কাকে জানাব জন্মদিনের শুভেচ্ছা, কাকে জড়িয়ে ধরব?

ফাহিম সালেহ
ছবি: ইন্সটাগ্রাম


ডিসেম্বর ১২। ফাহিমের জন্মদিন। আমার ছেলে ফাহিম সালেহর জন্ম ১৯৮৬ সালে সৌদি আরবের দাহরান শহরে। আমি তখন কিং ফাহদ ইউনিভার্সিটি অব পেট্রোলিয়ামে শিক্ষকতা করতাম, কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগে। ফাহিমের ছোটবেলার প্রথম চার বছর সৌদি আরবেই কেটেছে। ফাহিমের জন্মদিনে ওকে নিয়ে কত বিচিত্র কাহিনিই আজ মনে পড়ছে। আমার ফাহিম আমাদের থেকে হারিয়ে গেছে। কিন্তু এসব কাহিনি তো হারানোর নয়!
প্রতিবছর ফাহিমের জন্মদিনটা ঘটা করে করতে হতো। আর অবশ্যই নতুন খেলনা চাই জন্মদিনে। ছোটবেলায় ছোটদের খেলনা। ফাহিম বড় হওয়ার পরও আমাকে জন্মদিনের গিফটের জন্য খেলনা বাছাই করতে হতো। অবশ্যই অভিনব কোনো গ্যাজেট কিংবা নতুন আইডিয়ার মজার কোনো খেলনা। আমি বেশ সময় করে ইন্টারনেট ঘেঁটে ফাহিমের বার্থ ডে গিফট জোগাড় করতাম। যখন একটা সুন্দর ও অভিনব কিছু পেতাম, খুব তৃপ্তি লাগত—ফাহিমও খুব খুশি হতো। ৩০তম জন্মদিনে ফাহিমের গিফট নির্বাচনে একটা বড় ব্যতিক্রম হলো। এবার কোনো খেলনা বা গ্যাজেট নয়। এবার কাজের কিছু চাই। আমার জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ! সেই গল্পই এখন বলছি।

২০১৬ সালের নভেম্বর। আমি তখন ঢাকায়। কিছু কাজকর্ম ছিল, নভেম্বরের শেষের দিকে যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে আসার কথা। নভেম্বরের প্রথম দিকে ফাহিম গেল থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর ও চীনে, পাঠাওয়ের জন্য নতুন বিনিয়োগকারীর খোঁজে। এর মধ্যে ঢাকার পত্রপত্রিকায় উবার ও পাঠাও নিয়ে বেশ উদ্বেগজনক খবর বের হতে শুরু করেছে। পাঠাও ও উবার বেআইনিভাবে ব্যবসা করছে, ওদের কোনো লাইসেন্স নেই, ইত্যাদি ইত্যাদি। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) কর্মকর্তারা অনতিবিলম্বে এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বললেন। জোর গুজব, পাঠাওয়ের সার্ভিস বন্ধ করে দেওয়া হবে।
পাঠাও সবে হাঁটি হাঁটি পা পা করে যাত্রা শুরু করেছে। ফাহিমের হ্যাকহাইস ছিল পাঠাওয়ের আঁতুড়ঘর। ফাহিম ছিল স্টার্ট-আপ ব্যবসার একজন বড় কারিগর। নিজের মেধা ও শ্রম দিয়ে ঢাকায় শুরু করেছিল হ্যাকহাউস, বাংলদেশে অ্যাপভিত্তিক স্টার্ট-আপ ব্যবসার প্রচলন করতে। পাঠাওতে ফাহিমের অনেক পরিশ্রম ও অর্থ বিনিয়োগ রয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই পাঠাও নিয়ে এই ধরনের নেতিবাচক খবরাখবর দেখে আমি দারুণভাবে বিচলিত হলাম। ফাহিমকে একটা ই-মেইল পাঠালাম, পাঠাওয়ের লোকজন যেন অবিলম্বে বিআরটিএ-এর কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করে এবং পাঠাওয়ের সার্ভিস অনুমোদনের জন্য আবেদন করে, যেমনটা উবার চেষ্টা করছে। ফাহিম আমার ই-মেইলের উত্তর দিল, পাঠাওতে সিনিয়র লোকজন কেউ নেই, যারা এটা নিয়ে তদবির করতে পারে। আমাদেরই এই দায়িত্ব নিতে হবে। বলল, রাতে ও আমাকে ফোন করবে। এর মধ্যে ফাহিম চীন থেকে নিউইয়র্কে ফিরে এসেছে।

