কেন ভালোবাসি বঙ্গবন্ধুকে

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

বেশ কয়েক বছর আগে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে আমার কারাবাসের আশঙ্কা সৃষ্টি হয়। বিভিন্ন সূত্রে খবর পেলাম, এবার আর রক্ষা নেই, কিছুদিনের জন্য হলেও কারাগারে যেতে হবে আমাকে। মনে মনে এর প্রস্তুতি নিতে গিয়ে ঘাবড়ে গেলাম। জেলে গেলে আমার ছোট বাচ্চাদের কী হবে। আমার স্ত্রী একা কীভাবে সামলাবে সব। তাদের ছাড়া দিনের পর দিন কীভাবে থাকব আমি। মুক্ত বাতাসে রিকশায় করে ঘোরা, রোদ বৃষ্টি আর আকাশকে অনুভব করা, কাজ শেষে সন্ধ্যায় অলস আনন্দে বিবিসি আর খেলা দেখা—জেলে এসব পাব কোথায়!

আমি তখন মাত্র বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ শেষ করেছি। তাঁর কথা মনে পড়ল। তাঁরও ছোট ছোট সন্তান ছিল একসময়, ছিল ভালোবাসার একটা সংসার। তাঁর সঙ্গে তাঁর সন্তানদের (বিশেষ করে দুই মেয়ে বা ছোট ছেলে) যেসব ছবি রয়েছে, তার প্রতিটিতে রয়েছে অপার স্নেহময় এক পিতার ছবি। তাদের ফেলে রেখে কীভাবে তিনি বছরের পর বছর থাকতেন জেলখানার চার দেয়ালের ভেতর? পুরো যৌবনকালের প্রায় সবটা সময় কীভাবে তিনি মেনে নিয়েছিলেন এমন দুঃসহ একাকিত্ব? কেন?

প্রথম দুটি প্রশ্নের উত্তর হয়তো আমরা জানি না। কিন্তু শেষ প্রশ্নটার উত্তর সবাই জানি। তিনি কারাগারে যেতেন দেশের মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য। নিজের সবকিছু উৎসর্গ করেছিলেন এই দেশটা আর তাঁর মানুষের জন্য। জেল তো ছিলই, আগরতলা মামলায় তার ফাঁসি হয়ে যাওয়াটাও অসম্ভব ছিল না। সব জেনেশুনে তিনি এমন ঝুঁকি নিয়েছেন, এভাবে নিজেকে বঞ্চিত করেছেন শুধু এই দেশটাকে ভালোবেসে! নিজের চেয়ে, নিজের পরিবারের চেয়ে এভাবে কি কোনো দিন দেশকে ভালোবাসতে পারব আমরা, আমি!

দুই

বঙ্গবন্ধুকে নানা কারণে ভালোবাসি আমি। ওপরের উপলব্ধি এর একটা দিক মাত্র। তাঁকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি আমাদের দেশটাকে তিনি স্বাধীন করেছেন বলে। তিনি ছয় দফা দেওয়ার আগে পাকিস্তানে আইয়ুব খান তাঁর শাসন মোটামুটি নির্বিঘ্ন করে ফেলেছিলেন। তাঁর সঙ্গে তাল মিলিয়ে তিনি এ অঞ্চলের অন্য বড় নেতাদের মতো পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী বা পাকিস্তান সরকারের মন্ত্রী হয়ে আরামদায়ক এক জীবন কাটাতে পারতেন। তিনি তা করেননি। বরং ১৯৬৬ সালের ছয় দফা ঘোষণার পর থেকে তিনি অবিশ্রান্ত, দুঃসাহসিক ও নায়কোচিত এক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মানুষের মনে মুক্তির দীপশিখা জ্বালিয়ে তোলেন। ১৯৭০ সালের পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে তাঁর একচ্ছত্র বিজয়ের মধ্যে তাই সুপ্ত ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা। তাঁরই ভাষায় সেটি উচ্চারিত হয় ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে।

