সৌমিত্র চিরকাল বেঁচে থাকবেন বাংলাভাষীদের মনে

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়

জনপ্রিয় অভিনেতা ও আবৃত্তিকার সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ১৫ নভেম্বর কলকাতার বেলভিউ নার্সিংহোমে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৫ বছর। ছয় সপ্তাহ আগে কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়ে তিনি হাসপাতালে ভর্তি হন।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯৩৫ সালের ১৯ জানুয়ারি পশ্চিম বাংলার কৃষ্ণনগরে। তিনি সত্যজিৎ রায়ের ‘অপুর সংসার’ ছবিতে অভিনয় করে বিশেষ সুনাম অর্জন করেন। তিনি সত্যজিতের ১৪টি ছবিতে অভিনয় করেছেন। সত্যজিতের শেষ ছবি ‘শাখা-প্রশাখা’-তেও সৌমিত্র অভিনয় করেন। এ ছাড়া মৃণাল সেন, তপন সিংহ, তরুণ মজুমদার ও অন্যান্য নামকরা পরিচালকের ছবিতেও অভিনয় করেছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। সত্যজিতের ‘অশনিসংকেত’ ছবিতে বাংলাদেশের শিল্পী ববিতা আর সৌমিত্র একসঙ্গে অভিনয় করেন সফলভাবে। ছবিটি বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে।
চলচ্চিত্র ছাড়াও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় মঞ্চে অভিনয় করেছেন। লেখক, নাট্যকার ও পরিচালক হিসেবেও তিনি সুনাম অর্জন করেছিলেন।

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় হাওড়া জেলা স্কুল, সিটি কলেজ আর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেন। একসময় তিনি অল ইন্ডিয়া রেডিওতে যোগদান করেন অনুষ্ঠান ঘোষক হিসেবে। কাজী নজরুল ইসলামের ছেলে কাজী সব্যসাচী সেই সময় অল ইন্ডিয়া রেডিওতে কাজ করতেন। ঘোষক হিসেবে এবং আবৃত্তিকার হিসেবে সব্যসাচী ছিলেন অত্যন্ত জনপ্রিয়, বলা যায় সবার ওপরে। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে কাজী সব্যসাচীর বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে কলকাতা বেতারে কাজ করার সময় থেকে।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমার কয়েকবার দেখা করার সুযোগ হয়েছে। একবার কলকাতা গেলাম। আমার ছোট বোন নাসরীনও ছিল। নাসরীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক এবং রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী। ঢাকা টেলিভিশনের প্রথম যুগের শিল্পী এবং বুলবুল ললিতকলা একাডেমির প্রথম ব্যাচের ছাত্রী। বাফাতে রবীন্দ্রসংগীতের প্রধান শিক্ষক ভক্তিময় দাশগুপ্ত ছিলেন নাসরীনের গানের শিক্ষক। সেবার তাঁর বড় ছেলে তিলক অঞ্জন দাশগুপ্ত কলকাতায় আমাদের সঙ্গে দেখা করল। ওকে একেবারে ছেলেবেলা থেকে চিনি আমরা। বাবুই নামে ডাকি। কথা প্রসঙ্গে বাবুই বলল, দাদা, তুমি কলকাতায় আবৃত্তির একটা সিডি করো। যদি চাও আমি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে এই সিডি করার আয়োজন করতে পারি। কলকাতায় বাবুই ফিল্ম প্রোডাকশনের জন্য কাজ করে। অভিনেতা-পরিচালক তার চেনা। বাবুইয়ের প্রস্তাবে আমি রাজি হলাম। পরে নাসরীনকে নিয়ে একদিন দেখা করলাম সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর বাড়িতে। বাবুই নিয়ে গেল। যথেষ্ট আনন্দ-উত্তেজনা ছিল। সুন্দর বাড়ি। সেদিন বেশ আলো-বাতাস ছিল। আমাদের বসার ঘরে নিয়ে যাওয়া হলো। কিছুক্ষণের ভেতর সৌমিত্র এলেন। তাঁর পরনে ছিল স্লিপিং স্যুট। একেবারে নিরহংকার, ইনফরমাল মানুষ। খুব ভালো লাগল। সৌজন্যমূলক কিছু কথা হলো। কথা হলো আবৃত্তির সিডি রেকর্ড করার বিষয়ে। তারপর খুশিমনে বিদায় নিলাম।

নিউইয়র্ক ২০০৫ : বঙ্গ সন্মেলনে ইকবাল বাহার চৌধুরী, নাভীন (কন্যা), সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় , ইসমাত বাহার চৌধুরী ( স্ত্রী )

সম্ভবত এর প্রায় এক বছর পরে আবার যখন ওয়াশিংটন থেকে কলকাতা গেলাম, তখন সিডি রেকর্ডিং হলো। নির্ধারিত দিনে কলকাতার একটি স্টুডিওতে রেকর্ডিং হলো। শুধু কবিতা নয়, রবীন্দ্রনাথের কবিতা আর গান মিলিয়ে একটা থিমের ওপর সিডি হলো। নাম ‘আনন্দলোকে: এসো নতুন পৃথিবী গড়ি’। রেকর্ডিংয়ের জন্য সৌমিত্র সময়মতো এলেন। প্রথম আবৃত্তি রেকর্ড হলো আর গান হলো পরে আলাদাভাবে। আমরা দুজন ছাড়া আবৃত্তিতে আরও ছিলেন মধুমন্তী মৈত্র। গানের শিল্পী অনেক—আটজন। নাসরীন গানে ছিল। অন্যরা কলকাতার—শ্রীরাধা বন্দ্যোপাধ্যায়, স্মিতা অধিকারী, স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়, তৃষিত চৌধুরী, প্রবুদ্ধ রাহা, শান্তনু রায়চৌধুরী আর ইন্দ্রনীল সেন।
আমেরিকায় প্রতিবছর বাঙালিদের একাধিক সম্মেলন হয়। একবার নিউইয়র্কে বাঙালিদের সম্মেলন হলো—বার্ষিক বঙ্গ সম্মেলন। সেটা ২০০৫ সাল। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় সম্মেলনে অংশ নিয়েছিলেন। আমি সপরিবারে সেখানে গিয়েছিলাম। সম্মেলন চলাকালে দেখা হয়েছিল তাঁর সঙ্গে। ভিড়ের মধ্যে আমরা কথা বলেছি কিছুক্ষণ।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমার সম্ভবত চার বছর আগে শেষ দেখা। ঢাকায়, একটি অনুষ্ঠানে। খুব কাছে বসেছিলাম। কথা হলো। পরে তিনি মঞ্চে দাঁড়িয়ে কথা বললেন, আবৃত্তি করলেন এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধু কাজী সব্যসাচীর প্রশংসা করে বললেন, ‘বাংলা কবিতা আবৃত্তিকে একটা মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে কাজী সব্যসাচী বিশেষ অবদান রেখেছিলেন।’
অসামান্য প্রতিভার অধিকারী দুই বাংলায় জনপ্রিয় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় আজ আমাদের মধ্যে নেই কিন্তু তিনি বেঁচে থাকবেন চিরকাল—বাংলাভাষী সবার মনে। তাঁকে জানাই হাজারো সালাম।

ইকবাল বাহার চৌধুরী ভয়েস অব আমেরিকার বাংলা বিভাগের সাবেক প্রধান।