রাতে ফাহিমের ফোন পেলাম। জানাল, ওরা যদি পাঠাওকে ব্যবসা করতে না দেয়, তাহলে আমার এত পরিশ্রম ও বিনিয়োগ সব বিফলে যাবে। তা ছাড়া যে বিনিয়োগকারীরা আমার কথায় পাঠাওতে বিনিয়োগ করেছেন, তাঁরাও অনেক টাকা হারাবেন। আমি বললাম, ‘বাবা, তুমি বলো আমি কী করতে পারি? আমার পক্ষে সম্ভব হলে আমি অবশ্যই করব।’ এরপর ফাহিম যে প্রস্তাব দিল, আমি বেশ চমকে গেলাম। বলল, ‘আমি জানি, তুমি এখনকার অনেক মন্ত্রীকে এককালে চিনতে, ওদের সাথে বাংলাদেশে রাজনীতি করেছ। তুমি সেই সব পুরোনো দিনের কথা আমাকে অনেক শুনিয়েছ। এখন তোমাকে একজন মন্ত্রীর সাথে দেখা করতে হবে। আমি শুধু জানতে চাই, রাইড শেয়ারিং নিয়ে ওদের কী নীতিমালা। এটাই হবে এই বার্থ ডেতে আমার গিফট। তোমাকে এবার আর কিছু দিতে হবে না।’
ছাত্রজীবনে ডাকসুর সদস্য ছিলাম। তখন যাদের সঙ্গে ছাত্ররাজনীতি করেছি, তাদের অনেকেই আজ মন্ত্রী। একসময় গণভবনে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে একান্তে দেখা করেছি। এখন একজন মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে দারুণ ভয় হচ্ছে! কোথায় পাব ওদের নম্বর? ওরা কি দেখা করতে বা কথা বলতে রাজি হবে? ফাহিমকে বললাম, ‘অনেক বছর ধরে আমার সঙ্গে ওদের কোনো যোগাযোগ নেই। হয়তো ওরা কেউ আমাকে চিনবেও না। তবু তুমি বলেছ, আমি অবশ্যই চেষ্টা করব।’

পাঠাওয়ের সার্ভিস চলবে, ফাহিমের বিনিয়োগ ও পরিশ্রম বিফলে যাবে না, এটা আমার জন্য অনেক অনেক আনন্দের। হোটেলে এসে ফাহিমকে একটা বিস্তারিত মেইল পাঠালাম। ফাহিম এক লাইনের একটা উত্তর দিল: ড্যাড, তোমাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। এটা আমার জীবনের সবচেয়ে সেরা জন্মদিনের গিফট!

