এক প্রাতঃস্মরণীয় রাজনীতিবিদের জন্মদিনে

লালবাহাদুর শাস্ত্রী (১৯০৪–১৯৬৬)

লালবাহাদুর শাস্ত্রী (১৯০৪-১৯৬৬) ভারতের দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী। পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু ১৯৬৪ সালের ২৭ মে মৃত্যুবরণ করলে ওই বছরের ৯ জুন তিনি দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং ১৯৬৬ সালের ১১ জানুয়ারি পর্যন্ত তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। ভারতের ১৫ জন প্রধানমন্ত্রীর জীবনী পর্যালোচনা করলে মহত্ত্ব, সততা ও নীতিনৈতিকতার মানদণ্ডে শাস্ত্রীই একমাত্র নেতা, যিনি ব্যক্তি মহত্ত্বের উচ্চতায় শুধু ভারতবর্ষ নয়, বিশ্ব ইতিহাসে বিরল ব্যক্তিত্ব হিসেবে স্বীকৃত।

১৯০৪ সালের ২ অক্টোবর উত্তর প্রদেশের বরাণসী থেকে সাত মাইল দূরে মোগলসরাই রেলস্টেশনসংলগ্ন চান্দাউলি গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ২ অক্টোবর (১৮৬৯) মহাত্মা গান্ধীরও জন্মদিন। সে কারণে হয়তো শাস্ত্রীর জন্মদিন ঢাকা পড়ে যায়। এ বছরের ১১৭তম জম্মবর্ষে তাঁর পুণ্যস্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।

১৯২০ সাল থেকে তাঁর রাজনীতির যাত্রা শুরু। ১৯৪৬ সাল থেকে মৃত্যুর আগপর্যন্ত বিধানসভা, রাজ্যসভা ও লোকসভার নির্বাচিত প্রতিনিধি এবং ১৯৪৬ সাল থেকে উত্তর প্রদেশের রাজ্য সরকার এবং ১৯৫২ সাল থেকে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার সদস্য হিসেবে পাঁচটি মন্ত্রণালয়—রেলওয়ে, যোগাযোগ, পররাষ্ট্র, শিল্প ও বাণিজ্য, স্বরাষ্ট্র প্রভৃতি দপ্তরের পূর্ণ মন্ত্রী (মাঝখানে দপ্তরবিহীন) এবং শেষের ৫৮১ দিন ভারতের প্রধানমন্ত্রীর পদ অলংকৃত করেন।

১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বরে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের পর তৎকালীন সোভিয়েত রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আলেক্সি কোসিগিনের মধ্যস্থতায় তাসখন্দে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ও লালবাহাদুর শাস্ত্রীর মধ্যে ১০ জানুয়ারি (১৯৬৬) একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষরের পর দিবাগত রাতে (১১ জানুয়ারি) শাস্ত্রী হৃদ্‌যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে তাসখন্দেই মারা যান।

ইন্ডিয়ান এয়ারফোর্সের বিমানে এক সফরের সময় লালবাহাদুর শাস্ত্রী। যাত্রাপথেই সরকারি ফাইল দেখছেন। পাশে স্ত্রী ললিতা দেবী।
ছবি: সংগৃহীত।

উপমহাদেশ শুধু নয়; একজন আদর্শ, সচ্চরিত্রবান, কঠোর পরিশ্রমী ও ত্যাগী নেতা হিসেবে বিশ্ব ইতিহাসে তিনি এক বিরল ও ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব। ভারতে শাস্ত্রীর সততা, কৃচ্ছ্র, ত্যাগ, সরল ও সাদাসিধে জীবন, প্রখর নীতিবোধ, উচ্চতর জীবনদর্শন ইত্যাদি নিয়ে বহু কিংবদন্তি চালু আছে। রাজনৈতিক ও শাসনতান্ত্রিক সব কীর্তির চেয়েও তিনি তাঁর বিরল ব্যক্তিচরিত্রের সুমহান আদর্শ ও বৈশিষ্ট্যের জন্য বিশ্বব্যাপী অনেক বেশি নন্দিত ও স্মরণীয়।

