বিদায়, বাংলাদেশ-দরদি পিটার হ্যাজেলহার্টস

আহমেদ খাতরাদার সঙ্গে পিটার হ্যাজেলহার্টস

স্বাধীনতার মাস মার্চেই চলে গেলেন বাংলাদেশ-দরদি বরেণ্য সাংবাদিক পিটার হ্যাজেলহার্টস। করোনায় আক্রান্ত হয়ে ৮৪ বছর বয়সে দক্ষিণ আফ্রিকায় নিজ বাড়িতে তাঁর মৃত্যু হয়। ১৯৭১ সালে যে কয়েকজন বিদেশি সাংবাদিক কাছে থেকে বাংলাদেশের যুদ্ধের সংবাদ সংগ্রহ করতেন, পিটার হ্যাজেলহার্টস ছিলেন তাঁদের অন্যতম।

সত্তরের নির্বাচনের সময় থেকেই পাকিস্তানের চলমান ঘটনাবলির ওপর নজর রাখছিল লন্ডন টাইমস। এ জন্য হ্যাজেলহার্টসকে বেশ কয়েকবার পাকিস্তানের পূর্ব ও পশ্চিম অংশে পাঠিয়েছিল তারা। কাছে থেকে দেখার সুবাদে আসন্ন সংকটের আভাস তিনি আগেই পেয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং জুলফিকার আলী ভুট্টো—উভয়ের সঙ্গেই সরাসরি কথা বলার সুযোগ তাঁর হয়েছিল।

নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশ হওয়ার পর দ্রুত ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবিতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে যে আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল, সে বিষয়ে ভুট্টোর কাছে জানতে চাইলে ভুট্টো তাঁকে বলেছিলেন, চায়ের কাপে ঝড় ছাড়া এ আর কিছু নয়। তিনি মনে করেন, সরকার একটু কঠোর হলেই আন্দোলনের দ্রুত সমাপ্তি ঘটবে। নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশের পর থেকেই পাকিস্তানি নেতৃত্ব যে ষড়যন্ত্র করছিল, তার আভাস দিয়ে এই সংবাদ টাইমস প্রকাশ করে। ফলে কোন পরিণতির দিকে যাচ্ছে বাংলাদেশ, সহজেই তা বুঝে নিতে পেরেছিলেন হ্যাজেলহার্টস। মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর পাঠানো প্রতিবেদনগুলো ছিল আমাদের ন্যায্য সংগ্রামের প্রতি সহানুভূতিশীল। ১৯৭১ সালের পুরো সময় লন্ডন টাইমস-এর পাঠকদের তিনি জানিয়ে গেছেন মুক্তিযুদ্ধের গতিপ্রকৃতি। এসব প্রতিবেদন তাঁকে এনে দিয়েছিল ব্রিটেনের বর্ষসেরা আন্তর্জাতিক প্রতিবেদকের পুরস্কার।

১৯৩৭ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার এক শ্বেতাঙ্গ পরিবারে পিটার হ্যাজেলহার্টসের জন্ম। তখন দেশজুড়ে চলছে কঠোর বর্ণবাদী ব্যবস্থা। অপেক্ষাকৃত অল্প বয়সে অনেকটা ঘটনাচক্রে সাংবাদিকতায় পিটারের হাতেখড়ি। ভিন্ন একটি বিষয়ে তাঁর পারদর্শিতার কারণে পঞ্চাশের দশকের শুরুর দিকে অল্পবয়সী পিটারের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার ইংরেজি সাপ্তাহিক সানডে এক্সপ্রেস-এর এক সাংবাদিক। সেই সূত্র ধরেই কয়েক বছর পর শিক্ষানবিশ রিপোর্টার হিসেবে এক্সপ্রেস-এ নিয়োগ পান পিটার।

১৯৬১ সালে নেলসন ম্যান্ডেলার কল্যাণে রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে ওঠেন পিটার হ্যাজেলহার্টস। তখনো আত্মগোপনে ম্যান্ডেলা। তাঁকে হন্যে হয়ে খুঁজছে দক্ষিণ আফ্রিকার গোয়েন্দা পুলিশ। সেই সময় আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের (এএনসি) নেতা আহমেদ খাতরাদা পত্রিকা অফিসে এসে জানতে চাইলেন, ম্যান্ডেলার সাক্ষাৎকার নেওয়ার মতো সাহসী ও বিশ্বাসযোগ্য কোনো সাংবাদিক আছেন কি না। রোমাঞ্চের গন্ধ পেয়ে তৎক্ষণাৎ রাজি হয়ে যান তরুণ পিটার। চোখ বেঁধে একটি গাড়িতে করে অজানা এক গন্তব্যে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়। একটি ঘরে নিয়ে চোখ খুলে দেওয়া হলে পিটার দেখতে পান, সামনেই চেয়ারে বসে আছেন ম্যান্ডেলা। দক্ষিণ আফ্রিকাজুড়ে তখন এএনসির সশস্ত্র সংগ্রাম দানা বেঁধে উঠেছে। শ্বেতাঙ্গদের মনে শঙ্কা, ক্ষমতায় গেলে দেশজুড়ে প্রতিশোধের রক্তগঙ্গা বইয়ে দেবে এএনসি। ম্যান্ডেলা চাচ্ছিলেন অমূলক সেই ভীতি যেন দূর হয়। সাক্ষাৎকারে তিনি পিটার হ্যাজেলহার্টসকে আশ্বস্ত করেছিলেন, এএনসি বিজয়ী হলে দেশে সহিংসতার কোনো জায়গা থাকবে না।

সানডে এক্সপ্রেসে ম্যান্ডেলার সেই সাক্ষাৎকার

সানডে এক্সপ্রেস-এ ম্যান্ডেলার সেই সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হলে দেশজুড়ে হইচই পড়ে যায়। ঐতিহাসিক এই সাক্ষাৎকার পিটারকে রাতারাতি বিখ্যাত করে দেয়, তাঁর পেছনে লাগে গোয়েন্দা পুলিশ। প্রশাসন ধরে নিয়েছিল, ম্যান্ডেলার গোপন অবস্থানের সন্ধান পিটার হ্যাজেলহার্টস তাদের দিতে পারবেন। দক্ষিণ আফ্রিকার গোয়েন্দা বিভাগের কুখ্যাত প্রধান স্পেংলার সাদাপোশাকের গোয়েন্দাদের পাঠিয়ে পিটারকে নিজ দপ্তরে তুলে এনে কয়েক ঘণ্টা ধরে জেরা করেন। নানা রকম ভয়ভীতি দেখিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলেও পিটারের জবাব ছিল একটাই, চোখ বাঁধা অবস্থায় নিয়ে গিয়ে আবারও চোখ বেঁধে ফেরত পাঠানো হয়। ফলে জায়গাটি কোথায়, সে সম্পর্কে কোনো ধারণাই তাঁর নেই।

সে যাত্রায় অল্পে ছাড়া পেলেও ১৯৬৬ সালে রোডেশিয়ার শ্বেতাঙ্গ শাসকদের বিরুদ্ধে আরোপিত আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘনে দক্ষিণ আফ্রিকার সরকার কীভাবে সাহায্য করে চলেছে, সে বিষয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশের দায়ে গোপনে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন পিটার। রাষ্ট্রহীন ব্যক্তি হিসেবে লন্ডনে টাইমস-এর কর্ণধার উইলিয়াম রিস মগের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। মগ তাঁকে পত্রিকার এশীয় সাংবাদিক নিয়োগ করেন। তাঁর ওপর ছিল পুরো মহাদেশের সংবাদ সংগ্রহের দায়িত্ব।

সেই থেকে এশিয়ার সঙ্গে পিটার হ্যাজেলহার্টসের সখ্য। ১৯৬৭ থেকে টানা ১৫ বছর টাইমস-এর হয়ে ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ ছাড়াও ভিয়েতনাম-কম্বোডিয়ার যুদ্ধের সংবাদ নিয়মিত পাঠিয়েছেন। ১৯৭৫ সালে সায়গনের পতনের সময় সেখানে ছিলেন। এশিয়ায় নিজের স্থায়ী ঘাঁটি হিসেবে টোকিওই ছিল তাঁর পছন্দের শহর। সেখানকার বিদেশি সাংবাদিকদের প্রেসক্লাব ছিল তাঁর স্থায়ী ঠিকানা। সেখান থেকেই নিয়মিত এশিয়ার নানা গন্তব্যে গেছেন।

১৯৮০-র দশকের শুরুতে লন্ডন টাইমস-এর মালিকানা রুপার্ট মারডকের হাতে চলে গেলে স্বাধীন সাংবাদিকতার সুযোগ সীমিত হয়ে যায়। ফলে টাইমস ছেড়ে সিঙ্গাপুর স্ট্রেইট টাইমস-এ যোগ দেন পিটার হ্যাজেলহার্টস, সেখানে কাজ করেন সাত বছর। ম্যান্ডেলার মুক্তির মধ্য দিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকায় পরিবর্তনের হাওয়া বইতে শুরু করলে ১৯৮৯ সালে নিজের দেশে ফিরে যান পিটার। জীবনের বাকিটা সেখানেই কাটিয়েছেন। পরিবর্তিত দক্ষিণ আফ্রিকায় সহিংসতার জায়গা থাকবে না, ১৯৬১ সালে সাক্ষাৎকারে এই বলে যে অঙ্গীকার ম্যান্ডেলা করেছিলেন, ২৭ বছরের কারাবাস সত্ত্বেও সেই অবস্থানে ম্যান্ডেলাকে অনড় দেখতে পারাটা ছিল পিটারের জন্য খুবই আনন্দময় এক অভিজ্ঞতা। মধ্যযুগের চীনা সমরনায়ক ওয়ান ইয়াং-মিনের একটি উক্তিকে তিনি সবার জন্য শিক্ষণীয় বলে মনে করতেন, ‘পাহাড়ে শত্রুর প্রাণ সংহার কঠিন কিছু নয়, বরং কঠিন হচ্ছে হৃদয়ে যে শত্রু বাসা বেঁধে আছে, তাকে বধ করা।’

১৯৭০ ও ১৯৮০-র দশকে খ্যাতির শীর্ষে উঠে যাওয়া এই সাংবাদিক এখন অনেকটাই বিস্মৃত। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গেও তাঁর নাম ইদানীং খুব একটা শোনা যায় না, যদিও লন্ডন টাইমস-এর জন্য পাঠানো প্রতিবেদনের অনেকগুলোই ছিল দৃষ্টান্তমূলক। মানুষ হিসেবেও ছিলেন জো স্লোভো এবং নাদিন গর্ডিমারের মতো অনুকরণযোগ্য শ্বেতাঙ্গ দক্ষিণ আফ্রিকান, এএনসির সঙ্গে যাদের ছিল হৃদয়ের সখ্য।

টোকিও, ৭ এপ্রিল ২০২১

মনজুরুল হক শিক্ষক ও সাংবাদিক