ধলু মিয়াদের আয়-ব্যয় সমান, হাতে থাকে ‘ভাগ্য’

ধলু মিয়ার আয় ও ব্যয় সমান; বাড়তি কিছু থাকে না তাঁর হাতে।
ছবি: হাসান ইমাম

‘বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবি থেকে সম্মিলিতভাবে সরকার এখন যা ঋণ চাইছে, তার চেয়ে বেশি ক্যাপাসিটি চার্জ (বিদ্যুৎকেন্দ্র বসিয়ে রেখে ভাড়া) দিয়েছে গত ১১ বছরে। ৯০ হাজার কোটি গেছে এ খাতে; এর মধ্যে ১২টি কোম্পানি পেয়েছে ৬০ হাজার কোটি টাকা।’ প্রথম আলোয় ছাপা হওয়া জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদের সাক্ষাৎকারের এ অংশ পড়ার সময় রাস্তা থেকে ভেসে এল ‘এই পুরাতন কাপড় আছে...বেচবেন পুরাতন শার্ট-প্যান্ট-শাড়ি...।’
২৬ আগস্ট বেলা ১১টা। ঝকঝকে রোদ, পরিষ্কার আকাশ।

সাপ্তাহিক ছুটির দিন হওয়ায় আশপাশের কিছু বাসাবাড়ি থেকে মাংস রান্নার ঘ্রাণ ভেসে আসছে। এর মধ্যে কিনা ‘পুরোনো জামাকাপড়’ কেনার জন্য হাঁকডাক! হ্যাঁ, ‘সাময়িক একটু অসুবিধা’ দেখা দিয়েছে বটে, যা বৈশ্বিক সংকটের অংশ। কিন্তু দেশ তো সেই উন্নয়নের মহাসড়কে; মাথাপিছু আয় আড়াই হাজার ডলার ছাড়িয়ে গেছে সেই কবে। যেখানে এক মেগাওয়াট বিদ্যুৎ না নিয়েও কেন্দ্রভাড়া বাবদ প্রায় এক লাখ কোটি টাকা খরচ করার সামর্থ্য রাখে সরকার, সে দেশের জনগণ কিনা পরবে পুরোনো জামাকাপড়! হিসাব মেলে না!

আরও পড়ুন

মোহাম্মদ ধলু মিয়া (৫১) নামের যে ব্যক্তি পুরোনো কাপড়চোপড় কেনার জন্য হাঁক দিচ্ছিলেন, তাঁর সঙ্গে কথা বলে হিসাব যেন আরও গুলিয়ে গেল! জানান, ৩৫ বছর ধরে তিনি পুরোনো কাপড়চোপড়ের ব্যবসা করছেন। ঢাকার পাড়ামহল্লায় ঘুরে শার্ট, প্যান্ট, শাড়ি, সালোয়ার, পাঞ্জাবি, টি-শার্ট ইত্যাদি কেনেন। এরপর সেগুলো বেচেন বেগমবাজারে।

এসব পুরোনো জামাকাপড়ের গন্তব্য দেশের গরিব ও প্রান্তিক এলাকা; বিশেষ করে উত্তরবঙ্গের কয়েকটি জেলা। তার মানে, ৩৫ বছর আগেও যেমন এর ক্রেতা ছিলেন, এখনো আছে? এ প্রশ্নে ধলু মিয়া হাসেন। বলেন, ‘কী যে কন! মানুষ অ্যাহনো ঠিকঠাক খাইবার পায় না! আর আপনে কইতাছেন এই কথা?’

দিনকাল চলছে কীভাবে তাহলে? ধলু মিয়া তাঁর এলাকার একটা প্রবাদ আওড়ালেন, ‘গাউল্লা দাউল্লা সমান’। সপ্তাহে তিন থেকে চার দিন কাজে বের হন। এটা যে পরিমাণ ঘোরাঘুরির কাজ, অর্থাৎ পরিশ্রমের, এর বেশি আর পারেন না। সব দিন সমান কেনাবেচাও হয় না। এমনও দিন যায়, ‘বিসমিল্লাহ’ হয় না।

ধলু মিয়া জানান, তিনি এ ব্যবসা শিখেছেন তাঁর শ্বশুরের কাছে। তাঁরা অনেকটা পারিবারিকভাবে এ ব্যবসায় যুক্ত। বিক্রমপুরের অনেকেরই পেশা এই পুরোনো কাপড়চোপড় কেনাবেচা। ধলু মিয়ার বাড়ি বিক্রমপুরের উমপাড়ায়। দুই ছেলে ও এক মেয়ে। বড় ছেলে বিয়ে করেছেন। পেশায় তিনি গাড়িচালক। তাঁর ঘরে এক ছেলে আছে। মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। ছোট ছেলেটি পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে।

ধলু মিয়া আরও জানান, সবকিছুর দাম বাড়লেও তাঁদের পণ্যের দাম কমেছে। আগে মোটামুটি ভালো একটি শার্ট বিক্রি করতেন ৫০ টাকায়; এখন কমে হয়েছে ৪০ টাকা। শুধু তা-ই নয়, ‘চাহিদা’ও কমেছে। ধলু মিয়া বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করলেন এভাবে, ‘এখন এক পোয়া (২৫০ মিলিলিটার) ত্যালের দাম পোচপান্ন (৫৫) ট্যাকা। অ্যাকখান পুরাতন শাড়ি দামও এই রহম পোচপান্ন-ষাইট ট্যাকা। মানুষ কোনডা কিনব? আগে তিরিশ ট্যাকায় এক পোয়া ত্যাল পাওয়া যাইতো।’

আরও পড়ুন

দিনকাল চলছে কীভাবে তাহলে? ধলু মিয়া তাঁর এলাকার একটা প্রবাদ আওড়ালেন, ‘গাউল্লা দাউল্লা সমান’। সপ্তাহে তিন থেকে চার দিন কাজে বের হন। এটা যে পরিমাণ ঘোরাঘুরির কাজ, অর্থাৎ পরিশ্রমের, এর বেশি আর পারেন না। সব দিন সমান কেনাবেচাও হয় না। এমনও দিন যায়, ‘বিসমিল্লাহ’ হয় না। এই যেমন মাসখানেক আগেই এই জিগাতলা এলাকায় ঘুরে শূন্য হাতে ফিরতে হয়েছিল। আজ যে হবে, তারও কোনো ঠিকঠিকানা নেই। তাঁর কাঁধের কালো কাপড়ের ঝোলাটি দেখালেন, তখনো সেটি শূন্য। অথচ এরই মধ্যে ২০০ টাকা খরচ হয়ে গেছে। ‘ত্যালের দাম’ বাড়ার আগে বিক্রমপুর থেকে গুলিস্তানের ভাড়া ছিল ৫০ টাকা, এখন ৭০। নাশতা করতে লেগেছে ৫০ টাকা। পরে রিকশায় এসেছেন ৮০ টাকায়। রিকশায় চলাচল এই জন্য যে সঙ্গে যেহেতু টাকা আছে, নগর পরিবহনের ভিড় বাসে পকেট কাটার ভয় থাকে। এমনটা হয়েছে এর আগে।

কত টাকা থাকে সঙ্গে? দুই থেকে তিন হাজার টাকা। যদি এক দিন ব্যবসা না হয়, তবে এই চালান থেকে সংসারের খরচ জোগান। পরে কারও কাছ থেকে টাকা ধারকর্জ করে নিয়ে আসেন। সারা দিন ঘুরে মালামাল কেনার পর বেগমবাজার দিয়ে যা লাভ (৫০০ থেকে ৬০০ টাকা) হয়, সেটা নিজের কাছে রেখে ধারের টাকা শোধ করেন। মানে শেষ পর্যন্ত হাতে কিছু থাকে না। এটাকেই বলছিলেন তিনি ‘গাউল্লা দাউল্লা সমান’। তবে এ কথাও বলেন, ‘আল্লাহপাক চালায়া ন্যান।’

জীবনের ৫১ বছর কাটিয়ে দেওয়ার পরও একজন মানুষের আয় ও ব্যয় সমান; বাড়তি কিছু নেই হাতে। দেশের বয়সও ৫১। এটা একটা কাকতাল। গত বছরের ৯ ডিসেম্বর মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের (এমএসএফ) দেওয়া এক পরিসংখ্যান বলছে, দেশে বছরে নতুন কোটিপতি হচ্ছেন পাঁচ হাজারের বেশি ব্যক্তি। এটাকে অবশ্য কাকতাল বলা কঠিন। শুধু বিদ্যুৎ খাতের এক ক্যাপাসিটি চার্জের ৯০ হাজার কোটি টাকা আমলে নিলে বোঝা যায়, পরিসংখ্যানে কোনো কিছুর পুরোটা না এলেও তার ইঙ্গিতে ‘ঘাটতি’ থাকে না।

  • হাসান ইমাম প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক
    [email protected]