আমি যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যাওয়ার টিকিট পিছিয়ে দিলাম। সরকারের একজন সিনিয়র মন্ত্রী। অনেক পুরোনো বন্ধু, বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রজীবন থেকেই পরিচয়। মুহসীন হলে আমার পাশের রুমে থাকত। আমরা একসঙ্গে মিটিং-মিছিল করতাম, চেষ্টা শুরু করলাম তার ফোন নম্বর পাওয়া যায় কি না। পরিচিত, আধা পরিচিত অনেককে ফোন করলাম। কেউ কেউ ফোন নম্বর দিল, বলল, এটাতে চেষ্টা করে দেখেন। ভাগ্য প্রতিকূল, যে কয়টা নম্বর জোগাড় করেছি, কোনোটাই কেউ ধরছে না।
ফাহিম প্রতিদিন সকাল–বিকেল ফোন করে, খবর নেয়। বলল, তুমি আরও চেষ্টা করো। আমি ওকে আশ্বাস দিলাম, অবশ্যই করব। আমি ফহিমকে আরও বললাম, পাঠাওর সিইও হুসেইন মোহাম্মদ ইলিয়াসকে বলতে পাঠাওয়ের সার্ভিস সম্বন্ধে কিছু প্রতিবেদন (ডশিয়র) আমাকে পাঠাতে। মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা হলে আমি কিছু বিস্তারিত তথ্য যেন তাকে দিতে পারি। মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার যতজনের যত বুদ্ধি, সব বিফলে গেল। কিন্তু আমি হাল ছাড়ছি না। আমার ফাহিমের অনুরোধ! বড় হয়ে ফাহিম আমার কাছে কখনো তেমন কিছু চায়নি।
মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার নতুন এক ‍বুদ্ধি মাথায় এল। একদিন সন্ধ্যায় সরকারি দলের অফিসে গেলাম। একটা ছোট্ট রুমে একজন তরুণ ভদ্রলোক খুব সিরিয়াসলি কিছু লেখালেখি করছেন। তাঁকে মন্ত্রী মহোদয়ের নাম বলে বললাম, পুরোনো বন্ধু, অনেক দিন ধরে দেখা নেই। একটু দেখা করতে চাই। বললেন, উনি মাঝেমধ্যে অফিসে হঠাৎ আসেন, তবে বেশির ভাগ শুক্রবার একবার আসেন। আপনি আপনার ফোন নম্বর আমার কাছে রেখে যান। পরশু শুক্রবার উনি আসার খবর পেলেই আমি আপনাকে ফোন দেব।

শুক্রবার এল। সম্ভবত ডিসেম্বরের ৯ তারিখ ছিল। ফাহিমের জন্মদিনের তখনো তিন দিন বাকি। সকাল ১০টার দিকে আওয়ামী লীগ অফিসের সেই ভদ্রলোক ফোন করলেন, তাড়াতাড়ি চলে আসেন, মন্ত্রী সাহেব আসছেন।
আওয়ামী লীগ অফিসের সমাবেশকক্ষ। মন্ত্রী মহোদয় একা বসে আছেন সামনের সারিতে, মাঝখানে, দুপাশে আরও ৪–৫টা করে চেয়ার। মন্ত্রীর দিকে মুখ করে ৫–৭ সারি লোক বসে আছেন। আমি পেছনের সারিতে একটা চেয়ার নিয়ে এক কোণে বসে পড়লাম। এর মধ্যে একজন ভদ্রলোক ঘাড়ের কাছে এসে ফিস ফিস করে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি কিছু চান? আমি আস্তে করে বললাম, মন্ত্রী সাহেব আমার ছাত্রজীবনের বন্ধু। একটু কথা বলতে চাই। তিনি একটা কাগজে নামধাম লিখে দিতে বললেন। আমি লিখলাম, সালেহ উদ্দিন আহমদ, তোমার অনেক পুরোনো বন্ধু। মুহসীন হলে আমরা একসঙ্গে ছিলাম, একসঙ্গে রাজনীতি করেছি। আমি ডাকসুর সদস্য ছিলাম।
চিরকুটটা সঙ্গে সঙ্গে মন্ত্রী সাহেব পড়লেন এবং পড়ামাত্রই বেশ ক্ষোভ প্রকাশ করলেন, পুরোনো বন্ধু এত দিন কোথায় ছিলেন? দারুণ বিব্রত বোধ করলাম। মন্ত্রী মহোদয়ের কথা দারুণ যুক্তিসংগত। এত বছর কোনো দিন দেখা করিনি, এখন কাজের জন্য চলে এসেছি! একটু পর মন্ত্রী সাহেব শান্ত গলায় কাছে ডাকলেন, পাশের চেয়ার দেখিয়ে বসতে বললেন। মন্ত্রী সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, আপনার কী প্রয়োজন? এবার বলেন। বললাম পাঠাওয়ের কথা। আমার ছেলে ফাহিম, পাঠাও প্রতিষ্ঠাতাদের একজন। এই অল্প বয়সী ছেলেগুলো পাঠাও নিয়ে অনেক পরিশ্রম করেছে। আশা করি আপনারা ওদের নিরাশ করবেন না। আমরা পাঠও ও রাইড শেয়ারিং নিয়ে আপনাদের নীতিমালাটা একটু জানতে চাচ্ছি। মন্ত্রী সাহেব শান্তভাবে শুনলেন, আমি পাঠওয়ের ফোল্ডারটা এগিয়ে দিলাম। মন্ত্রী মহোদয় একটু চিন্তা করে বললেন, এটা টেকনিক্যাল ব্যাপার, আমি এ নিয়ে খুব সময় দিতে পারিনি। আপনি বিআরটিএ অফিসে গিয়ে চেয়ারম্যান নজরুল ইসলামের সঙ্গে দেখা করে কথা বলেন। আমাকে মন্ত্রীর একটা ভিজিটিং কার্ড দিলেন। বললেন, এটা চেয়ারম্যানকে দেবেন, বলবেন আপনি আমার সঙ্গে দেখা করেছেন। ফোল্ডারটা ফিরিয়ে দিলেন, চেয়ারম্যানকে দিতে বললেন।
মন্ত্রী সাহেবকে ধন্যবাদ জানিয়ে আমি বিদায় নিলাম। যা–ই হোক মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছি, ফাহিমকে দেওয়া কথা রাখতে পেরেছি! এরপর চেয়াম্যান থেকে নীতিমালা জেনে নিতে নিশ্চয়ই কোনো অসুবিধা হবে না।

