স্থাপত্যের কবি বশিরুল হক

বাশিরুল হক

‘মিয়া, কাজটা ভালো করলা না’, ভারী গলায় স্বভাবসিদ্ধভাবে আমার কাঁধে হাত রেখে বাশীর ভাই বললেন। আরও বললেন, ‘তুমি তো বউয়ের কাছে অনেক পয়েন্ট স্কোর করলা। বিপদে ফেললা আমাদের।’ পাশে দাঁড়ানো তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু মিতভাষী হাসান ভাই (দীপ্ত টিভির স্বত্বাধিকারী) মাথা নেড়ে সায় দিলেন। আমার স্ত্রী রীয়ার জন্মদিনে এক ঘরোয়া অনুষ্ঠানে তাঁর ও আমার রচিত এক কবিতা আবৃত্তি ভিডিও প্রদর্শনীর পর বশির ভাইয়ের ওই উক্তি। ‘যুগলবন্দী’ শিরোনামের ভিডিও মূলত ছিল কীভাবে আমরা দুজনে ৩৪ বছরের সংসারজীবন চড়াই-উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে পার করেছি, একে অপরের স্বপ্নপূরণের সাথি হিসেবে কাজ করেছি। বলা বাহুল্য, দুজনের প্রেমের কিছুটা বর্ণনাও সে কবিতায় ছিল।

বশির ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল ১৯৭৮-এ, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন আয়োজিত কমনওয়েলথ বৃত্তির জন্য সাক্ষাৎকারের দিনে। তাঁর স্ত্রী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির শিক্ষক ফিরদৌস আজিমকে সঙ্গ দিতে তিনি গিয়েছিলেন। বেশ অনেকটা সময় অপেক্ষা করতে হয়েছিল বলে ছোটখাটো একটা আড্ডা পরিচয়ের প্রথম দিনেই হলো।

সেদিন তাঁর সম্বন্ধে বেশি কিছু জানা না থাকলেও অল্প দিনের মধ্যে অবহিত হয়েছিলাম। সেই বন্ধুবৎসল অমায়িক প্রাণ খুলে হাসতে পারা ভদ্রলোক হলেন বশিরুল হক, দেশের স্বনামধন্য স্থপতি। তাঁর সঙ্গে বয়সের কিছুটা ব্যবধান থাকলেও হক-ফেরদৌস দম্পতির সঙ্গে সম্পর্ক অতি দ্রুত ঘনিষ্ঠ হয়।

নব্বইয়ের শুরুতে বিদেশ থেকে উচ্চশিক্ষা শেষে আমরা দুজন দেশে ফিরে আসার পর দুই সন্তান নিয়ে নতুন করে সংসার গোছাতে গিয়ে হিমশিম খাওয়া অবস্থায় যে কয়েকজন ব্যক্তির বিশেষ সাহায্য লাভ করেছিলাম, বশির ভাই ও ফেরদৌস আজিম ছিলেন তাঁদের অন্যতম। সন্তানদের পড়াশোনা ও পিতৃপ্রদত্ত সম্পত্তিতে গৃহ নির্মাণসহ সাংসারিক জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অনেক বিষয়ে তাঁরা দুজন ছিলেন আমাদের নির্ভরযোগ্য পরামর্শক।

সম্পর্ক গাঢ় হয়, যাওয়া-আসা বাড়ে; বাড়ে আড্ডার সংখ্যা ও মাত্রা। খুব যে একটা পরিকল্পনা করে সেগুলো হতো, তা নয়; স্বতঃস্ফূর্তভাবেই ঘটে যেত। দুই পরিবারের সন্তানেরা ধানমন্ডির সানবীম স্কুলে যাওয়ার সূত্রেও দেখাসাক্ষাৎ হতো নিয়মিত।
এ লেভেল এবং এসএটি পরীক্ষায় ভালো ফল অর্জন করার পর আমার ছেলে রাশাদের বিদেশে পড়তে যাওয়া নিয়ে বাশীর ভাইয়ের আগ্রহ ছিল অপরিসীম। তাঁর নিজের সন্তান রেনে কয়েক বছর আগে একই প্রক্রিয়ায় উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যাওয়ার সুবাদে অভিভাবক হিসেবে বশির ভাইয়ের লব্ধ জ্ঞান তিনি রাশাদকে বিতরণ করলেন অনেকটা সময় নিয়ে। সে লিবারেল আর্টস কলেজে ভর্তি হবে নাকি বিশ্ববিদ্যালয়ে, সে নিয়ে চলে গবেষণা। রাশাদ তার এসএটি পরীক্ষার নম্বর নিয়ে কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আবেদন করবে, তা নিয়ে চলল বিস্তর আলোচনা। একই সঙ্গে ভর্তির আবেদনের জন্য যে রচনা তাকে লিখতে হবে, তা নিয়েও তিনি উপদেশ দিলেন মার্কিন মুলুকে ভর্তিপ্রত্যাশী এই কিশোরকে।

পরবর্তী জীবনে গর্বিত পিতা-মাতা হিসেবে সন্তানদের ডিগ্রি অর্জন ও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার চাকরি লাভের পর যে বিশেষ কয়েকজনকে সংবাদটা দেওয়ার জন্য উদ্গ্রীব হয়েছিলাম, বশির ভাই ছিলেন তাঁদের অন্যতম। নিজের ও ঘনিষ্ঠজনদের সন্তানদের শিক্ষাক্ষেত্রে অর্জন তাঁকে বিশেষভাবে আলোড়িত করত। আমার মেয়ের বিয়ের সংবাদ পেয়ে আক্ষেপের সঙ্গে তিনি বলেছিলেন, ‘তুমি তো মিয়া সবই গোছায়া ফেললা। আমাদেরগুলি তো বিয়া করতে চায় না।’

একঘেয়ে, গৎবাঁধা, প্রথানুবর্তী (conformist) বিধিনিষেধে সামাজিক চর্চার মরুভূমিতে ইন্দিরা রোডে বাশীর ভাইয়ের ডেরা ছিল মরূদ্যানের মতো। বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরির সামান্য বেতনে বিশেষ সাধ-আহ্লাদ মেটানোর অপরিহার্য রসদ জোগানো ছিল একটি বড় চ্যালেঞ্জ। একই সঙ্গে সে পণ্য ওই সময়ে সহজলভ্য ছিল না। তাই শখটি মাঝেমধ্যে পূরণের জন্য বাশির ভাইয়ের দ্বার ও বার—দুই-ই ছিল আমার জন্য উন্মুক্ত। আমাদের জীবনের নির্ভেজাল আনন্দঘন আড্ডার অন্যতম কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হলো হক-ফিরদৌস দম্পতির সবুজ লতায় ছেয়ে যাওয়া লাল ইটের সেই আধুনিক দালান। সময়ে-অসময়ে অনির্ধারিত আড্ডার জন্য যেন সদা প্রস্তুত থাকত সেই দালান, তার বাসিন্দা ও পোষা কুকুরটি। বন্ধুবৎসল ও অতিথিপরায়ণ এ বাসায় প্রায়ই দেখেছি বিদেশি গবেষক, শিক্ষক ও অ্যাকটিভিস্টরা নিঃসংকোচে পরিবারের সদস্যদের সম-অধিকার নিয়ে নির্দ্বিধায় যাওয়া-আসা, খাওয়াদাওয়া করছে।

সমমনোভাবাপন্ন বন্ধুবান্ধবের সান্নিধ্যে সাহিত্য, সংগীত, শিল্পচর্চা থেকে শুরু করে রাজনীতির বিষয়ে আলাপচারিতায় পার হয়ে যেত ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এক রাতে দারুণ এক আড্ডার পর গাড়ি চালিয়ে বাড়ি যেতে ভরসা পাচ্ছিলাম না। বশির ভাইয়ের উক্তি, ‘মিয়া, নিজের ওপর আস্থা রাখো। ভালোমতোই পৌঁছাতে পারবা।’ সে রাতে বাড়ি ঠিকমতো পৌঁছেছিলাম। বাকি জীবনেও নিজের ওপর আস্থা ও অন্যান্য অর্জনের ক্ষেত্রে সাহায্য করেছিলেন তিনি।

১৯৯৩ সালে স্ত্রী ফিরদৌস আজিমের বিদেশ থেকে প্রকাশিত বই ‘দ্য কলোনিয়াল রাইজ অব দ্য নভেল’-এর প্রকাশনা উপলক্ষে একটি জমজমাট পার্টির আয়োজন করেছিলেন বশির ভাই। অনুষ্ঠানের একপর্যায়ে সদ্য প্রকাশিত বইয়ের এক কপি মাথায় রেখে হইহই চিৎকারে প্রবেশ করে আসর মাতায় পরিবারের ছোট ছেলে পার্থ। বিদুষী স্ত্রীর অর্জনে গর্বিত বশির ভাইয়ের সে চেহারা আজও মনে পড়ে। তাঁর সঙ্গে স্থাপত্য নিয়ে খুব একটা আলাপ হয়নি। তবে রসবোধসম্পন্ন এই স্থপতির একটা কথা মনে পড়ছে। প্রসঙ্গক্রমে একদিন তিনি জানিয়েছিলেন, বাঙালির বাড়ির বারান্দায় কাপড় রোদে দেওয়ার রুচিহীন প্রবণতার কারণে তিনি কখনো কোনো নকশায় বাড়ির সম্মুখভাগে বারান্দা রাখেন না। নিঃসন্দেহে নান্দনিক দিক থেকে এ যুক্তি অকাট্য।

অধ্যাপক আদনান মোরশেদ তাঁর শ্রদ্ধার্ঘ্যে বশিরুল হক নির্মিত দালানকে বাসযোগ্য কবিতা হিসেবে আখ্যায়িত করে লিখেছেন, ‘ইট, শ্যামলিমা, আলো-বাতাস ও স্পর্শ দিয়ে তাঁর কাব্য রচিত। দেশজ ও আধুনিকতার বয়নের সার্থকতাই এ স্থপতির সৃষ্টিকে স্বকীয় করে তুলেছে। টেকসই স্থাপত্যের একনিষ্ঠ প্রবক্তা ছিলেন বশির।’ স্বামীর কীর্তি স্মরণ করে ফিরদৌস আজিম লিখেছেন, গ্রামে বেড়ে ওঠা এ স্থপতির সারা জীবনের প্রয়াস ছিল সমকালীন জীবনকে গ্রামীণ উৎসের সঙ্গে সংযোগ ঘটানো। স্থান (space) ব্যবহারে গাছপালা লতাগুল্ম কীভাবে একদিকে নির্জনতা, অন্যদিকে সামাজিকতা নিশ্চিত করে; তা বশির ভাইয়ের স্থাপত্যে প্রতিফলিত।

বশির ভাই যেমন বেঁচে আছেন, তাঁর নির্মিত ছায়ানট, দৃক-পাঠ, সানবীম স্কুলসহ উপকূলের অসংখ্য সাইক্লোন আশ্রয় স্থাপনায়, তেমনি রয়েছেন তাঁর দীক্ষায় লালিত একঝাঁক নতুন প্রজন্মের স্থপতিদের মধ্যে যাদের স্থাপত্যচর্চায় রয়েছে দেশজ জ্ঞান ও উপাদানের প্রতি শ্রদ্ধা।

অনেক দিন পর বশির ভাইয়ের সঙ্গে শেষ দেখা হয় তাঁর সদ্য প্রয়াত শ্বশুরের মিলাদের দিনে। তিনি বললেন, রীয়া নিশ্চয়ই এখনো খুব ব্যস্ত? জিজ্ঞেস করলেন, ছেলে-মেয়ে-নাতিরা কেমন আছে? শেষ উপদেশ দিলেন, ‘সাবধানে থাইকো।’ সেদিন তাঁকে কিছুটা ক্লান্ত লাগছিল, তবে তাঁর আদরমাখা চোখ আর সিগনেচার হাসি ছিল অম্লান।

গত ৪ এপ্রিল ছিল বশির ভাইয়ের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।

সি আর আবরার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক