কাফি খান কি জানতেন?

কাফি খান

ভয়েস অব আমেরিকার বাংলা বিভাগের সংবাদ পাঠক, নাট্য ও চলচ্চিত্র শিল্পী কাফি খান গত ২ জুলাই, ওয়াশিংটনে মারা যান।  ৯৩ বছর বয়সে। কাফি খান ১৯৬৬ সালে ভয়েস অব আমেরিকায় যোগ দেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তিনি ওয়াশিংটনে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭৩ সালে কাফি খান বাংলাদেশে ফিরে আসেন। ১৯৮৩ সালে তিনি দ্বিতীয়বার ভয়েস অব আমেরিকায় যোগ দেন এবং ১৯৯৪ সালে তিনি অবসর গ্রহণ করেন।

আশির দশকের শুরুতে  কফি খান সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের প্রেস সচিব ছিলেন। একই সঙ্গে বাংলাদেশ বেতারে খবর পাঠ করতেন। বেতারে কাজ করার সূত্রে তাঁর একটি ঘটনা এখনো চোখের সামনে ভাসে।

‘ইজ ইট নিউজ? আই অ্যাম নট গোয়িং টু রিড ইট—’ এই বলে বিরক্তিসহকারে খবর লেখা পাতাটি দূরে ঠেলে দিলেন তিনি। ঠেলে দিলেন না বলে ছুড়ে দিলেন বলাই সঠিক হবে। বাংলাদেশ বেতারের (তখন রেডিও বাংলাদেশ বলা হতো) কোনো সংবাদপাঠকের এহেন আচরণ ঔদ্ধত্যের পর্যায়ে পড়ে। একজন পাঠক বা পাঠিকা সংবাদ পাঠ করেন মাত্র। কোনো খবর প্রচারিত হবে না হবে, সে বিষয়ে তাঁর ইচ্ছা–অনিচ্ছা প্রকাশের সুযোগ নেই। কর্তৃপক্ষ ইচ্ছা করলে খবর ছুড়ে ফেলার মতো আচরণের জন্য একজন সংবাদপাঠককে পাঠক তালিকা থেকে চিরদিনের মতো খারিজ করে দিতে পারেন। কিন্তু আলোচ্য এই সংবাদপাঠকের ক্ষেত্রে তেমন কিছুই ঘটেনি।

১৯৭৯ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত আমি বাংলাদেশ বেতারের বার্তা বিভাগে অনুবাদক হিসেবে কাজ করি। ১৭ বছরের এই কর্মজীবনে এ ধরনের ঘটনা দ্বিতীয়বার ঘটতে দেখিনি।

কোনো একটি নির্দিষ্ট খবর পাঠ করতে অস্বীকৃতি জানানোর মতো অস্বাভাবিক এই ঘটনা ঘটিয়েছিলেন বাংলাদেশের খ্যাতনামা ব্রডকাস্টার কাফি খান।

কী ছিল সেই খবরে, যা কাফি খান পড়েননি, সে কথা কলার আগে রেডিও বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় বার্তা সংস্থায় খবর তৈরির প্রক্রিয়া সম্পর্কে কিঞ্চিৎ ধারণা দেওয়া জরুরি। শাহবাগে বাংলাদেশ বেতার ভবনের দ্বিতীয় তলায় কয়েকটি রুম নিয়ে কেন্দ্রীয় বার্তা সংস্থার অফিস। এখানে ডিরেক্টর অব নিউজ, চিফ নিউজ এডিটর ও এডিটররা আলাদা আলাদা রুমে বসেন। বাংলা ইউনিট নামে একটি রুমে বসেন সুপারভাইজার, অনুবাদক, কমিস্ট ও সংবাদপাঠক/পাঠিকা।

আমাদের ভাষা বাংলা হলেও কেন্দ্রীয় বার্তা সংস্থায় মূল খবরটি তৈরি হয় ইংরেজিতে। বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত খবর নিউজ এডিটরের ডিকটেশনে ইংরেজিতে টাইপ করা হয়। তার এক কপি যায় চিফ নিউজ এডিটরের টেবিলে, এক কপি ইংরেজি খবর পাঠক/পাঠিকার কাছে এবং এক কপি বাংলা ইউনিটের সুপারভাইজারের কাছে।

সুপারভাইজার তাঁর হাতে আসা ইংরেজি শিটগুলো অনুবাদকদের মধ্যে ভাগ করে দেন। অনুবাদ হওয়ার পর সুপারভাইজার চেক করে দেখেন কোনো ভুলভ্রান্তি আছে কি না; তারপর হাতে লেখা খবরের শিটগুলো পাঠক/পাঠিকার হাতে তুলে দেন। সুপারভাইজারের টেবিলের পাশের একটি চেয়ারে বসে পাটক/পাঠিকা রিহার্স করেন। সবশেষে চিফ নিউজ এডিটরের কাছ থেকে হেডলাইনস ও অর্ডার আসার পর সে অনুযায়ী খবরগুলো পরপর সাজিয়ে দেওয়া হয় এবং পাঠক/পাঠিকা সেগুলো নিয়ে স্টুডিওতে ঢোকেন।

কাফি খান যে খবরটি পড়বেন না বলে সুপারভাইজারের টেবিলে ফেলে রেখে স্টুডিওতে ঢুকলেন, সে খবরটি ছিল সাকল্যে দুই লাইনের। ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ আমিই করেছিলাম, এ কারণে লাইন দুটি আমার স্পষ্ট মনে আছে। সেটি হলো ‘প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বর্তমানে চট্টগ্রাম সফরে রয়েছেন। সফরকালে তিনি চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে অবস্থান করছেন।’

কোনো একটি নির্দিষ্ট খবর পাঠ করতে অস্বীকৃতি জানানোর মতো অস্বাভাবিক এই ঘটনা ঘটিয়েছিলেন বাংলাদেশের খ্যাতনামা ব্রডকাস্টার কাফি খান।

উন্নত গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে হয়তো রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধানের প্রাত্যহিক কর্মসূচি খবরের গুরুত্ব বহন করে না বা সেগুলোকে খবর বলে গণ্য করা হয় না। কিন্তু বাংলাদেশে রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধান–সম্পর্কিত যেকোনো খবর তা যত তুচ্ছই হোক, সরকারি সম্প্রচারমাধ্যমে ফলাও করে প্রচার করাটা ফরজ।

কাফি খান যে খবরটি পড়বেন না বলে ফেলে গেলেন, বাংলা সুপারভাইজার তা নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য করলেন না। বিষয়টি তিনি চিফ নিউজ এডিটরের গোচরেও আনলেন না। গোচরে আনলেও চিফ নিউজ এডিটর যে কাফি খানের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কথা বলতেন না, সেটা নিশ্চিত করে বলা যায়। এর কারণ এই নয় যে কাফি খান একজন ডাকসাইটে ব্রডকাস্টার; এর কারণ এই যে তিনি তখন রাষ্ট্রপতির প্রেস সেক্রেটারি।
সকাল সাতটার বুলেটিন প্রচার হওয়ার পর কাফি কান চলে গেলেন, পরবর্তী বাংলা বুলেটিন সকাল নয়টায়। পাঁচ মিনিটের এই বুলেটিনের জন্য চারজন অনুবাদকের দরকার হয় না। দুজন অনুবাদক, সেই সঙ্গে রিপিট আইটেম কপি করার জন্য একজন কপিস্ট থাকলেই চলে। ফলে অন্যত্র চাকরি করেন এমন দুজন কপিস্ট থাকলেই চলে। ফলে অন্যত্র চাকরি করেন এমন দুজন অনুবাদক সাতটার বুলেটিন প্রচারের পর চলে যেতে পারেন। এ বিষয়ে একটি অলিখিত সমঝোতা আমাদের মধ্যে ছিল। সাতটার বুলেটিনের পর শাহবাগ বেতার ভবন থেকে বেরিয়ে রিকশা ধরি। গন্তব্য ধানমন্ডি লেকের পশ্চিম পাড়ে সোভিয়েত প্রেস ইনফরমেশন ডিপার্টমেন্ট। এডিটর অ্যান্ড ট্রান্সলেটর হিসেবে সেখানেই আমার মূল চাকরি।

সে সময় বাংলাদেশের মিডিয়া জগতের চেহারা ছিল অন্য রকম। রেডিও বলতে একমাত্র রেডিও বাংলাদেশ। বাংলাদেশ টেলিভিশন ছাড়া আর কোনো টিভি চ্যানেল ছিল না। কম্পিউটার মুঠোফোনের হাঁটি হাঁটি পা পা অবস্থা। সোশ্যাল মিডিয়া তখনো সিলিকন ভ্যালির গর্ভেই আসেনি। খবর পাওয়ার দ্রুততম মাধ্যম হিসেবে রেডিওর প্রতাপ অক্ষুণ্ন।

সোভিয়েত প্রেস ইনফরমেশন ডিপার্টমেন্ট অফিসের গেটে রিকশা থেকে নেমে দেখি অফিসের মূল দরজার কাছে ছোটখাটো জটলা। একজনের হাতে ট্রানজিস্টর রেডিও। কাছে যেতেই এক সহকর্মী জানালেন, রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে নিহত হয়েছেন।

১৯৮০ সালের ৩০ মে সকাল ৭টায় কাফি খান কি জানতেন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান আগের রাতে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে নিহত হয়েছেন? তাঁকে এ কথা জিজ্ঞেস করার সুযোগ হয়নি। তবে যুক্তি বলে: কাফি খান জানতেন। তাঁর পক্ষে জানাটাই স্বাভাবিক ছিল। রাষ্ট্রপতির সফরসঙ্গীদের কেউ তাঁকে ফোনে জানিয়ে থাকতে পারেন। তাঁকে জানাতে পারেন গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন। জানাতে পারেন ঢাকার মার্কিন দূতাবাসও।

ভয়েস অব আমেরিকার ব্রডকাস্টার এবং রাষ্ট্রপতির প্রেস সেক্রেটারি হিসেবে মার্কিন দূতাবাসের সঙ্গে নিশ্চয়ই তাঁর জানাশোনা ছিল। আর এ কথা কে না জানে, মার্কিন দূতাবাসের ইনফরমেশন ও কমিউনিকেশন নেটওয়ার্ক বাংলাদেশের গোয়েন্দা নেটওয়ার্কের চেয়ে অনেক বেশি আপ-টু-ডেট।

কাফি খান ঘটনাটি জানতেন না বিশ্বাসযোগ্য নয় এ কারণে যে রাষ্ট্রপতি জীবিত থাকলে তাঁর কোনো খবর এভাবে ছুড়ে ফেলতেন না। তবে এ কথা স্বীকার করতে হবে, এ রকম একটি খবর পেয়ে ভেতরে তিনি যতই উৎকণ্ঠিত থাকুন না কেন, তাঁর অভিব্যক্তিতে প্রকাশ ছিল না। তিনি ছিলেন নিস্পৃহ ও নির্বিকার।

সুমন রাহমান সাংবাদিক ও ব্রডকাস্টার, বর্তমানে কানাডা প্রবাসী