করতোয়া পাড়ে লাশের সারি: তাদের জন্য কোনো শোক দিবস নেই!

‘এত বড় আয়োজন প্রতিবছরই হয়। মহালয়া উপলক্ষে মানুষের চাপ হবে, এটা জানা কথা। এত মানুষের জন্য ছিল মাত্র একটি নৌকা।’

‘চারজনকে হারিয়ে পরিবারে মাতম’, ‘৫০ লাশ উদ্ধার, নদীপাড়ে আহাজারি’, ‘কে জানত, এটাই শেষ বিদায়’, ‘বিয়ের দেড় মাসেই হিমালয়-বন্যার চিরবিচ্ছেদ’, ‘একসঙ্গে এত লাশ কখনো দেখেনি মাড়েয়া গ্রামের মানুষ’, ‘ঘরে ১০ মাস বয়সী সন্তান, আঙিনায় স্বামীর লাশ’, ‘করতোয়ার পাড় থেকে শ্মশানঘাট, লাশ আর লাশ’, ‘স্ত্রী-মেয়েসহ চার স্বজনকে দাহ করে নাতনির অপেক্ষায়’, ‘একের পর এক ভেসে উঠছে লাশ’। গত কয়েক দিনের এসব শিরোনাম আমাদের দৈনন্দিন জীবনে সাড়া ফেলতে ব্যর্থ হয়েছে। যেন নদীমাতৃক দেশে আমরা কোনো দিন নদী পার হইনি!

করতোয়া নদীর ওই অংশের প্রস্থ ৬০০ মিটার। এটুকু পাড়ি দিতে গিয়ে এখন পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা ৬৯। নিখোঁজ আরও তিনজন। তাঁদের ৪৬ জন বোদা উপজেলার, ১৭ জন দেবীগঞ্জের। ২ জন আটোয়ারি উপজেলার, ১ জন পঞ্চগড় সদরের এবং ঠাকুরগাঁও সদরের ৩ জন। মৃতদের মধ্যে শিশুর সংখ্যা ২১, নারী ৩০ জন ও পুরুষ ১৮ জন। আর নিখোঁজ দেবীগঞ্জের শালডাঙ্গার ছত্রশিকারপুর-হাতিডাঙ্গা গ্রামের মদনচন্দ্রের ছেলে ভূপেন, বোদা উপজেলার সাকোয়া ইউনিয়নের ডাঙ্গাপাড়ার খগেন্দ্রনাথের ছেলে সুরেন এবং পঞ্চগড় সদরের ঘাটিয়ারপাড়া গ্রামের ধীরেন্দ্রনাথের মেয়ে জয়া রানী। এখন পর্যন্ত পরিবারপ্রতি আর্থিক সহায়তা পেয়েছে ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকা। এগুলো যেন পরিসংখ্যানের উপাত্তমাত্র।

দুর্গাপূজার মহালয়া উপলক্ষে পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার মাড়েয়া বাজারের আউলিয়া ঘাট থেকে শতাধিক যাত্রী নিয়ে পাশের বড়শশী ইউনিয়নের বদেশ্বরী মন্দিরে যাচ্ছিলেন তাঁরা। ইতিমধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওতে দেখা যায়, ‘তিলঠাঁই নাই’ পরিস্থিতি নিয়ে নৌকাটি ছেড়ে দিয়েছে। কিনারে কিছু আনসার সদস্যকেও দেখা যাচ্ছে। বাধাহীনভাবে যাত্রী তোলা হচ্ছে। নৌকার মাঝি আরও এগিয়ে আসার আহ্বান জানাচ্ছেন।

একটি অনলাইন পত্রিকার সাংবাদিক আরিফুল ইসলামকে সুমন দাস নামের এক মাঝি জানিয়েছেন, ঘাটে প্রতিদিন একটিমাত্র নৌকায় লোক পারাপার করা হয়। মহালয়া উপলক্ষে ইজারাদার মাত্র দুইটি নৌকা চলাচলের জন্য বরাদ্দ দিয়েছেন। অথচ ওই দিন চার/পাঁচটি নৌকা দিলে এই দুর্ঘটনা ঘটত না।

এ ছাড়া একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী জানিয়েছেন, পর্যাপ্ত নৌকার অভাব, অব্যবস্থাপনা ও ইজারাদের মুনাফার লোভ আর পুণ্যার্থীদের অসচেতনতাই এই দুর্ঘটনার জন্য দায়ী। একই কথা জানিয়েছেন গ্রামপুলিশ দীনবন্ধু, থানাপুলিশ মিনারুলও।

একই ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য মশিয়ার রহমান জানান, এত বড় আয়োজন প্রতিবছরই হয়। মহালয়া উপলক্ষে মানুষের চাপ হবে, এটা জানা কথা। এত মানুষের জন্য ছিল মাত্র একটি নৌকা। ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক জানান, পূজা কমিটি ছয়টি নৌকার ব্যবস্থা করতে বলেছিল, কিন্তু তা হয়নি।

জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) মুহাম্মদ সানিউল কাদের জানান, জেলা পরিষদ খেয়াঘাটের ইজারা দিলেও নৌযানের তদারকি ও যাত্রী পারাপারের বিষয় দেখে স্থানীয় প্রশাসন। অর্থাৎ কড়ি নেবে কিন্তু ঠিকঠাক মতো পার করবে না।

২.

সড়ক মেরামত করতে রাষ্ট্রের যত কড়ি ঢালতে হয়, নৌপথে তার এক আনাও লাগে না। অথচ সড়কপথে ৩০ কিলোমিটার যেতে যাত্রীভাড়া যেখানে ৪০ টাকা, সেখানে নৌপথে ১০ কিলোমিটারে লাগে ১০০ টাকা। অন্যদিকে একটি অটো বা ভটভটিতে একই পরিমাণ তেল খরচ করে ছয় থেকে আটজন পরিবহন করা যায়, সেখানে নৌপথে ১০০ জন। এমনকি একটি অটোর দাম যেখানে দুই লাখ টাকা, সেখানে একটি নৌকার দাম দেড় লাখ টাকা। তবু এত ভাড়া কেন? কারণ নৌপথের ইজারাব্যবস্থা। স্রেফ জনগণের পকেট কাটা।

চিলমারী-রৌমারী রুট উত্তরবঙ্গের অন্যতম ব্যস্ত নৌরুট। এখানে ইজারাদারেরা তিন ঘণ্টা পরপর খেয়া পরিচালনা করেন। অথচ যাত্রী সব সময় লেগেই আছে। কিন্তু তাঁরা বাসের মতো আসন পূরণ হলেই নৌকা ছাড়বেন না। অতিরিক্ত যাত্রী নেবেন। যাত্রীদের তাড়া থাকলে ১৫ জনে ১টি নৌকা রিজার্ভে যেতে দেবেন। যতই যাত্রী থাকুক, ১৫ জনের বেশি যাত্রী নেওয়া যাবে না। এতে দেখা যায়, একবারে তিন/চারটা রিজার্ভ নৌকা ছেড়ে দিল। ফলে আগে যেখানে খেয়ায় ৮০ টাকায় রৌমারী যেতে পারতেন, তাড়া থাকায় জনপ্রতি ৩০০ টাকা দিয়ে পার হতে হবে। এভাবেই নৌকায় ডুবুডুবু অবস্থায় পারাপার করতে হয়। ফলে যাঁরা যাত্রীদের দোষ দেন, তাঁরা ভেতরের ঘটনাটা জানেন না। তাঁদের জন্য কোনো শোক দিবস নেই!

৩.

এতগুলো মানুষের সলিলসমাধি হলো, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘুরলে তা টের পাওয়ার উপায় নেই। সবাই যাত্রীদের হুড়াহুড়িকে দোষ দিয়ে খালাস। মৃত্যু এখানে এত সহজ কখনো কি ছিল? এক সামষ্টিক আত্মহনন যেন আমাদের পেয়ে বসেছে।
ত্রিকালজয়ী ফেসবুকাররা পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হচ্ছি ক্রমেই। মানুষকে শত্রুজ্ঞান করছি। নিজের থেকেও বিচ্ছিন্ন। সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি অবজ্ঞা আর বিতৃষ্ণা আমাদের পেয়ে বসেছে। একটু সুস্থির হয়ে সংযুক্তির চেষ্টা নেই। ভিডিওতে দেখা গেছে, যাত্রীরা নিজেরা হুড়াহুড়ি করে নৌকায় উঠেছেন, অতএব তাঁরাই দায়ী। কিন্তু কেন এভাবে এতগুলো মানুষ আত্মহননে বাধ্য হলেন, সেটুকু ভাবার অবকাশ নেই। জুলুমের শিকারকেই দায়ী ভাবার এক ভয়ংকর প্রবণতা পেয়ে বসেছে আমাদের। ভয়, নিঃসঙ্গতা, অনিশ্চয়তা আমাদের মানসিক নড়াচড়াকেও কি অসাড় করে দিয়েছে? আমাদের শুধু একজন দায়ী করার লোক দরকার!

মনোবিজ্ঞানের মতে, মানুষ শুধু বিচ্ছিন্নই হয় না, সংযুক্তও হয়। রানা প্লাজার সময় আমরা বিহ্বলতা কাটিয়ে যেমন হয়েছিলাম। বলা হয়, মানুষ যখন নিজের ইচ্ছেমতো কাজ বেছে নিতে পারে ও ইচ্ছেমতো কাজ করার সুবিধা পায় কিংবা মানুষ যখন বোঝে, পরিবারের বাইরেও তার করার আছে, তখন মানুষের বিচ্ছিন্নতা কাটতে থাকে, তার ভাবনার জগৎ বড় হতে থাকে। মানুষ তাৎক্ষণিকতার পুতুল হয়ে ওঠার বদলে মানুষ হয়। নিজের সন্তানকে দিয়ে অপরের সন্তানকে বোঝে। তেভাগায় নিজের মেয়ের সম্ভ্রমের বদলে কমরেডের জীবন বাঁচিয়েছে, ৭১–এ বাঁচিয়েছে সহযোদ্ধার জীবন। বিহ্বলতা বা টাস্কি খাওয়ার পর্ব পেরিয়ে কখন করণীয়টি করব?