‘ভাড়া বেড়েছে তবে আপনারা আরও বেশি চাইছেন’

দেশের গণপরিবহন ব্যবস্থায় নৈরাজ্য বিশৃঙ্খলা নতুন বিষয় নয়। আন্তঃজেলা এবং অভ্যন্তরীণ যানবাহনগুলোর ভাড়া নিয়ে বছর জুড়েই কমবেশি আলোচনা হয়। সূর্যের আলোর সাথে সাথে যেমন যানবাহনে যাত্রী ভাড়া কমবেশি হয় তেমনি বছর জুড়েও বিশেষ দিনে, বিশেষ উপলক্ষে ভাড়া বৃদ্ধি ঘটে। ঈদ আসলেই যেন দেশের বাসমালিকেরা আরও একটু নড়েচড়ে বসেন। উৎসবকে কেন্দ্র করে ভাড়া বৃদ্ধির ঘটনা দেশে এক ধরনের সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। যাত্রীদের জিম্মি করে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের এই কৌশল মোটেও অগোচরে ঘটছে না। দেশের প্রত্যেকটি টিকিট কাউন্টার এবং ছোট বড় যানবাহনে প্রকাশ্যে অবলীলায় চলছে এই অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের মহোৎসব, যেন তা দেখার কেউ নেই।

ঢাকার এক কাউন্টারে বাসের টিকিট ক্রয়ের সময় দেখলাম টিকিট বিক্রি করা লোকটি একপ্রকার ঢাক ঢোল পিটিয়ে ঘোষণা দিলেন, এক তারিখ থেকে প্রতিটি রুটে বাস ভাড়া বৃদ্ধি পাবে। অথচ সরকারের সরকারের তরফ থেকে এমন কোনো ঘোষণা এসেছে কিনা আমার জানা নেই। টিকিট ক্রয় করতে আসা বেশির ভাগ মানুষ প্রতিউত্তর দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করলেন না, তাদের কাছে যে এ এক অতি স্বাভাবিক বিষয়। এক ভদ্রলোক উঠে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করলেন। তার হাতে থাকা একদিন আগে ক্রয়কৃত টিকিটের মূল্য দেখিয়ে পরের দিনের টিকিটের মূল্য বৃদ্ধি সম্পর্কে জানতে চাচ্ছিলেন। উত্তরে কাউন্টারে বসা লোকগুলো এক জোট হয়ে আত্মবিশ্বাসের সুরে বলে উঠলেন, অফিস থেকে টিকিটের মূল্য বৃদ্ধির জন্য চিঠি পাঠানো হয়েছে। তারা এও বললেন, আপনার অভিযোগ থাকলে টিকিটে উল্লেখিত অভিযোগ নম্বরে ফোন করুন। নাছোড় লোকটিও ফোন না দিয়ে ছাড়লেন না। অভিযোগ নম্বরে কথা বলার পর টিকিট সেলারের উদ্দেশ্যে তার বাক্যটি হলো, ‘ভাড়া বেড়েছে তবে আপনারা আরও বেশি চাইছেন।’

ততক্ষণে বুঝতে পারলাম এই কাউন্টারে বসা মানুষগুলো মিথ্যা না বললেও সত্য অন্তত বলেনি। একপক্ষ নীরব বসে থেকে পরিস্থিতির গতানুগতিক ধারার সাথে একাত্মতা প্রকাশ করছেন। যিনি প্রতিবাদ করলেন তিনিও বুঝে গেলেন, টিকিটের মূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদ তার মতো সাধারণ মানুষ করেও ফায়দা মিলবে না। কারণ এই ঈদে তাকেও বাড়িতে যেতে হবে।

বাংলাদেশে মুনাফালোভী মানুষের সংখ্যা অসংখ্য। কারণ ছাড়াই মানুষের চাহিদা বৃদ্ধির সুযোগ নিতে ন্যূনতম সংকোচবোধটুকু নেই অনেকের মধ্যে। নিত্য প্রয়োজনীয় বাজার থেকে যানবাহনের ভাড়া, সকল ক্ষেত্রেই বলির পাঠা কেবল সাধারণ মানুষ। বিশেষ সুবিধা নিয়ে সততা বিসর্জন দিয়ে ফুলেফেঁপে উঠছে কিছু স্বার্থান্বেষী সিন্ডিকেট। তাদের দৌরাত্ম্য রুখতে অনেকাংশেই আমাদের প্রশাসন অথর্বতার পরিচয় দিচ্ছে। ফলে অনিয়মে সয়লাব হচ্ছে আমাদের চারপাশ। নুন আনতে যাদের পান্তা ফুরায় অবস্থা তাদেরকেই ঈদের বকশিশ দিতে হচ্ছে রাস্তার মোড়ে মোড়ে।

অথচ ঈদকেন্দ্রিক কোনো যানবাহনের টিকিটের মূল্য বৃদ্ধি হওয়ার কথা ছিল না। কেননা অন্যান্য সময়ের তুলনায় উৎসবকেন্দ্রিক ছুটিতে যানবাহনগুলোর টিকিট বিক্রি সংখ্যা এমনিতেই বেড়ে যায়। এতে করে যানবাহন মালিকেরা বাড়তি মুনাফাও লাভ করতে পারেন। কিন্তু যে কায়দায় এ দেশের যাত্রীভাড়া বৃদ্ধি করা হয় তা পুরোটুকুই অনৈতিক এবং আইনবিরোধী।

যানবাহনে যাত্রী ভাড়া বৃদ্ধির মাধ্যমে অতিরিক্ত ভাড়া চাপিয়ে দেওয়া এক ধরনের অপরাধ। সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮-এর ধারা ৮০ অনুসারে, গণপরিবহনে নির্ধারিত ভাড়ার অতিরিক্ত ভাড়া দাবি বা আদায় করা অপরাধ বলে গণ্য হবে। আইন অমান্যকারীকে অনধিক ১ মাসের কারাদণ্ড বা অনধিক ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা যাবে। আইন থাকলেও তার প্রয়োগ খুব একটা দেখা যায় না। মাঝেমধ্যে বিআরটিএ’র ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার মধ্যেই তা সীমাবদ্ধ। ফলে উৎসবকেন্দ্রিক বাড়তি ভাড়া দিয়ে একদিকে যেমন অতিরিক্ত অর্থের দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে সাধারণ মানুষদের, অপরদিকে বাড়তি এই অর্থে মিলছে না বাড়তি কোনো সুবিধাও।

বাংলাদেশের পরিবহন ব্যবস্থা বড় বড় রাঘববোয়ালদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। সাধারণ মানুষদের জিম্মি করে বাসমালিক সমিতি ইচ্ছামতো ভাড়া বৃদ্ধি করলেও এতে কেবল সাধারণ মানুষের অসহায়ত্বই ফুটে ওঠে। উৎসবকেন্দ্রিক গণপরিবহনের অনৈতিক এই মহোৎসব রুখতে সরকারের কঠোরতার বিকল্প নেই। অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি মানুষের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা এবং সেবামূলক সংগঠনগুলোকে সুষ্ঠু নজরদারির মধ্যে আনতে হবে। কেবল আইন প্রণয়ন করে নয়, সড়কে নিয়মভঙ্গ হচ্ছে কিনা তা তদারকির মাধ্যমে যথাযথভাবে শাস্তি প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।

আকিজ মাহমুদ
শিক্ষার্থী, ইতিহাস বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]