ছোট ওস্তাদের প্রস্থান

ওস্তাদ শাহাদাত হোসেন খানছবি: সংগৃহীত


ঘণ্টার পর ঘণ্টা রেওয়াজ করছি প্রতিদিন। সপ্তাহের পর সপ্তাহ চলে যাচ্ছে। তবু ভৈরবীর গতে দ্রুতলয়ের কয়েকটি তান কিছুতেই আয়ত্তে আনতে পারছি না। গমকের কারুকাজে সমৃদ্ধ তানগুলো সত্যিই যেমন ব্যঞ্জনাময়, তেমনি কঠিন। দু–একবার ইনিয়ে-বিনিয়ে বলতে চেষ্টা করেছি আপাতত এই তানগুলো রেখে আমরা এগোতে পারি কি না। মিষ্টি হেসে আমার ছোট ওস্তাদ বলল, ‘আর কটা দিন চর্চা করেন, রপ্ত হয়ে যাবে। ওগুলো ছাড়া গৎটা পরিপূর্ণ হবে না।’
খুব আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছিলাম এরপর কোন রাগের তালিম আমার ছোট ওস্তাদ আমাকে দেবে। কয়েকবার মনে হয়েছে তাকে জিজ্ঞেস করি, এরপর নিজ থেকেই ইচ্ছাটাকে দমন করেছি; এ যেন পরিণত বয়সে নিজের সঙ্গেই নিজের এক খেলা।
এরই মধ্যে হঠাৎ করে ফোন পেলাম। অপর প্রান্ত থেকে ছোট ওস্তাদ বলছে, ‘আবরার ভাই, আপনার লেসনটা আমি পাঠাতে ভুলে গেছি, দু–এক দিনের মধ্যেই পাঠিয়ে দেব বাড়ি ফেরার পর।’ ‘বাড়ি ফেরার পর? তুমি কোথায়?’ আমার পাল্টা প্রশ্ন। ‘উত্তরার ক্রিসেন্ট হাসপাতালে, কোভিড আক্রান্ত।’ বুকটা ধক করে উঠল। আমার কোনো সাড়া না পেয়ে আশ্বস্ত করার জন্য বলল, ‘উপসর্গগুলো প্রশমিত হয়েছে, এর মধ্যেই আমাকে ছেড়ে দেবে।’

সত্তরের দশকের প্রথম থেকে এই গুণী মানুষটির সঙ্গে আমার পরিচয়। মতিঝিলের টিঅ্যান্ডটি কলোনিতে তার বাবা স্বনামধন্য সরোদশিল্পী ওস্তাদ আবেদ হোসেন খানের কাছে যখন আমি তালিম নিচ্ছি, পাশের ঘর থেকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে নিষ্ঠার সঙ্গে রেওয়াজ করে যাচ্ছে বালক শাহীন।

কিন্তু ছাড়া সে পায়নি। এই কথোপকথনের দিন দুয়েকের মধ্যে নিউমোনিয়া তার ফুসফুস দখল করে নেয়। কয়েক সপ্তাহ ধরে নিউমোনিয়া-কোভিডের সঙ্গে চলে তার যুদ্ধ। অবশেষে যুদ্ধে পরিশ্রান্ত আমার ছোট ওস্তাদের বাঁচার জন্য সব রসদ—লাখ লাখ টাকার ইনজেকশন, কোভিড নেগেটিভ রোগীর প্লাজমা, দেশি-বিদেশি চিকিৎসকদের পরামর্শ এবং আত্মীয়, পরিজন, ভক্ত, শিষ্যদের ভালোবাসাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে কোভিড তাকে ছিনিয়ে নিল। আইসিইউ থেকে আমার সঙ্গে শেষ আলাপে আক্ষেপের সঙ্গে জানিয়ে ছিল, ‘শেষ বাড়িটা আমার মাথায় পড়ল আবরার ভাই, ঠেকাতে পারলাম না।’ খুব জোরের সঙ্গে বলেছিলাম, ‘সব ঠিক হয়ে যাবে, চিন্তা কোরো না।’ কিন্তু শেষ রক্ষা আর হয়নি। শনিবার সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে আমার সংগীতগুরু ওস্তাদ শাহাদত হোসেন খান তার শেষযাত্রা শুরু করল মাত্র বাষট্টি বছর বয়সে।

