হারিয়ে যাচ্ছে রসনা জৌলুশে অনন্য চাটগাঁইয়া মধুভাত
চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় প্রবাদ আছে, ‘উনা ভাতে দুনা বল, অতি ভাতে রসাতল।’ অতিরিক্ত আহার স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। ছোটবেলায় বড়দের মুখে গ্রামীণ খেলায় বোল বলতে শুনতাম, ‘মধুভাত খেছনি, মধুভাত খেছনি, মধুভাত খেছনি।’ কক্সবাজার জেলার আবদুর রশীদ মাস্টার তাঁর প্রেয়সীকে না পেয়ে সেন্ট মার্টিন দ্বীপে বসে রচনা করেছিলেন, ‘মধু হই হই আঁরে বিষ হাওয়াইলা, হন হারণে হন দোষ হান পাই, ভালোবাসার দাম ন দিলা।’
মধু সংগ্রহের জন্য সুন্দরবনের মৌয়ালদের কত–না কষ্ট করতে হয়। আহা, মধু হচ্ছে প্রকৃতির এক অমূল্য দান। তবে আমি ফুলের মধু কিংবা গানের মধুর কথা বলছি না। চট্টগ্রামের লোকসংস্কৃতি মধুভাতের কথা বলছি। দেশের অন্য জেলার লোকজনের কাছে এ খাদ্যদ্রব্যের নাম অপরিচিতই ঠেকবে।
মধুভাতের উৎপত্তি সঠিক জানা নেই। তবে অনেক গবেষক ও ইতিহাসবিদ ধারণা করেন, চট্টগ্রামের ইতিহাস ১ হাজার ৪০০ বছরের পুরোনো। চট্টগ্রামে বার আউলিয়া সুফিসাধকেরা ইসলাম প্রচার করতে এসে নানা রকমের খাদ্যাভ্যাস ও সংস্কৃতি রেখে গেছেন। মধুভাতও তার একটি হতে পারে। অনেকের ধারণা, আরাকান আমল থেকে তাঁরা মধু দিয়ে হয়তো ভাত মাখিয়ে খেয়েছেন। সে জন্য নাম হয়েছে মধুভাত। তবে যে মধুভাতের কথা বলছি, এটির রন্ধনপ্রণালি বা স্বাদ ভিন্নতর।
মূলত মধুভাত হচ্ছে পায়েসের মতো একধরনের ভাত। তরল করে বিশেষভাবে তৈরি মিষ্টি ভাত। মধুর মতো স্বাদ বলে নাম হয়েছে মধুভাত। চট্টগ্রামের নিজস্ব লোকজ ঐতিহ্য মধুভাত তৈরির মৌসুম হলো আষাঢ়, শ্রাবণ ও ভাদ্র—এই তিন মাস। ভাদ্র মাসে তৈরি মধুভাত বেশ মিষ্টি হয়। পিঠা–পায়েসের মূল উপকরণ কিন্তু চালের গুঁড়া। মধুভাতও ঠিক জালা চালের গুঁড়া দিয়ে তৈরি করা হয়।
জালা চালটি মূলত প্রধান উপকরণ। আষাঢ় মাসের প্রথম দিকে আমন ধান সংগ্রহ করে পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হয়। ধান অঙ্কুরিত হলে পানি থেকে উঠিয়ে নিয়ে রোদে শুকাতে হয়। ধান শুকিয়ে গেলে সেগুলো ঠুকরিতে রেখে কাপড়চোপড় দিয়ে ঢেকে রাখা হয়। ১০ থেকে ১৫ দিন পর সেসব ধান গুঁড়া করা হয়। এমনভাবে গুঁড়া করা হয় যেন একদম মিহি না হয়। সেসব গুঁড়া কিছুটা শুকাতে হয়। মনে রাখতে হবে, জালা চালের গুঁড়া ছাড়া মধুভাত হয় না। মধুভাত সন্ধ্যায় বা রাতে রান্না করতে হয়।
দুই কেজি চালের মধুভাত রান্না করতে যেসব উপকরণের প্রয়োজন হয়:
১. জালা চাল ২০০ গ্রাম বা ৩ কাপ পরিমাণ
২. বিনি চাল ১ কেজি
৩. আতপ চাল ৫০০ গ্রাম
৪. গরুর দুধ ১ কেজি
৫. চিনি এক কেজি
৬. পরিমাণমতো নারকেল
৭. পরিমাণমতো তেজপাতা
৮. পরিমাণমতো লবণ
১ কেজি বিনি চাল ও ৫০০ গ্রাম আতপ চাল বেশি পরিমাণ পানি দিয়ে প্রথমে বড় পাত্রে জাউয়ের মতো করে রান্না করতে হয়। কেজিপ্রতি এক পোয়া বা ২০০ গ্রাম করে জালা চালের গুঁড়া মিশিয়ে আলাদা একটি পাত্রে কাঠি দিয়ে বা চামচ দিয়ে ঘুঁটে ভাতগুলো মোলায়েম করতে হয়। অতঃপর আধা কেজি চিনি এবং ১ লিটার দুধ দিয়ে ভালো করে মিশিয়ে নিতে হবে। মেশানোর পর অল্প জালা চালের গুঁড়া ছিটিয়ে দিয়ে আবার কাঠি দিয়ে ভালো করে ঘুঁটে নিতে হবে।
এবার শীল বা নোড়া দিয়ে পাত্রের মুখ ভালো করে চাপা দিয়ে রাখতে হয়। পাত্রের মুখে যাতে বাতাস প্রবেশ না করে, সে জন্য অনেকে কাপড় দিয়েও পাত্রের মুখ বেঁধে রাখেন। মনে রাখতে হবে যেন গরম বাষ্পটা থেকে যায়। রাতে ১০–১২ ঘণ্টা থাকার পর ভোরে মধুভাত বাটিতে নিয়ে তাতে নারকেল, কিশমিশ, তেজপাতা দিয়ে পরিবেশন করা যেতে পারে। পাত্রের মুখ খোলার পর ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে মধুভাত খেয়ে ফেলতে হয়। নয়তো টক হয়ে যায়। ফ্রিজে রেখেও কয়েক দিন খাওয়া যায়।
চট্টগ্রামে মধুভাত রান্না করে আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে পাঠানোর রেওয়াজ ছিল, যা বর্তমানে হারিয়ে যাচ্ছে। চট্টগ্রামে নতুন বিয়ে করলে মেয়ের শ্বশুরবাড়ি থেকে প্রথম বছর মধুভাত পাঠানোর রেওয়াজ ছিল। এভাবে আত্মীয়তা ও সম্পর্কের গভীরতা বাড়ে। নিজেরা একা না খেয়ে অন্যকে খাওয়ানোর মধ্যে আছে আনন্দ, তৃপ্তি ও সুখ। জীবন হয়ে ওঠে আরও মধুময়। তবে কালের বিবর্তনে আর বাহারি খাবারের ভিড়ে রসনা জৌলুশে অনন্য চাটগাঁইয়া মধুভাত হারিয়ে যেতে বসেছে।
রশীদ এনাম
সমন্বয় সহকারী, ইতিহাসের খসড়া