশাররফের সঙ্গে দেখা করে তাঁকে বুঝিয়েছিলেন কোথায় এবং কেন আমরা যেতে চাই। খালেদ মোশাররফ মুনীর ভাইয়ের ইচ্ছার প্রতি সম্মান জানিয়ে বলেছিলেন, তিনি বুঝতে পারছেন আমরা মুক্তিযুদ্ধ করতে এসেছি। ফলে কোথা থেকে যুদ্ধ করা সেটা কোনো বিষয় নয়। তাই আমাদের সহযোদ্ধারা যেহেতু অপেক্ষায় আছে, ফলে আমাদের উচিত হবে আগরতলায় চলে যাওয়া। তবে গাড়িতে আমাদের নিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না বলে তিনি দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন।

মনে পড়ে মেলাঘর ক্যাম্পের গেট পার হয়ে কিছুদূর যাওয়ার পর বাসের অপেক্ষায় আমরা যখন ছিলাম, মুনীর ভাই তখন পাশের একটি দোকান থেকে কলা আর মুড়ি কিনে এনে পরম যত্নে আমাদের খেতে দিয়েছিলেন।

এর পরের কাহিনি বাকি ইতিহাস। আগরতলার ক্র্যাফট হোস্টেলে আমাদের সেই ছোট দলটিকে পৌঁছে দিয়ে মুনীর ভাই মিশে গিয়েছিলেন যুদ্ধে। এরপর যুদ্ধের পুরো সময় ধরে তাঁর সঙ্গে আমার আর দেখা হয়নি। যুদ্ধজয়ের পর মুনীর ভাইকে দেখেছি আবারও সেই আগের মতোই সমান উৎসাহ নিয়ে ছাত্র ইউনিয়নের সব রকম কর্মকাণ্ডে যোগ দিতে। এরপর তো আমার দেশ ছেড়ে চলে যাওয়া। দীর্ঘ বিরতি শেষে দেশে ফিরে গেলে আবারও মাঝেমধ্যে দেখা হয়েছিল মুনীর ভাইয়ের সঙ্গে। সেই সময়টা তো আমাদের সবার জন্য ছিল বিভ্রান্তির এক কাল। মুক্তিযুদ্ধের কথা বলাও তখন যেন ছিল পাপ। ফলে দেখা হলেও আগরতলার সেই অম্ল মধুর স্মৃতির রোমন্থন আমরা কখনো করিনি। এরপর আবার আমি দেশত্যাগ করলে মুনীর ভাইয়ের সঙ্গে সব রকম যোগাযোগও যায় ছিন্ন হয়ে। তিনি যে সাংবাদিকতায় আছেন, সেটা আমার জানা ছিল। তবে অনেক পরে জেনেছি, নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে সংবাদের হাল তিনি ধরেছেন এবং চেষ্টা করে চলেছেন পত্রিকাটিকে আবারও ঘুরে দাঁড়ানোয় সাহায্য করতে। আর এখন করোনা মহামারি এর সবটাতেই টেনে দিচ্ছে সমাপ্তি।

তবে তারপরও বলতে হয়, না, গৌরবগাথার সমাপ্তি নেই, মুনীর ভাই। আপনি আছেন আমাদের সেই গৌরবময় অধ্যায়ের একটি অংশ হয়ে এবং আমরা নিজেরাও গৌরব বোধ করে যাব এই ভেবে, যে পথ দেখিয়ে যুদ্ধের পথে নিয়ে যাওয়ায় আপনি ছিলেন আমাদের নেতা।

মনজুরুল হক প্রথম আলোর টোকিও প্রতিনিধি