১৯৪৬ থেকে ১৯৬৫ সালের পুরো সময় তিনি মন্ত্রী হিসেবে সরকারি বাড়িতে বসবাস করেন। ১৯৬৬ সালের জানুয়ারিতে আকস্মিক মৃত্যুর পর তাঁর পরিবারকে প্রধানমন্ত্রীর নির্ধারিত বাড়িটি ছেড়ে দিতে হয়। তখনো দেখা গেল ভারতে শাস্ত্রীর কোথাও কোনো বাড়ি নেই। সম্পদের মধ্যে পাওয়া গেল ১২ হাজার টাকা দামের পুরোনো একটি ফিয়াট গাড়ি, যা ব্যাংক লোনে কেনা। ওই লোনের পাঁচ হাজার টাকা তখনো অপরিশোধ্য। তাঁর পরিবারকে তিনি সরকারি গাড়ি ব্যবহার করতে দিতেন না। তাই ছেলেমেয়ের স্কুল-কলেজে যাওয়া-আসার জন্য অনেক পীড়াপীড়িতে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর লোন করে গাড়িটি কেনা হয়।

যাহোক, ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রীর ভারতে কোনো নিজস্ব বাড়ি নেই—বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর দেশব্যাপী একটি আলোড়ন ওঠে। সারা ভারত থেকে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের ঠিকানায় সাধারণ মানুষ অকাতরে টাকাপয়সা পাঠাতে থাকে। তাতে অনেক টাকা জমা হয়। অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী গোলজারি লাল নন্দা এসব অর্থ নিয়ে মিসেস ললিতা শাস্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে এ অর্থ গ্রহণের অনুরোধ জানান। তিনি কয়েক দিন সময় চান এবং ভেবে পরে বলবেন বলে জানান। পরে তিনি বলেন, শাস্ত্রীজি জীবিতকালে যা করেননি, তাঁর স্ত্রী হিসেবে তাঁর অবর্তমানে তা তিনি করতে পারেন না। ভারতবাসীর ভালোবাসার এ দান ভারতের মানুষের কল্যাণে ব্যয় করার জন্য তিনি অনুরোধ জানান।

১৯৫৭ সালের নির্বাচনের আগে ‘কামরাজ পরিকল্পনা’র অধীনে অনেকের সঙ্গে শাস্ত্রীজিও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে দলের কাজে মনোনিবেশ করেন। তখন তাঁর বাড়ি নিয়ে একই সংকট হয়। ভারতে তাঁকে বলা হতো ‘হোমলেস হোম মিনিস্টার’। সরকারি পদ ব্যবহার করে কোনো বিশেষ সুবিধা নেওয়ার তিনি ছিলেন ঘোর বিরোধী। কথিত আছে, একবার দিল্লির কোনো এক কলেজে ভর্তির আবেদনপত্র জমা দেওয়ার শিক্ষার্থীর ভিড়ে লাইনে দাঁড়িয়ে শাস্ত্রীর এক ছেলে ফরম জমা দিয়েছিলেন। এটিও তৎকালে পত্রপত্রিকায় একটি বিস্ময়কর খবর হিসেবে প্রকাশিত হয়।

একবার এক বয়স্কা দলছুট তীর্থযাত্রী একটি রেলস্টেশনে ট্রেনের খোঁজ করছিলেন। প্ল্যাটফর্মের লোকজন বললেন, যে ট্রেন তিনি খুঁজছেন, সেটি তো চলে গেছে। পরদিন একই সময়ে এ ট্রেন পাওয়া যাবে। স্টেশনের একজন সদয় পরিচ্ছন্নতাকর্মী বৃদ্ধাকে একটি অপেক্ষাগারে বসিয়ে নানা প্রশ্ন করে তাঁর কোনো একটি নির্ভরযোগ্য ঠিকানা বের করার চেষ্টা করতে থাকেন। তখন বৃদ্ধা বললেন, তাঁর ছেলে রেলে চাকরি করেন। ছেলের নাম কী, এই প্রশ্ন করতেই বৃদ্ধা বললেন, লাল। লালবাহাদুর, লোকে ‘শাস্ত্রীজি’ বলে ডাকে।। স্টেশনে হইচই পড়ে যায়। আরে তিনি তো মন্ত্রী মহোদয়ের মাতাজি। রেলের কর্তারা মন্ত্রীর পিএসের সঙ্গে কথা বলে বিশেষ সেলুনে বৃদ্ধাকে দিল্লিতে মন্ত্রীর বাসায় পৌঁছে দেন। এত খাতির-যত্নে মা তো অভিভূত। মাকে পেয়ে ছেলেও খুশি। মা শাস্ত্রীকে বললেন, ‘বাবা, তোমাদের রেলের লোকজন খুব ভালো! আমাকে খুব যত্ন করেছেন। আচ্ছা বাবা, তুমি রেলে কী চাকরি করো?’ শাস্ত্রী মাকে বললেন, ‘ছোটাসা এক কাম মা।’ এই হচ্ছেন বিনয়ের অবতার শাস্ত্রী।

তাঁর দৈনন্দিন জীবনযাপন ছিল অত্যন্ত সাদাসিধে—পায়ে পাম শু বা চটি, পরনে ধুতি-কুর্তা ও হাতাকাটা কোট। প্রথম কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হওয়ার পর নেহরু শাস্ত্রীকে কোনো একটি পশ্চিমা দেশে প্রতিনিধিদলের নেতা হিসেবে পাঠান। যাত্রার আগে নেহরুর হঠাৎ মনে হয়, ও দেশে তো অনেক শীত। শাস্ত্রীর তো ওভারকোট নেই। নেহরু তাঁর নিজের একটি ওভারকোট পাঠিয়ে দেন। শাস্ত্রীজির উচ্চতা ছিল ৫ ফুট ২ ইঞ্চি। নেহরুর ওই কোট শাস্ত্রীর গোড়ালি পর্যন্ত ঢেকে যায়। প্রতিনিধিদল নিয়ে দেশে ফিরে শাস্ত্রী নিজে কোটটি ধন্যবাদসহ নেহরুকে ফেরত দিয়ে আসেন।

১৯৫৬ সালে অন্ধ্র প্রদেশের মেহবুবনগরে এক রেল দুর্ঘটনায় ১১২ জন প্রাণ হারান। মন্ত্রী হিসেবে দায় গ্রহণ করে শাস্ত্রী প্রধানমন্ত্রী বরাবরে পদত্যাগপত্র জমা দেন। প্রধানমন্ত্রী নেহরু সে পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেননি। তিনি বলেন, এ দুর্ঘটনায় মন্ত্রীর কোনো দায় নেই। তিন মাস পর তামিলনাড়ুর আড়িয়ালপুতে আর একটি দুর্ঘটনা ঘটে এবং ১৪৪ জন মারা যান। এবার শাস্ত্রী বললেন, ‘না, আর নয়। এ দায় আমার।’ তিনি রেলমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দেন। ১৯৫৭ সালের লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেস অনেক ভালো ফল লাভ করে বিজয়ী হয় এবং নেহরু পুনরায় তাঁকে মন্ত্রিসভায় ফিরিয়ে আনেন। ১৯৪৬ থেকে পরবর্তী ২০ বছর তিনি বিধানসভা, রাজ্যসভা ও লোকসভার সদস্য, নানা সময়ে ১২ বছর মন্ত্রী এবং ১ বছর ৭ মাস ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন।

লালবাহাদুর শাস্ত্রী খাটো ও শীর্ণ স্বাস্থ্যের হলেও তাঁর ব্যক্তিত্ব ছিল দিল্লির কুতুব মিনারের চেয়েও উঁচু। ফুলের কোমলতা ও হীরকখণ্ডের কাঠিন্য—এ দুয়ের এক অপূর্ব সংমিশ্রণ ছিল তাঁর চরিত্রে। পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধে তাঁর সাহস ও বিচক্ষণতা ভারতবাসী চিরদিন শ্রদ্ধাবনত চিত্তে স্মরণ করবে। ভারতে তখন একদিকে চরম খাদ্যসংকট, অন্যদিকে বিদেশি আক্রমণ। এ দুই সংকটে দেশ ও জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য তিনি একটি স্লোগান উদ্ভাবন করেন। ‘জয় কিষান জয় জোয়ান’—এ স্লোগানে পুরো দেশ জেগে ওঠে। মাঠের রণকৌশলেও তিনি কুশলতার পরিচয় দেন।

পাকিস্তান যে মুহূর্তে কাশ্মীর ফ্রন্টে ভালো অবস্থানে, তখন তিনি লাহোর ফ্রন্টে আক্রমণের নীতি গ্রহণ করেন। ভারতীয় বাহিনী পাকিস্তানের মূল ভূখণ্ডের প্রায় ৭৭০ মাইল অভ্যন্তরে ঢুকে পড়ে। পরে জাতিসংঘের হস্তক্ষেপে অস্থায়ী যুদ্ধবিরতি এবং তাসখন্দে স্থায়ী যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এবং দুই দেশ যুদ্ধ-পূর্ব অবস্থানে ফেরত আসে।

বর্তমান প্রজন্মের রাজনৈতিক নেতারা এ কিংবদন্তি মহাপুরুষকে কোনোভাবে মূল্যায়ন করেন বলে কি মনে হয়!

ড. তোফায়েল আহমেদ শিক্ষাবিদ ও শাসনবিষয়ক গবেষক।

ইমেইল: [email protected]