ছাত্রদের বাঁচাতে গুলির মুখে দাঁড়ান কোমলপ্রাণ শিক্ষক জোহা

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিক্ষুব্ধ ছাত্রদের পাকিস্তানি সেনাদের গুলি থেকে বাঁচাতে গিয়ে শহীদ হন ড. সৈয়দ মোহাম্মদ শামসুজ্জোহা।
ছবি : সংগৃহীত

১৯৬৯ সাল। দুই পাকিস্তানের জনগণই বুঝে গেল, ‘উন্নয়ন দশক’ উদ্‌যাপনের আড়ালে আইয়ুব খান মূলত একনায়কত্ব দীর্ঘস্থায়ী করতে চাইছেন। এর প্রতিবাদে পূর্ব ও পশ্চিম—দুই পাকিস্তানেই ক্ষোভে ফেটে পড়ল জনতা। বিশেষ করে ভারত ভাগের পর থেকেই অত্যাচার-নির্যাতন, সীমাহীন বৈষম্য ও এর পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধুর দেওয়া ছয়দফা প্রস্তাব পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে আইয়ুববিরোধী চলমান আন্দোলন ক্রমে অগ্নিমূর্তি ধারণ করতে থাকে। আইয়ুব খান আন্দোলন বানচাল করতে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অজুহাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করেন। এর প্রতিবাদে ঘটে গণ-অভ্যুত্থান। রাজপথে ছাত্রনেতা আসাদসহ অনেককে গুলি করে হত্যা করা হয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিক্ষুব্ধ ছাত্রদের পাকিস্তানি সেনাদের গুলি থেকে বাঁচাতে গিয়ে শহীদ হন ড. সৈয়দ মোহাম্মদ শামসুজ্জোহা।

ছাত্রদের বাঁচাতে গুলির মুখে নিজের বুক পেতে দেওয়ার মতো এমন ঘটনা ইতিহাসে বিরল। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর হলেও ছিলেন ছাত্রবান্ধব। একজন আদর্শ শিক্ষকের যে গুণাবলি থাকা দরকার, তার সবই ছিল ড. জোহার মধ্যে। তাই পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে প্রিয় শিক্ষকের মৃত্যু শুধু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাই নয়, মেনে নিতে পারেনি গোটা দেশের ছাত্র সমাজ।

তাঁর মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে সারা দেশেই বিক্ষুব্ধ ছাত্রজনতাকে রোখা কঠিন হয়ে পড়ে পাকিস্তানি সেনাদের। একপর্যায়ে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন আইয়ুব খান। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা তুলে নিয়ে শেখ মুজিবকে নিঃশর্ত মুক্তি দেওয়া হয়। রাজনীতিকদের মতে ‘ড. জোহার মৃত্যু আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনকে বেগবান করে, ফলে বাংলাদেশ অল্প সময়ের মধ্যে বিশ্ব মানচিত্রে স্থান করে নেয়।’

ড. জোহা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়নে বিএসসি ও এমএসসি শেষ করে সায়েন্স ল্যাবরেটরিতে কর্মজীবন শুরু করেন। কিছুদিন পর কেন্দ্রীয় সরকারের অধীন সমরাস্ত্র কারখানায় বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ পদে যোগ দিয়ে চলে যান পশ্চিম পাকিস্তানে। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের প্রতি শাসকগোষ্ঠীর বৈষম্যমূলক আচরণ কোনোভাবেই মানতে পারছিলেন না। শেষে চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে দেশে এসে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করে মানুষ গড়ার কাজে মনোনিবেশ করেন। মধ্যে দুই দফা বিলেত গিয়ে পিএইচডি ও ডিআইসি ডিগ্রি সম্পন্ন করে ফের কর্মক্ষেত্রে যোগ দেন। গবেষণা ও অধ্যাপনার পাশাপাশি বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে সরব উপস্থিতির মাধ্যমে অল্প দিনেই ছাত্র-শিক্ষকদের প্রিয়মুখে পরিণত হন তিনি।

ড. জোহা জীবন দিয়ে ছাত্রদের প্রতি একজন আদর্শ শিক্ষকের দায়িত্ববোধ বুঝিয়ে দিয়ে গেছেন। পাকিস্তানি সেনারা যখন বিক্ষুব্ধ ছাত্রদের প্রতি গুলি করতে উদ্যত হলো, তখন তিনি দৃঢ় কণ্ঠে ঘোষণা দিলেন ‘ছাত্রদের গায়ে গুলি লাগার আগে সেই গুলি আমার বুকে লাগবে।’ আদতে হলোও তাই। ছাত্রদের বাঁচাতে গিয়ে বুলেটের আঘাতে নিজের জীবন দিয়ে অনন্য নজির স্থাপন করে গেলেন।

