পাকিস্তানে জালিয়াতির নির্বাচন ও দুই ‘বিবেকী কন্ঠ’

পাকিস্তানে নির্বাচনের কারচুপির অভিযোগ দেশটির রাজনৈতিক সংকট দীর্ঘায়িত করছেছবি : রয়টার্স

৮ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের আগে পাকিস্তানের রাজনীতিতে যত নাটকীয় ঘটনা ঘটেছে, তার চেয়ে বেশি ঘটছে নির্বাচনের পর।

পাকিস্তানের নির্বাচনের সঙ্গে নাশকতা ও বোমা মারার ঘটনা প্রায় অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। তবে এবারেও নির্বাচনের আগের দিন এক প্রার্থীর অফিসে বোমা মেরে বেশ কয়েকজনকে হত্যা হয়। নির্বাচনের পর নাশকতার ঘটনা তেমন না ঘটলেও একের পর এক রাজনৈতিক বোমা ফেলছেন রাজনীতিক ও আমলারা, যা নিয়ে এখন পাকিস্তানে তোলপাড় শুরু হয়েছে।

পাকিস্তানের রাজনীতিতে সেনা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ সব সময়ই ছিল। কিন্তু এবারে দীর্ঘ পরিকল্পনা করেই তারা নেমেছে।  নির্বাচনের আগের রাজনীতি ছিল যেকোনো মূল্যে ইমরান খান ও তাঁর দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) নির্বাচন থেকে দূরে রাখা। সে ক্ষেত্রে সেনাবাহিনী অনেকটা সফল।

নির্বাচনের সময় ইমরান ও তাঁর স্ত্রী বুশরা বিবি কারাগারে আটক ছিলেন এবং এখনো আছেন। নির্বাচন কমিশন পিটিআইএর দলীয় প্রতীক ক্রিকেট ‘ব্যাট’ কেড়ে নিয়েছে।  ইমরান খানকে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করেছে।  পাকিস্তানে যতই নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারই হোক না কেন, নেপথ্যে কলকাঠি নেড়েছে সেই শক্তি, যারা ৭৬ বছর ধরে পাকিস্তানের রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করেছে।

কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে পিটিআইয়ের অনুসারীরা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়ী হন। পিটিআইয়ের বর্তমান চেয়ারম্যান গওহর খানের দাবি, তাঁদের দল পাকিস্তানে দুই-তৃতীয়াংশ আসনে জয়ী হলেও ভোট জালিয়াতি করে জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদে তাঁদের বিজয় ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে।

পিটিআইয়ের এই  দাবির সমর্থন পাওয়া গেল করাচি শহরের প্রাদেশিক বিধানসভার পিএস-১২৯ আসনে নির্বাচন কমিশন দ্বারা জয়ী ঘোষিত হাফিজ নাঈম উর রেহমানের বিবৃতিতে। তিনি নিজের বিজয় প্রত্যাখ্যান করে বলেছেন, ‘কেউ যদি আমাদের অবৈধ উপায়ে জেতাতে চায়, আমরা তা মেনে নেব না।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘জনমতকে সম্মান করতে হবে। বিজয়ীকে জিততে দিন, পরাজিতকে হারতে দিন।’

নির্বাচনের পর মুসলিম লিগ ও পিপিপি কোয়ালিশন সরকার গঠন নিয়ে আলোচনা করলেও কার ভাগে মন্ত্রিত্বের কত ভাগ পড়বে, কোন দল থেকে প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্ট হবে, সে বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেনি। এর পাশাপাশি পিটিআই ভোট জালিয়াতির বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনও করছে।

উপমহাদেশীয় রাজনীতিতে যেখানে জনপ্রতিনিধিরা জয়ী হতে নানা অপকৌশল ও অসততার আশ্রয় নেন,  সেখানে একজন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির ‘জয়’ প্রত্যাখ্যান বিরল ঘটনাই বলতে হবে।

যেই দল থেকে নাঈম উর রেহমান নির্বাচিত হয়েছেন, সেই দলের অন্য কোনো প্রার্থী এ রকম ঘোষণা দেননি। সে ক্ষেত্রে আমরা ধরে নিতে পারি, দলের নেতা হিসেবে নয়, ব্যক্তিগতভাবেই তিনি বিবেকতাড়িত হয়ে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
 
নাঈম উর রেহমানের ঘোষণার পর আরেক বোমা ফাটালেন পাকিস্তান জনপ্রশাসনের এক জ্যেষ্ঠ আমলা। রাওয়ালপিন্ডি বিভাগের কমিশনার লিয়াকত আলী চাত্তা নির্বাচনে অনিয়মের দায় স্বীকার করে সংবাদ সম্মেলন করেন। একই সঙ্গে তিনি নির্বাচনে কারচুপির জন্য প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও প্রধান বিচারপতিকেও অভিযুক্ত করেন।

 লিয়াকত আলী চাত্তা বলেন, রাওয়ালপিন্ডি বিভাগে ৮ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে জালিয়াতি হয়েছে এবং  তিনি এর দায় স্বীকার করেন। তাঁর ভাষ্য, পরাজিত প্রার্থীকে ৫০ হাজার ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী করার উদাহরণও আছে।  সংবাদ সম্মেলনের পর তিনি পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেন।

পাকিস্তানের নির্বাচন নিয়ে এই দুই বিবেকী কণ্ঠ গণতন্ত্রকে এগিয়ে নেবে কি না, সেটা ভবিষ্যতই বলে দেবে। তবে একজন রাজনীতিক ও একজন আমলার সত্যদর্শী প্রতিবাদ ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতাপ্রত্যাশি মহলে মারাত্মক ধাক্কা দিয়েছে, যা সামাল দেওয়া সহজ হবে না। ইতিমধ্যে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও প্রধান বিচারপতির পদত্যাগ দাবি করেছে পিটিআই।

রাওয়ালপিন্ডি বিভাগের কমিশনার লিয়াকত আলী চাত্তা নির্বাচনে অনিয়মের দায় স্বীকার করে সংবাদ সম্মেলন করেন।

এদিকে নির্বাচনী বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছে দেশটির সেনাবাহিনীও। জমিয়তে উলেমা-ই-ইসলামের (জেইউআই-এফ) আমির মাওলানা ফজলুর রেহমান সম্প্রতি একটি টেলিভিশন চ্যানেলকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ২০২২ সালের এপ্রিলে পার্লামেন্টে যে অনাস্থা ভোটে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিলেন, সেটি উত্থাপন করা হয়েছিল সাবেক সেনাপ্রধান কামার জাভেদ বাজওয়ার নির্দেশনায়।
ইমরানকে ক্ষমতাচ্যুত করার ওই তৎপরতা হয়েছিল পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট (পিডিএম) নামের একটি জোটের মাধ্যমে। নওয়াজ শরিফ নেতৃত্বাধীন পাকিস্তান মুসলিম লিগ-নওয়াজ (পিএমএল-এন), বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারি নেতৃত্বাধীন পাকিস্তান পিপলস পার্টিসহ (পিপিপি) বেশ কয়েকটি দল ওই জোট গঠন করেছিল। সে সময় জোটের প্রধান ছিলেন এই ফজলুর রেহমান।

পাকিস্তানের সাবেক সেনাপ্রধান বাজওয়া এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন এবং মাওলানা ফজলুর রহমানকে তাঁর বিবৃতি প্রত্যাহার করতে বলেছেন। কিন্তু তিনি সেটি করেননি।

পাকিস্তানের রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ফজলুর রহমান অপেক্ষাকৃত একটি ছোট দলের বড় নেতা হলেও দেশটির রাজনীতিতে সব সময় অনুঘটনের ভূমিকায় ছিলেন। ক্ষমতার রদবদলে তাঁর হাত থাকত। ৮ ফেব্রুয়ারি নির্বাচনে তাঁর দল ভালো ফল করলে তিনি এসব অভিযোগ আনতেন কি না, সন্দেহ।

তবে ফজলুর রেহমান আত্মপক্ষ সমর্থন করে যে বিবৃতি দিয়েছেন, তা স্ববিরোধী। তিনি বলেছেন, ‘আমি ব্যক্তিগতভাবে অনাস্থা প্রস্তাবের বিপক্ষে ছিলাম। কিন্তু অন্য দলগুলোর চাপাচাপির মুখে আমি যদি না বলতাম, তাহলে আমি পিটিআই প্রতিষ্ঠাতাকে রক্ষা করছি বলে আমার ওপর একটি তকমা লাগানো হতো।’

ইসলামী দলের এই নেতা পিটিআইকে রক্ষা করার তকমা না নিয়ে তাঁকে যাঁরা ক্ষমতাচ্যুত করলেন, তাঁদের সহযোগী হলেন। পাকিস্তানের রাজনীতি সম্পর্কে একটি কথা চালু আছে, সেখানে সেনাশাসকেরা রাজনীতিকদের সহায়তা করেন না।

রাজনীতিকেরাই প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে সেনাশাসকদের সাদরে সম্ভাষণ জানান।
উল্লেখ্য, ইমরান খান নেতৃত্বাধীন পিটিআই সরকার উৎখাতের পর পিএমএল-এনের প্রেসিডেন্ট শাহবাজ শরিফের নেতৃত্বে জোট সরকার গঠন হয়। ওই সরকারই ৮ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আগে ১৬ মাস পাকিস্তান শাসন করে।

পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে কোনো দল নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। ইমরান খানের পিটিআই-সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থীরা সবচেয়ে বেশি ৯২টি আসন পেলেও দল হিসেবে নির্বাচন কমিশন তাদের স্বীকৃতি দেবে কি না সে বিষয়ে সন্দেহ আছে।মুসলিম লিগ-এন ৭৯টি এবং পিপিপি ৫৪টি আসনে জয় পেয়েছে।

নির্বাচনের পর মুসলিম লিগ ও পিপিপি কোয়ালিশন সরকার গঠন নিয়ে আলোচনা করলেও কার ভাগে মন্ত্রিত্বের কত ভাগ পড়বে, কোন দল থেকে প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্ট হবে, সে বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেনি। এর পাশাপাশি পিটিআই ভোট জালিয়াতির বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনও করছে।

৮ ফেব্রুয়ারির আগে পাকিস্তানের রাজনীতিতে যে অনিশ্চয়তা ও অস্থিরতা ছিল, সেটা নির্বিাচনের পরও কাটেনি।

  • সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
    [email protected]