সহমর্মিতা, সমবেদনা ও সাম্যের মাস রমজান

রমজান মাসে সিয়াম সাধনা মানবিক গুণাবলি বিকাশে সহায়ক। সিয়াম সাধনার মাধ্যমে ধনীরা গরিবের দুঃখ–কষ্ট বুঝতে পারেন। ক্ষুধা-তৃষ্ণার জ্বালা অনুভব করতে পারেন। কিছুটা হলেও উপলব্ধি করতে পারেন নিরন্ন দরিদ্র মানুষের একমুঠো খাবারের জন্য দ্বারে দ্বারে হাত পাতার কারণ। এই অনুভূতি জাগ্রত হওয়াই রোজা ও রমজানের অন্যতম শিক্ষা।

দান-খয়রাত ও ফিতরা-জাকাত আদায় রমজানের অতি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। এটি সমাজের অবহেলিত–বঞ্চিত মানুষের জন্য সহায়ক। কিন্তু কখনো কখনো এ মহতী কাজেও অনেকে ভুল পদক্ষেপ নেন।

কোথাও কোথাও দেখা যায় অনেক কাপড় ব্যবসায়ী অসম্মানজনকভাবে জাকাতের কাপড় বিক্রির ব্যানার ঝোলান। বিজ্ঞাপন দিয়ে কিছু কম দামি নিম্নমানের শাড়ি কাপড় ও লুঙ্গি বিক্রি করেন। কোনো কোনো জাকাতদাতাও এমন আছেন, যাঁরা এগুলো কিনে জাকাত হিসেবে গরিবদের মধ্যে বিতরণ করেন। যাঁরা এসব করেন, তাঁরা প্রথমত জাকাতকে অসম্মান করেন, দ্বিতীয়ত জাকাতদাতাকে হীন কাজে প্রলুব্ধ করেন।

হাদিস শরিফে আছে, মন্দ কাজের প্রতি উদ্বুদ্ধকারী অনুরূপ মন্দ কাজের সমান প্রতিফল পাবে এবং ভালো কাজের প্রতি উৎসাহ প্রদানকারী সেইরূপ ভালো কাজ করার সমান সুফল পাবে।

যেসব জাকাতদাতা এ ধরনের নিম্নমানের শাড়ি–লুঙ্গি জাকাত হিসেবে দিচ্ছেন, তাঁরা একদিকে জাকাতকে অসম্মান করছেন, অন্যদিকে জাকাত গ্রহীতাকেও অমর্যাদা করছেন। সব মিলে ইসলামের পঞ্চ ভিত্তির অন্যতম খোদায়ী বিধান জাকাতের অবমাননা হচ্ছে; আর মানবতার সঙ্গে উপহাস করা করা হচ্ছে। সর্বোপরি ইমান ও ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ একটি মৌলিক ইবাদতকে খেল-তামাশায় পরিণত করা হচ্ছে। রমজানের মূল লক্ষ্য ভ্রাতৃত্বের শিক্ষা থেকে মানুষ বঞ্চিতই রয়ে যাচ্ছে।

জাকাত ফরজ ইবাদত; করুণার দান নয়। এটি বঞ্চিতদের পাওনা। অধিকার। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তাদের সম্পদে বঞ্চিত যাচ্‌ঞাকারীদের নির্দিষ্ট অধিকার রয়েছে।’ (সুরা-৫১ যারিয়াত, আয়াত: ১৯; সুরা-৭০ মাআরিজ, আয়াত: ২৪-২৫)।

পাওনাদারের টাকা দিয়ে পাওনাদারকে নিম্নমানের কিছু কিনে দেওয়া ধোঁকাবাজি ছাড়া আর কী? আল্লাহ তাআলা আরও বলেন, ‘তোমরা ততক্ষণ পর্যন্ত প্রকৃত কল্যাণ পাবে না, যতক্ষণ না তোমাদের প্রিয় জিনিস দান করবে। আর তোমরা যা দান করো, আল্লাহ তা সে বিষয়ে অবগত।’ (সুরা-৩ আলে ইমরান, আয়াত: ৯২)

যেহেতু এটি তঁার পাওনা, সুতরাং প্রাপককে তাঁর পাওনা সসম্মানে প্রদান করতে হবে; যাতে তিনি তা পেয়ে সন্তুষ্ট হন। জাকাত প্রদান করা ফরজ ও সদকা আদায় করা ওয়াজিব; কিন্তু কোনো মানুষকে হেয় জ্ঞান করা, তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা, কারও সম্মানহানি করা নাজায়েজ ও হারাম কাজ।

সদকাতুল ফিতর ও জাকাতে শুধুই গরিবের হক আছে। তাই দেওয়ার আগে তিনি প্রকৃত হকদার কি না, তা নিশ্চিত হতে হবে। তবে সেসব প্রদান করার ক্ষেত্রে গ্রহীতাকে এমন বলার প্রয়োজন নেই যে, ‘এটা জাকাত’ বা ‘এটা ফিতরা’। এমনভাবে বলা উচিতও নয়; কেননা এতে গ্রহীতা লজ্জা ও অপমান বোধ করবেন। শুধু ফরজ, ওয়াজিব দান নয়; বরং নফল দান–খয়রাতের মাধ্যমেও কাউকে অসম্মান করা যাবে না।

আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘উত্তম কথা ও ক্ষমা সেই দান অপেক্ষা উত্তম, যার সঙ্গে অনুগামী হয় যন্ত্রণা। আর আল্লাহ তাআলা ধনী ও সহিষ্ণু।’ (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ২৬৩)

সদকা ও জাকাত এমনভাবে দেওয়া উত্তম, যা গ্রহীতা স্বাচ্ছন্দ্যে ব্যবহার করতে পারেন। এ ক্ষেত্রে মুদ্রা বা টাকাই অগ্রগণ্য, কেননা এর দ্বারা গ্রহণকারী নিজের রুচি ও ইচ্ছেমতো প্রয়োজন মেটাতে পারেন। কোনো কাপড়চোপড় বা খাদ্যদ্রব্য অথবা অন্য কোনো বস্তু কিনে দিলে ব্যবহার উপযোগী মানসম্পন্ন জিনিসই দেওয়া উচিত।

মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী

যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি; সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম

[email protected]