মোহাম্মদ ফরহাদের চিঠি থেকে: ‘কেউ কথা রাখেনি’

সমাবেশে মোহাম্মদ ফরহাদ
ছবি: সংগৃহীত

‘তেত্রিশ বছর কেটে গেল/কেউ কথা রাখেনি।’
না, এটা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতার ব্যর্থ প্রেমিকের আক্ষেপ নয়। একজন আকণ্ঠ বিপ্লবপিয়াসী মানুষের স্বপ্ন-সাধনার ব্যর্থতার জন্য আক্ষেপ। মানুষটি মোহাম্মদ ফরহাদ। ৯ অক্টোবর তাঁর মৃত্যুর ৩৩ বছর অতিক্রান্ত হবে। কিন্তু পরিবর্তিত পৃথিবীর কোথাও, কোনো দেশ এমনকি তাঁর নিজ মাতৃভূমি বাংলাদেশেও কোনো দল, ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান তাঁর স্বপ্ন রূপায়ণ করতে পারেনি। তিনি ছিলেন কমিউনিস্ট ভাবাদর্শে বিশ্বাসী আপাদমস্তক বিপ্লবী। কমরেড। তিনি সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন দেখতেন। বাংলাদেশে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করার জন্য ‘শ্রমিক শ্রেণির পার্টি’ কমিউনিস্ট পার্টিকে শক্তিশালী করাই ছিল তাঁর ব্রত। কিন্তু কেবল তাঁর নয়, সারা দুনিয়ার কমিউনিস্ট ও সমাজতন্ত্রকামীদের সেই স্বপ্ন এখন অলীক কল্পনা।

১৯৮৭ সালের ৯ অক্টোবর সোভিয়েত ইউনিয়নে চিকিৎসাধীন থাকাকালে মোহাম্মদ ফরহাদ শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন। আর তাঁর মৃত্যুর মাত্র চার বছরের মাথায় ১৯৯১ সালের ২৫ ডিসেম্বর সমাজতন্ত্র ও দুনিয়ার সর্বহারাদের তীর্থ সোভিয়েত ইউনিয়নের আনুষ্ঠানিক অবলুপ্তি ঘটে।

১৯৮৭ সালের ৭-১১ এপ্রিল বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) চতুর্থ কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। মোহাম্মদ ফরহাদ তৃতীয়বারের জন্য সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। তাঁর সেই প্রিয় পার্টি রাজনৈতিক ভাবাদর্শগত পার্থক্যের জন্য ১৯৯৩ সালের জুন মাসে ভেঙে যায়। সংখ্যাগুরু অংশটি পার্টির তৎকালীন সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক সাইফউদ্দিন আহমেদ মানিক ও নুরুল ইসলাম নাহিদের নেতৃত্বে ‘রূপান্তরিত পার্টি’ গড়ার লক্ষ্যে ধ্রুপদি কমিউনিজম ত্যাগ করে। সংখ্যালঘু অর্থোডক্স অংশটি পুরোনো ধারায় সিপিবির পুনর্গঠনের চেষ্টা করে।

তারা তৃতীয় শক্তির কথা বলে অতীতের চীনপন্থীদের পরিত্যক্ত লাইনে শিফট করে বাগাড়ম্বরপূর্ণ তথাকথিত ‘স্বাধীন লাইন’ ধরেছে। ভুলে গেছে মোহাম্মদ ফরহাদের আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঐক্য ও সংগ্রামের পথ। আওয়ামী লীগকে তারা প্রতিপক্ষ ভেবে আওয়ামী লীগবিরোধী কোরাসে শামিল হয়েছে। অনেকেই বলে থাকেন, মোহাম্মদ ফরহাদ বেঁচে থাকলে পার্টিকে যেমন ভাঙতে দিতেন না, তেমনি মূলধারা থেকে দলকে বিচ্ছিন্নও হতে দিতেন না।