১২ ডিসেম্বর। আমি বিআরটিএ অফিসে গেলাম ও চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম সাহেবের সঙ্গে দেখা করলাম। মন্ত্রীর দেওয়া কার্ড ও পাঠাওয়ের ফোল্ডারটা দিলাম। মন্ত্রীর বন্ধু, মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে এসেছি জেনে খুব ভালো ব্যবহার করলেন। বললেন, তাঁরা নীতিমালা করছেন। পাঠাওয়ের সার্ভিস চালাতে কোনো অসুবিধা হবে না। কিছু কিছু জিনিস দেখতে হবে, কী ধরনের লাইসেন্স হবে এবং কী ধরনের সিকিউরিটি গাইডলাইন থাকবে ইত্যাদি। চেয়ারম্যান আরও বললেন, বাংলাদেশের গ্রামেগঞ্জে মানুষ ভাড়া দিয়ে মোটরবাইকের পেছনে চড়ে ঘুরে বেড়ায়। সুতরাং এসব সার্ভিস বন্ধ করা সম্ভবও হবে না।
বিআরটিএ–এর উদার নীতিমালা জেনে খুব ভালো লাগল। পাঠাওয়ের সার্ভিস চলবে, ফাহিমের বিনিয়োগ ও পরিশ্রম বিফলে যাবে না, এটা আমার জন্য অনেক অনেক আনন্দের। হোটেলে এসে ফাহিমকে একটা বিস্তারিত মেইল পাঠালাম। ফাহিম এক লাইনের একটা উত্তর দিল: ড্যাড, তোমাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। এটা আমার জীবনের সবচেয়ে সেরা জন্মদিনের গিফট!
আজ ফাহিমের ৩৪তম জন্মদিন! কাকে জানাব জন্মদিনের শুভেচ্ছা! কাকে গিফট পাঠাব? কাকে জাড়িয়ে ধরব? কাকে সঙ্গে নিয়ে ম্যানহাটনে গিয়ে ডিনার করব? কোনো কিছুরই কোনো উত্তর নেই। আমি শুধু চোখ দুটো শূন্যে মেলে চেয়ে থাকি!

সালেহ উদ্দিন আহমদ পাঠাও এর সহ প্রতিষ্ঠাতা প্রায়ত ফাহিম সালেহ এর বাবা