সাইমন ড্রিং: বাংলাদেশের বন্ধু অকৃত্রিম

সাইমন ড্রিং

একটি বিদায়–সন্ধ্যা দিয়েই লেখাটি শুরু করি। স্থান মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। একজন বিদেশি বাঙালিকে সেদিন বিদায় জানানো হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের প্রারম্ভিক কালে এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে পাকিস্তানি হানাদার ও দখলদার বাহিনী ঢাকার হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল থেকে বেশ কিছু বিদেশি সাংবাদিককে পিআইএ বিমানযোগে করাচিতে পাঠানো হয়। সেখান থেকে সেনাবাহিনীর মর্জিমতো তাঁরা স্বদেশে ফিরতে পারবেন, সেই দলে ছিলেন ২৫ বছরের তরুণ এক ইংরেজ সাংবাদিক।

মার্চ মাসের প্রথম থেকেই এই সাংবাদিক সংবাদ সংগ্রহের জন্য ঢাকায় অবস্থান করছিলেন এবং ছবি তুলছিলেন অবিরাম। কিছু ছবি হয়তো প্রিন্ট করতে পেরেছিলেন, কিছু ছবি ছিল একেবারেই নেগেটিভে। নানা কৌশলে ছবিগুলো লুকিয়ে রওনা দিলেন। করাচি বিমানবন্দরেই শুরু হলো তল্লাশি। সাংবাদিকের কৌশলের কাছে হার মানল সেনাবাহিনীর তল্লাশি দল। অবশেষে ছাড়া পেয়ে লন্ডনের পথে রওনা হলেন। লন্ডনের বিখ্যাত পত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকে ঢাকায় ২৫ মার্চ রাত থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংসতার প্রতিবেদন ও ছবি। কেঁপে উঠল বিশ্ব বিবেক। ১ মার্চ থেকেও কী ঘটেছিল, তা প্রকাশ পেতে থাকে। এই সাহসী সাংবাদিকের নাম সাইমন ড্রিং।

এই সাংবাদিককে আবার দেখা গেল বাংলাদেশে প্রায় দুই যুগ পরে। এবার তাঁর ভিন্ন কাজ। একটি আধুনিক টেলিভিশনের স্থপতি হিসেবে। ভাষা আন্দোলনের গৌরবমণ্ডিত ২১ ফেব্রুয়ারিকে সামনে রেখে এই চ্যানেলের অগ্রযাত্রা। এই চ্যানেলের উদ্যোক্তা একজন স্বপ্নচারী সুরুচিসম্পন্ন মানুষ এস এ মাহমুদের প্রেরণায় একদল তরুণ সৃজনশীল কর্মীকে নিয়ে সাইমন ড্রিং শুরু করলেন পথচলা। একুশের এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সূচনা হলো বিশাল কর্মকাণ্ড। প্রশিক্ষণ, গবেষণা, বিপণন—সব ক্ষেত্রে। অবশেষে দীর্ঘ প্রস্তুতির পর ২০০০ সালের ১৪ এপ্রিল শুভ নববর্ষে উদ্বোধন হয়ে গেল একুশে টিভি। প্রচারে এসেই তাক লাগিয়ে দিল সবাইকে। সংবাদ পরিবেশনের অভিনবত্বে একটি আন্তর্জাতিক মান অর্জন করল প্রথমেই। তারপর অনুষ্ঠান বৈচিত্র্যেও সর্বত্রই নতুনত্বের ছাপ। যথাযথই একুশে এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ।

দুই বছরে চ্যানেলটি সবার মন জয় করে যখন সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে, তখনই বিএনপি-জামায়াত সরকারের খড়্গ নেমে আসে এর ওপর। ২০০১ সালে ক্ষমতায় এসেই তারা চ্যানেলটি বন্ধ করার ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে শুরু করে। সেই সময় আমরা ‘শতাব্দীর আলো’ নামে বাংলার এক শতাব্দীর ঘটনা প্রবাহের ওপর একটি ডকু-ম্যাগাজিন করছিলাম। আমার মনে আছে, অনুষ্ঠানটি প্রচার হওয়ার শুরু থেকেই ইনকিলাবে বিরাট বিরাট পরিসরে অনুষ্ঠানটির সমালোচনার নামে বিষোদ্‌গার করতে থাকে। নানা আইনগত প্রশ্নও তুলতে থাকে। আইনি লড়াইটার ওপর চলে উপর্যুপরি রাজনৈতিক চাপ।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যেভাবে এগিয়ে এসেছিল, অনেকের রক্ত মিশে গেছে বাংলার মানুষের উষ্ণ স্রোতের সঙ্গে। তেমনি একজন বড় আপন মানুষ সাইমন ড্রিং, যিনি যুগ যুগ বেঁচে থাকবেন আমাদের মধ্যে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে।