মোহাম্মদ ফরহাদ যেমন দৃঢ়ভাবে মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদের বিশ্বাসী ছিলেন, তেমনি বাংলাদেশের জাতীয় বাস্তবতাকেও সম্যকভাবে উপলব্ধি করতেন। তাঁর মধ্যে সৃজনশীলতার আবেগ থাকলেও অর্থোডক্স বা পুরোনো ঐতিহ্যপন্থী ভাবধারা ছিল না। বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর ভাবনার কিছু অংশ আমরা এখানে উদ্ধৃত করছি। কারাগার থেকে, আত্মগোপন অবস্থায় থেকে মস্কো থেকে স্ত্রী রাশেদা খানম রীনার কাছে লেখা ব্যক্তিগত চিঠিগুলোতে নানা রাজনৈতিক ও তাত্ত্বিক বিষয়ে তিনি নিজের অভিমত প্রকাশ করেছেন। আমরা ব্যক্তিগত প্রসঙ্গগুলো বাদ দিয়ে জগৎ ও জীবন সম্পর্কে তাঁর উপলব্ধির কয়েকটি উদ্ধৃতি এখানে তুলে ধরছি।

১৯৭৫ সালের ৮ সেপ্টেম্বর আত্মগোপন থেকে তিনি স্ত্রীর কাছে লেখা চিঠিতে মানব সভ্যতা সম্পর্কে বলেছেন:‘আসলে দুনিয়ার বেশির ভাগ জায়গায় মানবতা,Ñপ্রকৃত সভ্যতা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। কার্ল মার্ক্স সত্য কথাই বলেছিলেন যে সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত “মানবজাতি বসবাস করছে প্রাগ্-ঐতিহাসিক যুগে।”...আজও চলছে হানাহানি। বিভ্রান্ত মানুষ যদি একবার বুঝত, গা ঝাড়া দিয়ে বলত “মা”। কিন্তু অত সহজে বলবে না। পথের ভিখিরিও সম্পত্তির অধিকার রক্ষার দাবিতে কলকারখানার মালিকের পক্ষে দাঁড়াবে। আমাদের মত, পথ আর কাজ খুব কঠিন।’

নতুন প্রজন্মকে বিশেষত শিশুদের কেমন করে গড়ে তুলতে হবে, নিজ শিশুপুত্র সুমিত সম্পর্কে স্ত্রীকে লেখা চিঠিতে তিনি যা বলেছেন, তা যেমন কৌতূহলোদ্দীপক তেমনি শিক্ষণীয়। ‘বাবার কথা (পুত্র সুমিত) লিখেছ, বাবা আমাকে ফিল করে। ছোট্ট বাচ্চা! বাট ইট ইজ দা স্টার্টিং অব হিস রেভল্যুশনারি ট্রেইনিং। তুমি বাবাকে লেনিন, সোভিয়েত বিপ্লব ইত্যাদি শেখাবে। দেবু, তপু অনেক কথা জানে। ওরা দু’ ভাই এই পরিবেশেই মানুষ হচ্ছে। আমার খুব ভালো লাগে। আমার খুব ইচ্ছে যে আমার ছেলেও ও রকম শিক্ষা লাভ করুক। হি শুড বি সফট টু পিপল, অনেস্ট, হার্ড আর্নেস্ট, ফেইথফুল, ডিপ ইন থিংকিং, সিনসিয়ার ইন পারপাস, ডেভোটেড অ্যান্ড প্যাট্রিয়ট। তুমি লক্ষ রাখবে যেন বিলাসিতার দিকে না যায়।

সন্তানদের প্রতি স্নেহশীল কর্তব্যপরায়ণ পিতা মোহাম্মদ ফরহাদ চেয়েছিলেন তাঁর ছেলে রেভল্যুশনারি ট্রেইনিং নিক, সেও হয়ে উঠুক বিপ্লবী। কিন্তু সে বিপ্লবের পথে যায়নি। দুটো ছেলেমেয়েই উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেছে পিতার অবর্তমানে; কোনো মালিন্য ওদের স্পর্শ করেনি। কিন্তু মোহাম্মদ ফরহাদের আশা অনুযায়ী কেউই রাজনীতি করছে না। কেউই বিপ্লবী হয়নি। ওরা যদিও বাবার কাছে অঙ্গীকারবদ্ধ ছিল না, কিন্তু বাবার পথে যায়নি।


মোহাম্মদ ফরহাদের একদার প্রিয় শিষ্য কমরেড মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বর্তমানে সিপিবির সভাপতি। তিনি বা তাঁরা ‘তৃতীয় শক্তি’ আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বিকল্প হিসেবে রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়ার চিন্তা করছেন। দুনিয়া ও দেশের বাস্তবতার কথা বিবেচনা না করে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাচ্যুত করার সংগ্রামের লাইন নিয়েছেন। তাঁরা আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে কার্যত এক পাল্লায় মাপছেন। আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঐক্যের তাঁরা ঘোরতর বিরোধী। ভারতেও সিপিআই একসময় ইন্দিরা গান্ধী ও কংগ্রেসের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে তৃতীয় শক্তি বা বাম বিকল্প গড়ে তুলতে চেয়েছিল। ১৯৭৬ সালের ২৮ ডিসেম্বর স্ত্রীকে লেখা এক দীর্ঘ চিঠিতে মোহাম্মদ ফরহাদ এ প্রসঙ্গে লিখেছেন: ‘তোমার মনে আছে, ’৭৪-এর দুর্ভিক্ষের সময় আমরা স্লোগান দিয়েছিলাম “ব্যর্থ সরকার বাতিল করো, সৎ দক্ষ সরকার কায়েম করো।” পার্টিকুলারলি দা স্লোগান ওয়াজ অ্যাগেইনস্ট করাপ্ট আওয়ামী লীগ। কিন্তু মুজিবকে ওরা আমাদের বিরুদ্ধে নিতে পারে নাই। যদিও অনেক চেষ্টা তাঁরা করেছিল। কিন্তু ভারতে সেটা হলো না। নাউ মিসেস ইন্দিরা ইজ ফাইটিং অ্যাগেইনস্ট সিপিআই ফর দা কজ অব রাইটিস্ট কংগ্রেস। আর রিঅ্যাকশন অ্যান্ড রাইটিস্ট কংগ্রেস বগল বাজাচ্ছে, আরও উসকানি দিচ্ছে, এই লাইন মডিফিকেশন করছে, ইত্যাদি। দিস ইজ ডেঞ্জারাস। আবার অনেকেই সিপিআইকে বাহবা দেবে—তার মানে বিচ্ছেদ মেনটেইন করার পরামর্শ দেবে। বাট ইন ইন্ডিয়া টাইম হ্যাজ নট কাম ফর সিপিআই অন গিভেন আ কল ফর পাওয়ার টেকওভার বাই ওয়ার্কিং ক্লাস। সিচুয়েশন হ্যাজ নট ইয়েট ডেভেলপড, অবজেকটিভলি অ্যান্ড সাবজেকটিভলি ফর সাচ রেভল্যুশনারি কল। এ অবস্থায় অ্যান্টি-ইমপেরিয়ালিস্ট ইন্ডিয়ার সঙ্গে বিভেদ মানে প্রো-ইমপেরিয়ালিস্টদের লাভ। তার মানে অবশ্য এই নয় যে সিপিআই শুড নট ফাইট অ্যাগেইনস্ট দা নেগেটিভ অ্যাসপেক্টস অব দা গভর্নমেন্ট, মিসেস গান্ধী অ্যান্ড কংগ্রেস। কিন্তু তার মেথড কারেক্টলি বের করতে হবে, যেন রিঅ্যাকশনারি ফোর্স মিসেস গান্ধীকে ইউজ করতে না পারে অ্যাগেইনস্ট সিপিআই অর আদার প্রগ্রেসিভ ফোর্সেস। মিসেস গান্ধী চিত হলে এশিয়াতে কী হবে? কমিউনিস্টস মাস্ট অলসো কনসিডার ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারেস্টস। কেবল বাহবা ও ভোট লাভের পার্টি নয় সিপিআই। আমার ধারণা, অধৈর্য হয়ে এমন কিছু স্লোগান দিয়ে ফেলেছে, যা হয়তো একটু লেফট। ঘটনাটা সিমিলার টু দ্যাট ইভেন্ট অব বাংলাদেশ—ফার্স্ট জানুয়ারি সেভেনটি থ্রি। তোমাদের ভিয়েতনাম মিছিলে গুলি আর পরদিন পল্টন মাঠে স্পিচ...ফলে দ্বন্দ্ব। আমরা সামাল দিয়েছিলাম সত্য, বাট অ্যাট দা কস্ট অব সাম অ্যামাউন্ট অব পপুলারিটি অব বিএসইউ (বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন)।...মুজিব যখন ছিল মেনি অব আস ওয়্যার ভেরি ক্রিটিক্যাল অ্যাবাউট হিম অ্যান্ড আওয়ামী লীগ। আর আজকে?’

জাতীয় মূলধারার নেতা ও রাজনৈতিক দল সম্পর্কে মোহাম্মদ ফরহাদের এই দৃষ্টিভঙ্গি এখনো প্রাসঙ্গিক। আমরা কথাটা একটু ঘুরিয়ে বলি, যদিও এখন ’৭৬ সাল নয়, তবু আওয়ামী লীগ সম্পর্কে, শেখ হাসিনা সম্পর্কে কি একই দৃষ্টিভঙ্গি প্রযোজ্য নয়? আজ যদি আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না থাকে এবং শেখ হাসিনা দৃশ্যপট থেকে অপসৃত হন, তাহলে কী হবে। সিপিবি ও বামেরা কি ক্ষমতায় যেতে পারবে? মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অসাম্প্রদায়িক এমন কোনো দল বা নেতা আছেন কি, যাঁরা দেশকে প্রগতির ধারায় এগিয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম? সিপিবির সভাপতি ডাকসুর সহসভাপতি হিসেবে ১৯৭৩ সালের ২ জানুয়ারি পল্টনে যে ‘স্পিচ’ দিয়েছিলেন, তিনি কার্যত এখনো সেখানেই অবস্থান করছেন। কিন্তু এ জন্য মূল্য দেবে কে? না, মোহাম্মদ ফরহাদ এখানেও তাঁর তথাকথিত রাজনৈতিক উত্তরাধিকারীদের দ্বারা বঞ্চিত। তাঁরা কেউ তাঁর নীতি-কৌশল অনুসরণ করছেন না।

মোহাম্মদ ফরহাদ
ছবি: সংগৃহীত

আর যারা আমার মতো কমিউনিস্ট পার্টি ছেড়েছি, তারা সোভিয়েত ও সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা ভেঙে যাওয়ার পর, ইতিহাসের স্বপ্নভঙ্গের দ্বারা প্রভাবিত। আমাদের মতো বিভিন্ন দেশের বড় বড় কমিউনিস্ট পার্টির হাজার হাজার নেতা-কর্মী ওই পথ পরিত্যাগ করেছেন। এটা একটা নতুন প্রপঞ্চ। আমরা তো বিপ্লবের পথ, শ্রমিকশ্রেণির আধিপত্যের পথ এবং এই যুগ ‘সমাজতন্ত্র থেকে কমিউনিজমে উত্তরণের যুগ’—এই বিশ্বাস আর লালন করি না। পুঁজিবাদ মরণোন্মুখ—এই তত্ত্বে বিশ্বাস করি না। আমরাও এক অর্থে তাঁর কথা রাখিনি।

বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে মোহাম্মদ ফরহাদের মূল্যবান দৃষ্টিভঙ্গিও তিনি একাধিক চিঠিতে লিখেছেন। ১৯৭৭ সালে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী মোহাম্মদ ফরহাদ স্ত্রী রাশেদা খানমের এক চিঠির জবাবে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা করে লিখেছিলেন, ‘‘শেখ মুজিব বাংলাদেশে ‘শোষিতের গণতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার পথ ধরেছিলেন। এই পার্থক্য সম্ভব হয়েছে দুই দেশের দুই ভিন্ন সোশিও-ইকোনমিক অবজেকটিভ কন্ডিশনের জন্য। মুজিবের বৈশিষ্ট্য এই যে সে পুঁজিবাদের দিকে ঝুঁকে পড়ে নাই। অথচ এক অর্থে সেটাই সহজ কাজ ছিল। কিন্তু সেটা না করার জন্য দেশি-বিদেশি প্রতিক্রিয়ার হাতে তাকে সপরিবারে জীবন দিতে হলো।’‘

লেখাটা শেষ করব অন্য রকম এক ফরহাদের কথা বলে। আপাতদৃষ্টে মোহাম্মদ ফরহাদ ছিলেন একজন নিরাবেগ কঠোর স্বভাবের ‘কমিউনিস্ট বিপ্লবী’। কিন্তু তাঁর ভেতরের মানুষটা ভীষণ রোমান্টিক ও আবেগপ্রবণ। দেশমাতৃকার প্রতি তাঁর ছিল গভীর আবেগ ও মমত্ববোধ। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বসে লেখা এক স্মৃতিচারণামূলক দীর্ঘ চিঠিতে তার পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি লিখেছেন, ‘আমি অবশ্য ভালোবেসে ফেলেছি পূর্ব বাংলা, বারো ভূঁইয়ার বাংলা। নদী, উদ্দাম গাঙ আর খালবিল। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ীর বেশে ১৭ই ডিসেম্বর যখন মতিয়াকে সাথে নিয়ে কলকাতা থেকে রওনা হই আগরতলা ঘুরে সড়কপথে রিকশায়-বেবিতে, যখন গুমতি পেরিয়ে মেঘনা আর ধলেশ্বরী শীতলক্ষ্যার পাড়ে পাড়ে, নৌকার আশায় ঘুরছিলাম, আহা... সে যে কি শান্তি! নদীর স্বচ্ছ নীল পানি—আমার প্রেমিকার (কল্পনায়) চোখের মতো। হৃদয়ের আবেগ। বাংলার নদী আর নারী। বাংলা মা আমার, বাংলা প্রেয়সী আমার। পদ্মা মেঘনা যমুনা...আর মধুমতি।

বন্যার ত্রাণ কার্যক্রমে মোহাম্মদ ফরহাদ
ছবি: সংগৃহীত


‘... অনেকদিন আগে ’৬৬ সালে মোটর বোটে করে করে ঘোরার সময় মধুমতি নদীতে যশোরের লোহাগড়ার কাছে দেখেছিলাম এক কিশোরী তরুণীকে। ফর্সা গায়ে লেপ্টে ছিল শাড়ি। কানে বড় রিং। উন্নত বক্ষ।...হাতে ছিল দূরবীন। রবি ঠাকুরের ‘বিজয়িনী’...। প্রকৃতির কাছে পাঠ নিয়েছিলাম সেদিন।...’

অসাধারণ কাব্যিক বর্ণনা। দেশমাতৃকাকে ‘মা’ হিসেবে, প্রেয়সী হিসেবে কজন আবিষ্কার করতে পারে। মোহাম্মদ ফরহাদ বিপ্লবীই কেবল ছিলেন না, কবিও ছিলেন। কবি এবং বিপ্লবী। লিখেছেন,‘বাংলার মানুষের চরিত্রের বৈশিষ্ট্য ও আবেগ—যা ভাঙে আবার গড়েও। আমাদের চরিত্রে আছে নদীর স্বভাব। খেলে জোয়ার-ভাটা। মানুষ হলো পানির জীব। প্রাণের জন্ম পানিতে। রক্তের কম্পোজিশন আর সাগরের লোনা পানির মৌলিকত্ব অভিন্ন। আর বাংলাদেশ—পদ্মা-মেঘনা-যমুনা-মধুমতি। আর আজ রাতে আমার আবেগ। হৃদয়ের আবেগ। দুঃখ আমি কবি নই, কবি হলে—।
অতঃপর বিপ্লবীর কলমে স্বরচিত কবিতার পঙ্‌ক্তিমালা।
‘মধুমতির পাড়ে...
পুরোনো অশ্বত্থের ছায়া...
দূরে ধানসিঁড়ি ভেঙে
কৃষাণী আসে ডুরি শাড়ি পরে
মেহনতি পুরুষের শ্রমে আর
ক্লান্তির ভার দূরে ঠেলে
দিত—তাকিয়ে আছি
সেদিকে সেদিনের পানে।’
মোহাম্মদ ফরহাদ আমাদের কালের নায়ক। কবি এবং প্রেমিক। প্রেমিক এবং বিপ্লবী। নিজের বয়ানেই লিখেছেন: ‘আমার নাম “ফরহাদ”। বিশ্ববাসী হাজার বছর ধরে আমার নাম জানে এক তরুণীর প্রেমে মাতাল হিসেবে। তাই আমার মৃত্যু নাই। হাজার বছর ধরে আমি বেঁচে আছি...। থাকব।’
প্রতীকী হলেও এই কথাগুলো সূর্যের মতো সত্য। ১৯৬২ সাল থেকে মৃত্যুর আগপর্যন্ত বাংলাদেশের সকল ছাত্র ও গণ-আন্দোলনে, মেহনতি মানুষের সংগ্রামে, মূলধারার সঙ্গে ঐক্য ও সংগ্রামের নীতিতে মোহাম্মদ ফরহাদের ভূমিকা ও অবদান চিরভাস্বর হয়ে থাকবে। বাংলাদেশের ইতিহাস থেকে কেউই তাঁর নাম মুছে ফেলতে পারবে না। মোহাম্মদ ফরহাদ চিরঞ্জীব। তাঁর প্রতি নমিত শ্রদ্ধা।

* নূহ-উল-আলম লেনিন: আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সাবেক সদস্য।