সত্তরের দশকের প্রথম থেকে এই গুণী মানুষটির সঙ্গে আমার পরিচয়। মতিঝিলের টিঅ্যান্ডটি কলোনিতে তার বাবা স্বনামধন্য সরোদশিল্পী ওস্তাদ আবেদ হোসেন খানের কাছে যখন আমি তালিম নিচ্ছি, পাশের ঘর থেকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে নিষ্ঠার সঙ্গে রেওয়াজ করে যাচ্ছে বালক শাহীন।
দীক্ষার শুরুর দিকেই হঠাৎ বাসায় রেওয়াজ করার সময় সরোদের তার ছিঁড়ে যায়। আমার মাথায় যেন বাজ পড়ল। কীভাবে ওস্তাদজির সামনে দাঁড়াব? গাড়ি যথাস্থানে পার্ক করে ওস্তাদজির নজর এড়িয়ে শাহীনকে জানালাম আমার উৎকণ্ঠার কথা। তাতে কোনো পাত্তা না দিয়েই সে হেসে বলল, ‘বাজাতে গেলে তার তো ছিঁড়বেই। বাবাই লাগিয়ে দেবেন।’
এরপর কয়েক বছর ধরে আমরা গুরুভাই হিসেবে ওস্তাদজির তালিম নিয়েছি, ছোট ছোট ঘরোয়া অনুষ্ঠানে বাজিয়েছি। অন্যদের মধ্যে স্বপন আদনান ভাই এবং সালাহউদ্দিন আহমেদ ভাইসহ (পরবর্তী সময়ে অ্যাটর্নি জেনারেল) আমি সমবেত বাদ্য পরিবেশন করতাম, শাহীন করত একা। সবচেয়ে আনন্দের সময় কাটত তার চাচা বাহাদুর খান যখন ঢাকায় আসতেন। ওস্তাদজির নেক নজরে পড়া এ বান্দা ও শাহীন রেডিও-টেলিভিশন থেকে শুরু করে বিভিন্ন ঘরোয়া অনুষ্ঠানে প্রাণভরে বাহাদুর খান উৎসারিত শাস্ত্রীয় সংগীতরসে সিক্ত হতাম।

বিশ্ববিদ্যালয়–জীবনে ছাত্ররাজনীতি, লেখক শিবির ও মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ ও আইন সাহায্য কমিটির বিভিন্ন তৎপরতার সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় ক্রমেই আমার সংগীতচর্চায় ভাটা পড়ল। ওস্তাদজি ও শাহীনের সঙ্গে যোগাযোগ আস্তে আস্তে ক্ষীণ হলো।
ইতিমধ্যে ৪০-৪৫ বছর পার হয়ে গেছে। দু–একবার উদ্যোগ নিয়ে শাহীনের সঙ্গে যোগাযোগ করে সরোদ মেরামত করালেও নতুন করে শেখাটা শুরু হয়নি। বছর কয়েক আগে চার দশক বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি শেষে জীবনের অর্জনের দিকে ফিরে তাকানোর সময় নতুন করে সরোদ শেখার স্পৃহায় আমি এখনকার স্বনামধন্য ওস্তাদ শাহাদাত হোসেন খানের দ্বারস্থ হই। সাগ্রহে সে আমাকে তার ছাত্র হিসেবে গ্রহণ করতে সম্মত হয়। আমি তাকে ছোট ওস্তাদ হিসেবে ডাকা শুরু করি।
বয়েসে আমি পাঁচ–সাত বছরের বড় হলেও গুরু-শিষ্য সম্পর্কে কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি। চৌকস শিক্ষক ছিল সে। নিয়মিত সপ্তাহে এক দিন সন্ধ্যায় তার মালিবাগের ডেরায় সরোদ কাঁধে নিয়ে উপস্থিত হতাম। বলতে দ্বিধা নেই, গিটার বহনকারী তরুণের মতোই নিজেকে তখন মনে হতো। মিনিট পনেরো গল্পগুজবের পর সে প্রথমে আমার সরোদ কোলে নিয়ে টিউন করত। এরপর চলত ঘণ্টার পর ঘণ্টা পাঠদান। জিজ্ঞেস করতাম, এই কাঁচা হাতের বেসুরো বাজনা তার বিরক্তির উদ্রেক করে কি? সে জানিয়েছিল, এ হাতকে পাকানোই তো তার ব্রত।

আসলেই সংগীত শিক্ষাদানকে সে ব্রত হিসেবেই গ্রহণ করেছিল। বোধ করি আমার নিষ্ঠায় উৎসাহিত হয়ে সপ্তাহে এক দিনের পরিবর্তে দুই দিন তালিম শুরু হয়। গুরু-শিষ্যের এই চর্চাকে নিয়মিত রুটিন থেকে মুক্ত করে সে জানায়, ‘আবরার ভাই, যখনই মনে করবেন আপনি তৈরি, আমাকে ফোন দেবেন, আমরা বসে পড়ব।’ তাঁর শিষ্য এই ঔদার্যের সদ্ব্যবহার করতে দ্বিধা করেনি।
ছাত্রকে সময় দানে কার্পণ্য তাঁর ছিল না। তবে পাঠ আদায় করার ক্ষেত্রে সে ছিল চরম অনমনীয়। ২০–২৫ বার এক তান বাজানোর পরও অনুমতি পেতাম না পরের তানে যেতে। কখনো কখনো অভিব্যক্তিতে হতাশা ফুটে উঠলেও নাছোড়বান্দা ছিল গুরু; তার সাফকথা, বোল পরিষ্কার করতে হবে। এ যেন শ্বেতপাথরকে ঘষে ঘষে আপন ঔজ্জ্বল্যে প্রতিষ্ঠার চরম প্রয়াস। কখনো কখনো নরম গলায় বলত, ‘এখন পরিশ্রম করেন, পরে দেখবেন কেমন সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে এই বোলগুলো। খুব ভালো লাগবে।’
কোভিডের কারণে সরাসরি পাঠদান সম্ভব না হওয়ায় আমরা মেসেঞ্জার বা হোয়াটসঅ্যাপের শরণাপন্ন হলাম। ইলেকট্রনিক মাধ্যমে শাস্ত্রীয় সংগীতের পাঠদান তার পিতামহ আয়াত আলী খান কীভাবে গ্রহণ করতেন, তা আলোচনা করে দুজনই বেশ হেসেছিলাম।

তার প্রতিষ্ঠিত ওস্তাদ আয়াত আলী খান বিদ্যানিকেতনের মাত্র ২০ হাজার টাকার বার্ষিক সরকারি অনুদান যখন বন্ধ করে দেওয়া হয়, সে দুঃখ পেয়েছিল। কিন্তু আত্মসম্মানসম্পন্ন ব্যক্তি হিসেবে সে তদবির করে তা পুনর্বহাল করানোর কথা ভাবতে পারেনি।

শেষবারের মতো যখন আমরা বসেছিলাম ভৈরবীর আলাপে ও জোর আলাপে সে সন্তুষ্ট হয়েছিল, ‘চমৎকার হয়েছে, প্রফেশনালদের মতো বাজিয়েছেন।’ কথাগুলো আমার জন্য বিশাল প্রাপ্তি। সঙ্গে অবশ্য যোগ করেছিল, দ্রুত লয়টা আরও একটু চর্চা করতে হবে। আমাদের সেই পাঠদান তিন ঘণ্টা ছাড়িয়েছিল। শেষ সেই রাতে সুরের সাগরে দুজনে যেন অবগাহন করেছিলাম।
শাহীন ভিন্ন মাত্রার মানুষ ছিল। নির্দ্বিধায় অকালপ্রয়াত বোনের সন্তানের দায়িত্ব সে ও তার স্ত্রী পূরবী গ্রহণ করেছিল। অপার স্নেহে লালন করেছিল তার যমজ কন্যা এবং সুযোগ্য উত্তরসূরি রোকসানা ও আফসানাকে। তারা দুজনই এখন প্রতিষ্ঠিত আইনবিদ। বৃহত্তর পরিবারের স্বল্পবিত্ত আত্মীয়দের দেখভালের দায়িত্ব সে পালন করেছে। অসুস্থ সহশিল্পী ও সংস্কৃতিকর্মীদের জন্য যতটুকু করা সম্ভব, সে করেছে।
এই বন্ধুর কাছে নিজের হতাশা সে ব্যক্ত করেছে বিভিন্ন সময়ে। তার প্রতিষ্ঠিত ওস্তাদ আয়াত আলী খান বিদ্যানিকেতনের মাত্র ২০ হাজার টাকার বার্ষিক সরকারি অনুদান যখন বন্ধ করে দেওয়া হয়, সে দুঃখ পেয়েছিল। কিন্তু আত্মসম্মানসম্পন্ন ব্যক্তি হিসেবে সে তদবির করে তা পুনর্বহাল করানোর কথা ভাবতে পারেনি। ৩০–৩৫ বছরের চাকরিজীবন শেষে অবসর গ্রহণের বেশ কয়েক বছর পার হয়ে গেলেও বিভিন্ন ভাতা তার প্রাপ্য রয়ে গেছে। এ নিয়ে সে প্রতিবাদ করেছে, দাবি জানিয়েছে, তবে নিজের যশ বা সামাজিক সম্পর্কের সুযোগ গ্রহণ করে সহকর্মীদের বাদ দিয়ে একা তা ভোগ করার কথা চিন্তা করেনি। বিজেএমসিতে আজীবন চাকরি করা শাহীনের অভিযোগ ছিল, একদিকে ভিনদেশের, অন্যদিকে ব্যক্তি খাতের সুবিধার জন্য সুপরিকল্পিতভাবে দেশের পাটশিল্পকে ধ্বংস করা হচ্ছে।
সপ্তাহ কয়েক আগে জানাল, বিদেশে থাকা বন্ধুর করোনায় আক্রান্ত মাকে সে ক্রিসেন্ট হাসপাতালে ভর্তি করে তাঁর দেখাশোনার দায়িত্ব নিয়েছে। এ জন্য সে কয়েকবার ওই হাসপাতালে গিয়েছে। যখন জিজ্ঞেস করলাম, কেন এই দায়িত্ব নিজের ঘাড়ে নিয়েছে, এই অতিমারির সময় তার সোজাসাপ্টা উত্তর ছিল, ‘বন্ধুর মা তো আমারও মা।’ কে জানে আমার শঙ্কা যথার্থই ছিল কি না, তখনই কি আক্রান্ত হয়েছিল এই মরণব্যাধিতে?
পরিবারের শেষ চাওয়া ছিল সিএমএইচে তাকে ভর্তি করানো। বন্ধুবান্ধবকে নিয়ে অনেক চেষ্টা করেছি তাদের সেই ইচ্ছা পূরণ করতে, পারিনি। তাই নিজেকে সান্ত্বনা দেওয়ারও সুযোগ নেই। উত্তরার সেই ক্রিসেন্ট হাসপাতাল থেকেই শুরু হয় শাহীনের অনন্তের পথে যাত্রা।

এই বয়সে সংগীতকে ভিত্তি করে গড়ে ওঠা বন্ধুত্ব আমাকে নতুন জীবনের স্বাদ দিয়েছে। যে অনাবিল আনন্দের সময় দুজনে কাটিয়েছি, তা নানাভাবে প্রায় বাঁধনহীন অবসর জীবনকে নতুনভাবে বিন্যস্ত করেছিল, উর্বরতা দিয়েছিল এবং তাতে স্থিতি এনেছিল। এ যেন প্রাণবন্ত এক বন্দরে নতুন করে জীবনের নোঙর ফেলা। শাহীনের প্রয়াণ কেমন যেন সব এলোমেলো করে দিল।
আজ যখন তাকে শেষবারের মতো মিরপুরে শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে তাঁর প্রয়াত পিতার বুকের ওপরে শোয়ানোর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি, তখন খুব জানতে ইচ্ছা করছে, ‘ছোট ওস্তাদ, এরপর কোন রাগটি তুমি আমাকে শেখাতে?’

সি আর আবরার শিক্ষাবিদ এবং অভিবাসন ও মানবাধিকার বিষয়ক লেখক