চ্যানেলটি যাতে বন্ধ না হয়, তার জন্য সারা দেশের দর্শকেরা নানাভাবে প্রতিবাদী সমাবেশ করতে থাকে। শেষ পর্যন্ত তা গড়ায় শহীদ মিনার পর্যন্ত। এই সঙ্গে স্মরণ করা যেতে পারে ওই বছর ফেব্রুয়ারি মাসে শহীদ মিনারের চারদিকে কাঁটাতার দিয়ে বেষ্টনী করেছিল সরকার। ’৫২ সালের পর একমাত্র একাত্তর সাল ছাড়া আর কখনো শহীদ মিনার এভাবে শৃঙ্খলিত হয়নি। শেষ পর্যন্ত নানা হয়রানি, আইনি লড়াই, দেশের বিশিষ্টজনের অভিমত উপেক্ষা করে এক রাতে একধরনের বল প্রয়োগেই চ্যানেলটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। কোনো মহৎ কাজই যে নিঃশেষিত হয়ে যায় না, তার প্রমাণ একুশে টিভি। সংবাদ প্রচারে একুশের ধরনটির প্রভাব দেশের সব টেলিভিশনে ছড়িয়ে পড়েছে। মান্ধাতার আমলের সংবাদ পরিবেশনার অবসান হয়েছে। চ্যানেল বন্ধ হওয়ার অল্প কিছুদিন পরেই সরকার সাইমন ড্রিংয়ের ওয়ার্ক পারমিট বাতিল করে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে দেশ ত্যাগের নির্দেশ দেয়।

একুশে টিভির কর্মীরা তাঁকে বিদায় দেন। কিন্তু আমরা ভাবলাম, এই মানুষটার এভাবে বিদায় নেওয়া উচিত নয়। দেশের নাগরিকদের পক্ষ থেকেও একটি বিদায় সংবর্ধনা প্রয়োজন। এ ব্যাপারে দৈনিক প্রথম আলোর সভাকক্ষে আমি, সম্পাদক মতিউর রহমান, প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক ও নওয়াজীশ আলী খান (আরও হয়তো কেউ কেউ ছিলেন, মনে করতে পারছি না) সিদ্ধান্ত নিই পরদিনই মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে সবার জন্য উন্মুক্ত একটি বিদায় সংবর্ধনা দেওয়া হবে। যথারীতি পরদিন সন্ধ্যায় এই বিদায় সংবর্ধনা অনুষ্ঠিত হলো। কাইয়ুম চৌধুরী তাঁর আঁকা একটি চিত্রকর্ম উপহার দিলেন। বক্তব্য দিলাম আমি একাই। তারপর অনেক সময় ধরে সাইমন ড্রিং বাংলাদেশ নিয়ে তাঁর আবেগ, ভালোবাসা ব্যক্ত করলেন। আমরা অশ্রুসজল চোখে তাঁর বক্তব্য শুনলাম।

একটি চা-চক্রে বিদায় সংবর্ধনা শেষ হলেও বহুদিন পর্যন্ত তার রেশ ছিল সবার কাছেই।
সাইমন ড্রিংয়ের অনেক যুদ্ধস্মৃতি বহু মানুষের কাছে আছে। তার কারণও বহুবিধ। এত কর্মঠ এবং একই সঙ্গে এমন স্বপ্নচারী মানুষ আমি খুব কমই দেখেছি। গত শুক্রবার সাইমন ড্রিং চিরতরে বিদায় নিলেন। তাঁর মৃত্যুতে শুধু বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীর অন্যান্য দেশের সংগ্রামী মানুষও তাঁকে স্মরণ করবে পরম শ্রদ্ধায়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যেভাবে এগিয়ে এসেছিল, অনেকের রক্ত মিশে গেছে বাংলার মানুষের উষ্ণ স্রোতের সঙ্গে। তেমনি একজন বড় আপন মানুষ সাইমন ড্রিং, যিনি যুগ যুগ বেঁচে থাকবেন আমাদের মধ্যে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে।

মামুনুর রশীদ নাট্যব্যক্তিত্ব