বঙ্গবন্ধু ১৯৪৮ সাল থেকে তাঁর রাজনৈতিক যাত্রাপথে অভিভাবকত্ব (যেমন: সোহরাওয়ার্দী) পেয়েছেন, সুহৃদ পেয়েছেন (মাওলানা ভাসানী), পেয়েছেন সুযোগ্য সহচর (যেমন তাজউদ্দীন আহমেদ)। কিন্তু এককভাবে বিশেষ করে ১৯৬৯ সালের পর তিনিই হয়ে উঠেছিলেন বাংলাদেশের মানুষের স্বাধীনতা আর মুক্তির আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। গোপালগঞ্জের অজপাড়াগাঁয়ের এক দামাল কিশোরের এই উপাখ্যানের চেয়ে বড় বীরগাথা বাংলাদেশে আর নেই।

বঙ্গবন্ধু এতটাই বিশাল ও অনিবার্য ছিলেন যে তাঁর শারীরিক অনুপস্থিতিতে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করতে হয়েছিল তাঁরই নামে, প্রবাসী সরকারের রাষ্ট্রপতি করতে হয়েছিল অনুপস্থিত বঙ্গবন্ধুকেই। জিয়াউর রহমানের যে স্বাধীনতা ঘোষণা নিয়ে এত বিতর্ক করা হয়, সেটা তিনি জেনেবুঝে দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর নামেই। নিজে যখন পরে স্মৃতিচারণা করেছেন, বলেছেন, ৭ মার্চের ভাষণই ছিল তাঁর কাছে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়ার বার্তা।

বঙ্গবন্ধু আমাদের স্বাধীনতাসংগ্রামের স্থপতি এবং অবিসংবাদিত নেতা।

তিন

বঙ্গবন্ধুর প্রখর আত্মমর্যাদাবোধ আর দেশপ্রেমের পরিচয় আমরা শাসক হিসেবেও পাই। তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া ভারতীয় সৈন্যদের যেভাবে বাংলাদেশ ছেড়ে যেতে বলেছিলেন, যেভাবে ওআইসির সম্মেলনে গিয়েছিলেন, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীকে এ দেশে আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়ে এসেছিলেন। জাতিসংঘে বাংলায় যে ভাষণ দিয়েছিলেন, সিংহ হৃদয়ের নেতা না হলে তা সম্ভব ছিল না।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর গণতান্ত্রিক ও পরমতসহিষ্ণু রাজনীতির চর্চা করার মানসিকতাও তাঁর মধ্যে ছিল। এর প্রমাণ মেলে ১৯৭২ সালের গণপরিষদের বিতর্কে। মাত্র দুজন বিরোধীদলীয় নেতাকে (সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ও মানবেন্দ্র লারমা) বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন গণপরিষদ যেটুকু গুরুত্ব দিয়েছিল, বাংলাদেশে শতাধিক আসন পাওয়া বিরোধী দলের প্রতিও সে রকম আচরণ পরে কখনো করা হয়নি।

বঙ্গবন্ধু পরে কিছু ভুল করেছেন। বিশেষ করে সারা জীবন বহুদলীয় গণতন্ত্রের জন্য লড়ে কেন তিনি একদলীয় শাসনব্যবস্থা কায়েম করেছিলেন, এ নিয়ে তাঁর সমালোচনা হতেই পারে। কিন্তু পরিণত বয়েসে এসে আমার মনে হয়, কেন তিনি তা করেছিলেন, তা আমরা অনেকে সহানুভূতি নিয়ে বিচার করি না। বাকশাল কায়েম করার সময় সংসদে যে ভাষণ তিনি দিয়েছিলেন, তাতে মনে হয়, এক গভীর মনোবেদনা আর হতাশা থেকে তিনি এটি করেছিলেন। এই হতাশার বহু কারণ ছিল। তাঁর দলের কিছু মানুষ, তাঁর দল থেকে বের হয়ে যাওয়া কিছু মানুষ, অধৈর্য হয়ে ওঠা বহু মানুষ, আর কিছু পরাশক্তি মিলে তাঁর চলার পথকে কণ্টকাকীর্ণ করে তুলেছিল। সে সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন আর চীনের মডেলে একদলীয় সরকার পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছিল। তাঁর চীন সফরের ওপর বইটি পড়ে মনে হবে চীনের একদলভিত্তিক সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করে একে মানুষের জন্য কল্যাণকর মনে হয়েছিল তাঁর।

আমাদের সমস্যা হচ্ছে, আমাদের অনেকে বঙ্গবন্ধুকে ঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে পারি না। একদল তাঁর মূল্যায়ন করে স্তাবক বা পূজারির দৃষ্টিকোণ থেকে। আরেক দল প্রবল ক্রোধ নিয়ে। মুক্তমন নিয়ে দেখলে দেখা যাবে শাসক হিসেবে যেসব ভুল তিনি করেছেন, তা খুব অনভিপ্রেত হলেও, অস্বাভাবিক ছিল না তখনকার প্রেক্ষাপটে। নেতা হিসেবে যে মুক্তির দুয়ার তিনি খুলে দিয়েছিলেন, এ দেশের কোটি কোটি মানুষের জন্য, ৫০ বছরে যে যাত্রাপথের ভিত্তি তিনি গড়ে দিয়েছেন একটি জাতির জন্য, সে জন্য হলেও এমন ভালোবাসার দৃষ্টি আমাদের সবার থাকতে পারে।

বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আতিশয্য আছে এক শ্রেণির মানুষের মধ্যে। তারা বঙ্গবন্ধুকে বড় করতে গিয়ে অন্যদের ছোট করা আবশ্যকীয় ভাবেন। তাঁরা ভাবেন মাওলানা ভাসানী, তাজউদ্দীন আহমেদ, জেনারেল ওসমানী কিংবা জিয়াউর রহমানকে তাঁদের প্রাপ্য সম্মান দিলে বঙ্গবন্ধুর মাহাত্ম্য কমে যায়। শেষোক্ত জনকে নিয়ে অনেক তর্কবিতর্ক বিষয়টি আমরা জানি। কিন্তু এসব কারণে কেউ কেউ বঙ্গবন্ধুকেও প্রাপ্য সম্মান দিতে দ্বিধা করেন। আমার সবাই জানি, আমেরিকার স্বাধীনতাযুদ্ধে কী বিশাল ভূমিকা রেখেছিলেন জর্জ ওয়াশিংটন। কিন্তু মাউন্ট রাশমোরে তাঁর সঙ্গে অক্ষয় মূর্তি আছে পরের আরও তিনজন প্রেসিডেন্টের। তাতে কি ওয়াশিংটন ছোট হয়েছেন? হননি।

তেমনি অন্যদের সম্মান দিলে বঙ্গবন্ধুর কোনো সম্মানহানি হয় না। বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রাম বিনির্মাণে তিনি অবশ্যই প্রধান ব্যক্তি। এ সংগ্রামে তিনি যদি সূর্যের মতো কিছু হয়ে থাকেন, তাহলে তাঁকে ঘিরে অনেক গ্রহ ও উপগ্রহও ছিল। আমাদের অনেকে না পারে বঙ্গবন্ধুর সূর্যের মতো মহিমা তুলে ধরতে, না পারে অন্যদের ছাড়া তাঁর ইতিহাস যে অসম্পূর্ণ, তা উপলব্ধি করতে।

চার

বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসতে হলে আওয়ামী লীগের সব কর্মকাণ্ড মেনে নিতে হবে, এটিও ভুল ধারণা। বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসতে হলে শুধু একটা জিনিস প্রয়োজন, সেটি হচ্ছে, প্রকৃত দেশপ্রেম। এটি থাকলে আর বিবেক–বুদ্ধি থাকলে বঙ্গবন্ধুকে আমাদের সবার ভালোবাসা উচিত। তাঁর প্রতি সবার কৃতজ্ঞ থাকা উচিত।

আসিফ নজরুল: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক।