ওয়াশিংটন, তেল আবিব ও তেহরান—এই তিন রাজধানী হঠাৎই ঘটা এমন একটি ঘটনা নিয়ে হিসাব–নিকাশ করছে, যেটিকে ওপর থেকে দেখলে একটি সাধারণ প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বলে মনে হতে পারে। কিন্তু সৌদি আরব ও পাকিস্তানের গভীরতর কৌশলগত সম্পর্কটা এর চেয়ে বড় কিছু বলেই গুঞ্জন রয়েছে। অনিশ্চিত হলেও এটি এমন একটি পথরেখার ইঙ্গিত দেয়, যেখানে ইরান যদি পারমাণবিক সমৃদ্ধকরণের পথ থেকে সরে না আসে, তাহলে সৌদি আরব পরমাণু সক্ষমতা অর্জনের সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
বৈশ্বিক ক্ষমতার রাজনীতির দাবা খেলা হঠাৎ এক পাশে ঝুঁকে পড়েছে এবং প্যাঁচগুলো নতুন ও বিপজ্জনক অবস্থানে সরে যাচ্ছে। এ পরিবর্তন ভূমিকম্পের মতো। পাকিস্তান তার পরমাণু ছাতা সৌদি আরব পর্যন্ত সম্প্রসারণের ইঙ্গিত দিয়েছে। এটি একটি অপ্রত্যাশিত ঘোষণা। এ ঘোষণা আরব উপদ্বীপ থেকে ভারতীয় উপমহাদেশ পর্যন্ত কৌশলগত হিসাব-নিকাশ পুনর্বিন্যস্ত করছে।
১৯৭০-এর দশকে সৌদি আরব গোপনে পাকিস্তানের পারমাণবিক কর্মসূচিতে অর্থায়ন করেছিল। এটি ইরানি বিপ্লব ও আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসনের প্রতিক্রিয়ায় নেওয়া পদক্ষেপ ছিল। সে নিরাপত্তা বিনিয়োগের ফল এখন ফলতে শুরু করছে।
এটি সেই ধ্রুপদি উদাহরণ। এটাকে প্রয়াত হেনরি কিসিঞ্জার ‘পারমাণবিক বিস্তারের প্যারাডক্স’ বলেছিলেন। তাঁর মতে, পারমাণবিক বিস্তার রোধ করার চেষ্টা অনেক সময় এমন অস্থিরতা তৈরি করে, যা শেষমেশ সেটিকে আরও দ্রুত বাড়িয়ে দেয়।
পাকিস্তানের ইতিহাস এটিকে একমাত্র দেশ বানিয়েছে, যা সৌদি আরবকে শুধু আশ্বাস নয়, বাস্তব সাহায্যও দিতে সক্ষম। ইসলামাবাদের কাছে শুধু পারমাণবিক বোমা আছে তা নয়, এ কিউ খানের উত্তরাধিকারও আছে। এটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে কীভাবে একসময় পারমাণবিক জ্ঞান সীমান্ত পার হয়ে বিক্রি হতো।
যদিও এখন পাকিস্তান দাবি করে, পারমাণবিক কর্মসূচির ওপর দেশটির কঠোর নিয়ন্ত্রণ আছে। কিন্তু অর্থনৈতিক সমস্যা ও উপসাগরীয় দেশগুলোর বিনিয়োগের ওপর নির্ভরতার কারণে সৌদি আরব এমন একটি সুবিধা পাচ্ছে, যেটা আগে ছিল না। ফলে এমন সম্ভাবনা তৈরি হয় যে সামরিক সহযোগিতা শেষ পর্যন্ত পারমাণবিক সহযোগিতায় রূপান্তর হতে পারে।
সৌদির একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেছেন, এটি একটি ব্যাপক প্রতিরক্ষামূলক চুক্তি, যা সব ধরনের সামরিক সক্ষমতাকে অন্তর্ভুক্ত করে। ঠিক এ ব্যাপকতার কারণে ইরান আতঙ্কিত হবে এবং এটি একটি বিপজ্জনক অস্ত্র প্রতিযেগিতা শুরু করতে পারে।
পাকিস্তান-সৌদি আরব চুক্তির ভাষা অনেকটা ন্যাটোর মতো, যেখানে বলা হয়েছে ‘যেকোনো এক দেশের বিরুদ্ধে আক্রমণ হলে, তা দুই দেশের বিরুদ্ধে আক্রমণ হিসাবে ধরা হবে।’ কিন্তু এটি ন্যাটোর মতো নয়।
এই পদক্ষেপের সময়কে মোটেই আকস্মিক বলা যায় না। ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের সাম্প্রতিক সামরিক লড়াই একধরনের কৌশলগত ‘পরীক্ষা’ হিসেবে কাজ করেছে। মে মাসের সংঘর্ষের সময় পাকিস্তানের বিমানবাহিনী নিখুঁত আক্রমণ ও ইলেকট্রনিক যুদ্ধের সক্ষমতা দেখিয়েছে। চীনের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক উন্নয়নের কারণে এটা সম্ভব হয়েছে।
এ অভিযানে সৌদি আরব স্পষ্ট একটা বার্তা পায়—পাকিস্তানের কাছে এমন সামরিক সক্ষমতা ও প্রযুক্তি আছে, যেটা দিয়ে দেশটি তার পারমাণবিক প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারে। নিশ্চিত করেই ভারত এ অগ্রগতিকে খুবই ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। কেননা এখানে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়টি জড়িত।
ঘটনাটিকে বোঝার জন্য শুধু ইসলামাবাদ বা রিয়াদের দিকে নয়, বেইজিংয়ের দিকেও তাকাতে হবে। চীনের ভূমিকা শান্তিপূর্ণ পরিকল্পনাকারীর মতো। বেল্ট অ্যান্ড রোড বিনিয়োগ, বিশেষ করে চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডরের মাধ্যমে, বেইজিং পাকিস্তানকে একটি কৌশলগত সহযোগী হিসেবে গড়ে তুলেছে। পাকিস্তান যদি সৌদি আরবকে পারমাণবিক নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেয়, তবে আসলে এটি উপসাগরীয় অঞ্চলে চীনের প্রভাব বাড়ানোর মাধ্যম হিসেবে কাজ করছে।
এর মাধ্যমে বেইজিং সরাসরি জড়িত না হয়েই ইরানের বিরুদ্ধে সৌদি আরবকে নিরাপত্তা নিশ্চয়তা দিতে পারবে। যুক্তরাষ্ট্র যদি পিছিয়ে যায়, সে ক্ষেত্রেও বেইজিং সৌদি আরবকে সুরক্ষা দিতে পারবে। এটা খুবই চমকপদ মহাকৌশল।
এ অঞ্চলের জন্য এর ফল হতে পারে পারমাণবিক বিস্তারের একটি চেইন প্রতিক্রিয়া। দীর্ঘদিন ধরে অঘোষিত পারমাণবিক শক্তি হিসেবে থাকা ইসরায়েলের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। পাকিস্তানের পারমাণবিক অস্ত্র বা তার নিয়ন্ত্রণ যদি আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বীর হাতে চলে যায়, তাহলে শক্তির ভারসাম্য পুরোপুরি বদলে যাবে। ইরানের জন্য বার্তাটি আরও স্পষ্ট—তেহরান এটিকে অস্তিত্বগত হুমকি হিসেবে দেখবে এবং মনে করবে আঞ্চলিক শক্তির ভারসাম্য তার বিপক্ষে চলে গেছে, ফলে তার নিজস্ব পারমাণবিক কর্মসূচি ত্বরান্বিত হবে।
সৌদির একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেছেন, এটি একটি ব্যাপক প্রতিরক্ষামূলক চুক্তি, যা সব ধরনের সামরিক সক্ষমতাকে অন্তর্ভুক্ত করে। ঠিক এ ব্যাপকতার কারণে ইরান আতঙ্কিত হবে এবং এটি একটি বিপজ্জনক অস্ত্র প্রতিযেগিতা শুরু করতে পারে।
এ কৌশলগত পরিবর্তনের কারণে যুক্তরাষ্ট্র এখন কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। বহু বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্র উপসাগরীয় অঞ্চলের নিরাপত্তার প্রধান রক্ষক। কিন্তু এখন যুক্তরাষ্ট্রের নজর যখন এশিয়ার দিকে যাচ্ছে এবং চীন সেখানে প্রভাব বাড়ানোর চেষ্টা করছে, তখন নতুন পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে।
সৌদি আরব তাদের বিশাল সম্পদ ও বাড়তে থাকা ক্ষমতার সঙ্গে এখন কেবল যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি নির্ভরশীল থাকতে চায় না। পাকিস্তানের ‘উদ্যোক্তাভিত্তিক প্রতিরোধ’ প্রস্তাব হচ্ছে ঠিক সেই বিকল্প, যা এত দিন সৌদি আরব খুঁজছিল।
জাসিম আল-আজ্জাউই মধ্যপ্রাচ্যের সাংবাদিক
মিডলইস্ট মনিটর থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত