ফিলিপ যদি আর দুটো মাস বাঁচতেন!

প্রিন্স ফিলিপ ও রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ

আর দুমাস বাঁচলেই প্রিন্স ফিলিপের বয়স এক শ বছর হতো। তখন ইংল্যান্ডের রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ—যিনি তাঁর স্ত্রীও, তিনি এ দেশের প্রথানুযায়ী তাঁর শতবর্ষজীবী স্বামীর জন্মদিবসের জন্য জন-শুভেচ্ছা বার্তা পাঠাতেন। এ প্রথা তিনি রানি হওয়ার পর থেকেই প্রায় ৭০ বছর ধরে চলছে। সে যত সাধারণ মানুষই হোন না কেন শতবর্ষ বেঁচে থাকার জন্য এদিন ডাকঘর থেকে তাঁর কাছে রানির চিঠি আসে। বাকিংহাম প্যালেস থেকে আসা সাদা মাখনের মতো সে খামের ওপরে থাকে অ্যাম্বুশ করা রানির মুকুটের সোনা রং ধোয়া ছবি। আমি জানি! ওই খাম দেখে আমারও হৃৎকম্প হয়েছিল। না আমার এক শ হয়নি। তবে আমি কেন পেয়েছিলাম তা বলছি একটু পরে। কারণ, তাতেই আমি প্রিন্স ফিলিপকে ওই বাকিংহাম প্যালেসেই অত্যন্ত কাছে থেকে দেখেছি। তাঁর পাশে ফিরোজা রঙের ড্রেস পরা রানিকে কত্ত ছোট আর নরম লাগছিল। মনে হচ্ছিল তিনি প্রায় আমার উচ্চতাসম্পন্ন। আরও মনে হয়েছিল, রানির কি বয়সের কারণে হাড় ক্ষয়ে ক্ষয়ে উচ্চতা কমে গেছে!

রাজবাড়ির মানুষের অনেক আয়ু হয়! এঁরা খান ভালো, অনিয়ম করেন না, পরেন ভালো, তাই বাঁচেন ভালো। তাঁদের হাড়–হাড্ডি, অন্ত্রতন্ত্র বদল হয়। রানিমাতা প্রথম এলিজাবেথ এক শ এক বছর বেঁচেছিলেন। নিয়ম ভঙ্গ করেছিলেন রানির ভগ্নি মার্গারেট, তিনি রানির ছোট বোন হয়েও আগেই মৃত্যুবরন করেন। ভেবেছিলাম আরও মাত্র দুমাস বাঁচলে ফিলিপ যখন রানির চিঠি পাবেন, সে ভারি মজার হবে। কিন্তু তা আর হলো না। রানির স্বামী গতকাল শুক্রবার সকালে রাজভবন উইন্ডসর ক্যাসলে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেছেন। এক মাস হাসপাতালে থাকার পর সেখানেই ফিরেছিলেন। বালমোরাল নয়, বাকিংহাম প্যালেস নয় তাঁর পছন্দ ছিল উইন্ডসোর। সেখানেই গেল তাঁর অন্তিম সময়।

তাঁর মৃত্যুর পর সেই থেকে সেই যে তাঁকে নিয়ে সবগুলো গণমাধ্যম মেতে আছে, তাতে আর থামাথামি নেই। এমনটা হওয়ারই কথা। তাঁর চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এক যুগের ইতি হলো। কয়েকটি প্রজন্ম তিনি একসঙ্গে দেখে গেছেন। রাজবাড়ির সবচেয়ে বড় বিপদ ও আনন্দ অবলোকন করে পরামর্শ দিয়েছেন। ৯৯ বছরের একজন মানুষ তার তো নানান অসুখ–বিসুখ থাকারই কথা। তাঁর সে রকম ছিল না, তিনি ভালোই ছিলেন। কোনো দিন হুইলচেয়ারে দেখিনি, দেখিনি লাঠি হাতে। ঋজু দেহধারী সাবেক নাবিক রাজা সেই প্রথম থেকেই এক শক্ত মানুষ।

প্রিন্স ফিলিপ গ্রিক আইল্যান্ডের কর্ফুতে জন্মগ্রহণ করেন। সে ছিল ১৯২১ সালের ১০ জুন। তাঁর জন্ম বংশধারা গ্রিস ও ডেনমার্কের, হেলেনের রাজা প্রথম জর্জের ছোট ছেলে। তাঁর মা প্রিন্সেস অ্যালিস ছিলেন লর্ড লুই মাউন্ট ব্যাটেনের মেয়ে, কুইন ভিক্টোরিয়ার নাতনি।

এদিকে রানি কুইন ভিক্টোরিয়ার নাতনি। সেদিক থেকে তাঁরা সম্পর্কে কাজিন ছিলেন। রাজবাড়িরই এক অনুষ্ঠানে তাঁদের প্রথম দেখা এবং ভালো লাগা। ১৯৪৭ সালে তাঁকে বিয়ে করার পর মাত্র পাঁচ বছর তিনি এলিজাবেথের সঙ্গে আর দশটা স্বামীর মতো সংসার করতে পেরেছিলেন। কিন্তু ১৯৫২ সালে হয়ে গেলেন ইংল্যান্ডের ‘রানির স্বামী’। বিশাল কোহিনূর বসানো মুকুট পরা স্ত্রীর পেছনে শত পারিষদ, তাদের হাতে হাতে সোনা–রুপার ঝান্ডা চলছে, তারই এক অনুষঙ্গ তিনি, আরও একখণ্ড অলংকার মাত্র। রাজ পরিবারে বিয়ে করলে এঁরা একটু সাম্রাজ্য পান। তিনিও পেলেন, হলেন ডিউক অব এডিনবরা। মরিয়া হয়ে সেখানে এডিনবরা বৃত্তি চালু করে একবার নজর কাড়লেন। আরেকবার বন্য প্রাণী রক্ষা নিয়ে কথাবার্তা তুলে নিজে খবর হলেন আর শেষবার ইরানে যুদ্ধরত ব্রিটিশ সৈনিকদের সঙ্গে একা দেখা করতে চলে গেলেন। ঢাকা পড়ল ডায়ানার কীর্তিকলাপ কি না, কে জানে!

প্রায় ৭০ বছর তাঁর প্রধান পরিচয় ছিল রানির চার সন্তানের পিতা ও সঙ্গী হিসেবে এবং সেটাই এখন ‘টক অব দ্য টাউন’। এমনকি ফিলিপ নাকি রানির শক্তি, রানির বল হয়ে এক অনুপম উদাহরণের সৃষ্টি করেছেন। তিনি নাকি রাজকীয় ডিউটিতে কষ্টকর সব ভারী পোশাক পরে সদা হাজির থেকেছেন। এমনকি কিছুদিন আগেই রানিও তাঁর বক্তৃতায় বলেছেন, ডিউক কীভাবে তাঁর সব কাজকর্মের পেছনে সাহায্য করেছেন। কথা হলো, এই পৃথিবীতে কত শত রানি তাঁদের রাজা মশাইয়ের পেছনে পেছনে একই কাজ করে করে মরে গেছেন, কিন্তু তা নিয়ে কোনো প্রশংসাবাক্য হয়নি, হয়নি কথা।

স্বামীর পেছনে অলংকারের মতো তাঁর স্ত্রীরই তো থাকারই কথা! বাইরে তাঁরা রানি হতে পারেন কিন্তু ছেলেমেয়ের দায়িত্ব রানিরই! আর সে রকম ঘটনায় আমরা জানিও না কাজটি কত কঠিন। একজন পুরুষ করেছে বলেই ঢোলে পড়েছে ঘা। বছরের পর বছর শত রকমের আচার–অনুষ্ঠানের বাধ্যবাধকতাই যে তাঁর জন্য ছিল প্রধান কাজ। এ নাকি এক বিরল গুণ! আমরা সবাই সেভাবেই তাঁকে দেখেছি। এমনকি রানির সুবর্ণজয়ন্তীতে নৌবিহারে নদীপাড়ে জমায়েত হওয়া শত শত মানুষকে হাত নেড়ে নেড়ে প্রায় আড়াই ঘণ্টা রানির পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। পরের দিন তাঁর খাটাখাটুনি উঠে গেল পত্রিকায়।
তাঁর বদ মেজাজ নিয়ে কত গল্প শুনেছি। যাহা রটে তাহা কিছু বটে। তিনি নাকি মাইকেল জ্যাকসনের পিতার মতোই মহা কড়া ছিলেন। পৌত্র–পৌত্রিদের কদাচিৎ কোলে নিলেও নিজ সন্তানকে নেননি। তাঁর প্রবল শাসনে কম্পমান যুবরাজ চার্লস কামিলাকে বিয়ে করতে পারেননি।

কামিলা তাঁর সঙ্গে গোপন সম্পর্ক রেখেছেন আর এদিকে ফিলিপের বকা খেয়ে ভয়ে ডায়ানাকে বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছেন চার্লস।

চীনে বেড়াতে গিয়ে ফিলিপ সে দেশের মানুষের চোখ ছোট ছোট বলে খবরের শিরোনাম হয়েছিলেন। আর আমাদের মতো এশিয়ানরা তাঁর চোখে ছিলেন বহিরাগত অভিবাসী! এটাও নিউজ থেকে জানি। তবে ১০ জন নাতি-নাতনি হলে পরে একটু নমনীয় হয়েছিলেন। আমি ভাবছি রানির কথা। রানি হোন আর নাই হোন। ফিলিপ ছিলেন তাঁরই স্বামী এবং রানি যে কত নরম তা আমি দেখেছিলাম।

২০১৩ সাল। ডাকবাক্স খুলে দেখি সোনালি মুকুট জলছাপে আমার নামে রানির চিঠি। বিলেতে বসবাসরত কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলো থেকে বাছাই করা শ খানেকের মধ্যে আমিও একজন। শিল্পী–সাহিত্যিক ও সৃষ্টিশীল মানুষদের বাকিংহাম প্যালেসে দাওয়াত। তাতে লেখা ছিল ‘দ্য মাস্টার অব দ্য হাউসহোল্ড হ্যাজ রিসিভড হার ম্যাজিস্ট্রস কম্যান্ড টু ইনভাইট মিসেস শামীম আজাদ টু আ কমনওয়েলথ রিসেপ্সহন টু বি গিভেন অ্যাট বাকিংহ্যাম প্যালেস বাই দ্য কুইন অ্যান্ড ডিউক অব এডিনবরা’। চিঠি পেয়ে যেমন মাথা খারাপ হয়েছিল, গিয়েও ভীষণ শিহরিত হয়েছিলাম। কারণ, আমি ভেবেছিলাম বিশাল এক হলে নামধাম দেখিয়ে বসব আর রানি এসে একটা বক্তৃতা দিয়ে চলে যাবেন। আমরা ফ্যা ফ্যা করে খুদ–কুড়া খাব।

কিন্তু তা হলো না। বরং হালকা স্ন্যাক্স ও পানীয়র পর দুই দফায় রাজা-রানি এবং চার্লস-কমিলা এ চারজনের সঙ্গে সাক্ষাৎ হলো। প্রথম দফায় আমাদের অভ্যাগতদের এক এক করে রাজকীয় চিৎকার সহযোগে লেজওয়ালা কালো কোট পরা একজন পরিচয় করিয়ে দিলেন-আমি স্বদেশের মহিমায়, বুকে ‘বাংলাদেশি অথার’ লেখা তকমা নিয়ে উদ্ভাসিত হয়ে ওঁদের চারজনের সঙ্গে করমর্দন করার, কথা বলার সুযোগ পেলাম। এ পর্ব শেষ হলে এবার তাঁরা তাঁদের ম্যান ইন ওয়েটিং বা লেডি ইন ওয়েটিংসহ ঘুরে ঘুরে সবার সঙ্গে গল্প করে গেলেন।

আমি রানির হাত ধরেছি তো ধরেছি। ছাড়াছাড়ি নেই। নরম, মাখনদলার মতো মানুষটির ছোঁয়ার মধ্যে থেকে প্রথম বলেছিলাম, ‘আমার অবিশ্বাস্য লাগছে যে আমি হে মহামান্য রানি, আমি সত্যি আপনার সঙ্গে এখন করমর্দনরত!’ তিনি মিষ্টি হাসলেন, হাত ছাড়ালেন না। বললেন, ‘সত্যিই তো...সত্যি...।’ এতে প্রিন্স ফিলিপ ঝুঁকে আমার নামটা বানান করে পড়ে ভুরু কুচকে বললেন, ‘বাংলাদেশের!’ —আমি বললাম, ‘জি’। তিনি একটি শব্দ করলেন, ‘অ!’ কিন্তু কথা চালিয়ে গেলাম মহামান্যার সঙ্গেই। ২০১২ অলিম্পিকের সমাপনীতে তিনি যে জেমস বন্ডের এক ভূমিকায় মুগ্ধ করা তিন মিনিট দিয়েছিলেন, সে প্রসঙ্গ এনে বললাম, ‘মাননীয়া, আপনিই আমার দেখা বেস্ট বন্ডগার্ল!’ রানি এবার বড় হাসি দিলেন। আমার প্রতি স্নেহার্দ্রতায় চোখেমুখে কৌতুক নিয়ে এলেন। এবার রাজা মশাই ওই উঁচু দেহ বেঁকিয়ে ঝুঁকে শুনতে এলেন রানি কেন হাসছেন। সেদিন তাঁদের দেখে একটা অদ্ভুত রসায়ন দেখলাম। যে রসায়ন পরস্পর বোঝাপড়া আছে তেমন স্ত্রী ও স্বামীর মধ্যেই থাকে। ডিউকের মৃত্যু সংবাদের পর শুধু রানির মায়াময় সেই কোমল অবয়বখানা মনে পড়ছে। মনে হচ্ছে ‘যার যায় তারই যায়’।

শামীম আজাদ কবি ও লেখক