রসায়ন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ও চেয়ারম্যান ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রক্টরের মতো বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিয়োজিত থাকায় ছাত্রদের সঙ্গে ড. জোহার সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এ রকম নানা চমকপ্রদ ঘটনাই জানা যায়।এক ছাত্র রসায়ন বিভাগে ভর্তি হতে এসে জানতে পারলেন দরখাস্ত জমা দেওয়ার সময় শেষ। এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় ভালো ফল থাকা সত্ত্বেও ভর্তি হতে না পেরে ছাত্রটি হতাশ মনে ছুটতে থাকলেন। বিভাগের এক ছাত্র তাকে অধ্যাপক জোহার সঙ্গে দেখা করতে বললেন। জোহা ভর্তি-ইচ্ছুক ছাত্রটির কথা মনযোগ দিয়ে শুনে তাকে ভর্তি নিতে বিভাগীয় প্রধানকে জোর করে ধরলেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পাওয়া সেই ছাত্রটি পরে ভালো ফল করে ঢাকায় উচ্চপদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন।

আরেক ছাত্র ব্যবহারিক পরীক্ষা চলাকালে জানালার বাইরে দাঁড়িয়ে এক পরীক্ষার্থীকে সহায়তা করছিলেন। বিভাগীয় প্রধান তাকে শাস্তি দিতে চাইলে জোহার কোমল হৃদয় লঘু পাপে গুরু দণ্ড দিতে সায় দেয়নি। তাই তাঁর অনুরোধে ছাত্রটির কাছ থেকে ভবিষ্যতে একই অপরাধ না করার প্রতিশ্রুতি নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়।

নরওয়ের অসলো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাওয়া সম্মানজনক পোস্ট ডক্টরাল ফেলোশিপের সুযোগ পেয়েও তা ফেরত দেওয়ার ঘটনাটি ছিল আরও চমকপ্রদ। সে সময় ভৌত শাখায় তিনি ছাড়া জ্যেষ্ঠ শিক্ষক কেউ ছিলেন না। জুনিয়রদের অনেকে উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। এ অবস্থায় ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াশোনায় ক্ষতির কথা ভেবে নরওয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত বাদ দেন তিনি। উল্টো উনসত্তরের সেই উত্তাল আন্দোলনের মধ্যেই প্রক্টরের মতো কঠিন দায়িত্ব কাঁধে নেন তিনি। এ দায়িত্ব পালনকালেই ক্যাম্পাস প্রাঙ্গণে ১৯৬৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে শাহাদত বরণ করেন।

আগের দিন পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে ঢাকায় ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে দেশজুড়ে ছাত্রজনতা রাস্তায় নেমে পড়ে। এ অবস্থা সামাল দিতে সামরিক জান্তা জারি করে সান্ধ্য আইন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা এ আইন ভেঙেই মিছিল নিয়ে শহরে যাওয়ার সিদ্ধান্তে ছিলেন দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। ওদিকে তাঁদের ঠেকাতে বন্দুক তাক করে রাখে পাকিস্তানি সেনারা। ড. জোহা ছাত্রদের নিবৃত্ত করতে জোর প্রচেষ্টা চালিয়েই ক্ষান্ত হননি, নিজের জীবনের মায়া ত্যাগ করে পাকিস্তানি সেনাদের কাছে গুলি না ছোড়ার অনুরোধ নিয়ে ছুটে যাচ্ছিলেন। কিন্তু তার আগেই গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। জোহার এই শাহাদতের খবর ছড়িয়ে পড়লে সারা দেশে আইয়ুববিরোধী আন্দোলন আরও বেগবান হয়।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকেরা তাঁর আদর্শকে লালন করে প্রতিবছর ১৮ ফেব্রুয়ারিতে ‘শিক্ষক দিবস’ পালন করছেন। কিন্তু স্বাধীনতাসংগ্রামে মোহাম্মদ শামসুজ্জোহার অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ‘স্বাধীনতা পদক’-এ ভূষিত করা এবং ১৮ ফেব্রুয়ারিকে ‘জাতীয় শিক্ষক দিবস’ হিসেবে ঘোষণা দেওয়ার দাবি রয়ে গেছে এখনো উপেক্ষিত।

ড. জোহা জীবন দিয়ে ছাত্রদের প্রতি একজন আদর্শ শিক্ষকের দায়িত্ববোধ বুঝিয়ে দিয়ে গেছেন। পাকিস্তানি সেনারা যখন বিক্ষুব্ধ ছাত্রদের প্রতি গুলি করতে উদ্যত হলো, তখন তিনি দৃঢ় কণ্ঠে ঘোষণা দিলেন ‘ছাত্রদের গায়ে গুলি লাগার আগে সেই গুলি আমার বুকে লাগবে।’ আদতে হলোও তাই। ছাত্রদের বাঁচাতে গিয়ে বুলেটের আঘাতে নিজের জীবন দিয়ে অনন্য নজির স্থাপন করে গেলেন।

আজকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র-শিক্ষকদের পারস্পরিক সম্পর্কের অবনতি ও অবিশ্বাস এবং প্রশাসনের সঙ্গে দূরত্বের অন্যতম কারণ ড. সৈয়দ মোহাম্মদ শামসুজ্জোহার মতো একজন আদর্শ শিক্ষকের অভাব।

মো. নজরুল ইসলাম, উপাচার্য, মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি ও অধ্যাপক (অব.), রসায়ন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়