পিইসি পরীক্ষা–হাওরে রাস্তা–বিদ্যুৎকেন্দ্র: ব্যর্থ নীতির ফাঁদে দেশ

বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। জনবহুল এ দেশে জনসংখ্যার তুলনায় সম্পদ বেশ সীমিত। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে টেকসই উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা এবং সম্পদের সুষ্ঠু  ব্যবহার। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, আমরা যথোপযুক্ত পরিকল্পনা প্রণয়নে খুব বেশি মনোযোগী হতে পারিনি।

গণপরিবহন হিসেবে রেলের চাহিদা ক্রমে বেড়ে চলেছে। কিন্তু সেবার মান বাড়ছে না। ট্রেনের চেয়ারের হাতল ভাঙা, জানালার কাচ ভাঙা, ফ্যান নষ্ট, টয়লেটগুলো ব্যবহারের অনুপযোগী, সিটের ভেতরে থাকা নারকেলের ছোবড়া পর্যন্ত দৃশ্যমান থাকে অনেক ট্রেনে। রেলপথকে উপেক্ষিত রেখেই সড়কপথকে শক্তিশালী করা হচ্ছে। যেখানে ভাড়া–সম্পর্কিত সুনির্দিষ্ট কোনো নীতিমালা নেই, নিয়ন্ত্রণ নেই।

একটি ট্রেন ৪০টি বাসের সমপরিমাণ যাত্রী বহন করতে পারে। ১০০ কিলোমিটার পথ যেতে একটি বাসের ৬০ লিটার ডিজেল প্রয়োজন হলে ৪০টি বাসের ডিজেল লাগবে ২ হাজার ৪০০ লিটার। একই পথ যেতে একটি ট্রেনের প্রয়োজন ৯০০ লিটার তেল, যা বাসের তুলনায় তিন ভাগের এক ভাগ মাত্র। এরপরও আমাদের রেল খাতে কেন লোকসান গুনতে হয়? যে খাত থেকে সরকারের প্রতি মাসে কোটি টাকা রাজস্ব আসার কথা, সে খাত কেন সরকারের ব্যয়ের খাত? পাশের দেশ ভারতেও রেল বিভাগ বেশ লাভজনক অবস্থায় রয়েছে।

অনেক ঢাকঢোল পিটিয়ে গত এক দশকে নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ ও কিশোরগঞ্জের হাওরাঞ্চলে বেশ কিছু সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। সম্প্রতি পরিকল্পনামন্ত্রী নিজেই বলেছেন, ‘হাওরে সড়ক নির্মাণ করে নিজেদের পায়ে কুড়াল মেরেছি।’ শুধু হাওর নয় সারা দেশেই প্রয়োজনীয়তার কথা বিবেচনা না করেই শুধু জনপ্রিয়তা লাভের আশায়ই চলছে সেতু নির্মাণের মহোৎসব। গণমাধ্যমগুলোয় ‘সেতু আছে সড়ক নেই’ শিরোনামে প্রকাশিত খবরের সংখ্যা বেড়েই চলেছে।

২০২২ সালের সিলেটের ভয়াবহ বন্যার জন্য দায়ী করা হয় অপরিকল্পিতভাবে সড়ক নির্মাণ। সড়কগুলো হাওরের পানি চলাচলের মুখে বাধা সৃষ্টি করে। ইটনা, মিঠামইন অপরিকল্পিতভাবে সড়ক নির্মাণের অন্যতম উদাহরণ। তাছাড়া সারা দেশেই অপরিকল্পিতভাবে নির্মিত ডিভাইডার, অপরিকল্পিত সংযোগ সড়ক কাজে আসছে না। ওয়াসার অপরিকল্পিতভাবে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়িতে প্রায়ই ধসে পড়ছে সংযোগ সড়ক।

ভোলার শাহবাজপুর গ্যাসক্ষেত্র থেকে দিনে ১৫ কোটি ঘনফুট উৎপাদন সক্ষমতা থাকলেও ব্যবহার হচ্ছে ৬ কোটি ঘনফুট গ্যাস। ভোলায় মাটির নিচে গ্যাস ফেলে উচ্চমূল্যের এলএনজি আমদানিমুখী হওয়া কতটা যৌক্তিক? বলা হচ্ছে, চাহিদা না থাকায় গ্যাস উৎপাদন করা হচ্ছে না। অপরদিকে প্রয়োজনীয় গ্যাস না পেয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রাখছে পিডিবি। চট্রগ্রামের রাঙ্গুনিয়া ও দিনাজপুরের ফুলবাড়ী উপজেলায় বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হবে। ধারণা করা হচ্ছে এ প্রকল্প ব্যয় ১৬০ কোটি টাকারও বেশি। পুরোনো গ্যাসক্ষেত্রগুলোর সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিতের মাধ্যমে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে সর্বোচ্চ উৎপাদনক্ষম না করে শতকোটি টাকা ব্যয়ে নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ কতটা সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহারকে নিশ্চিত করে?

দীর্ঘমেয়াদি কোনোরকম পরিকল্পনা ছাড়াই ২০০৮ সালে সৃজনশীল পদ্ধতি প্রণয়ন করা হয়। ২০১৬ সালের রিসার্চ ফর অ্যাডভান্সমেন্ট কমপ্লিট এডুকেশন শীর্ষক জরিপে বলা হয়, ‘শিক্ষকদের ৪৫ শতাংশই সৃজনশীল পদ্ধতি বোঝেন না এবং তাঁদের মধ্যে ৪২ শতাংশ এই পদ্ধতি সম্পর্কে খুবই সীমিত ধারণা রাখেন। বাকি ১৩ শতাংশ এই পদ্ধতি বুঝতেই পারেন না। আবার যেসব শিক্ষক বুঝতে সক্ষম, তাঁদের অর্ধেকই পড়ানোর জন্য গাইড বইয়ের সাহায্য নেন।’ কোনো পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়া, শিক্ষকদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ছাড়া, শিক্ষার্থীদের ধারণ ক্ষমতা ও মেধা বিবেচনায় না নিয়েই তড়িঘড়ি করে সৃজনশীল পদ্ধতি চালু শিক্ষার্থীদের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করে।

দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চার-পাঁচ বছর মেয়াদি যে শিক্ষা দেওয়া হয়, তার সঙ্গে সামাজিক চাহিদার কোনোই মিল থাকে না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কর্মজীবনেও কোনো কাজে লাগে না। অথচ এ ধরনের শিক্ষাপদ্ধতি চালাতে সরকারের প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হয়।

হঠাৎ করেই ২০০৯ সালের ৩১ আগস্ট মন্ত্রিসভার বৈঠকে পিইসি পরীক্ষা গ্রহণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ওই বছরেরই ২২ নভেম্বর পিইসি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। ২০১০ সাল থেকে জেএসসি পরীক্ষা চালু হয়। পরে ২০২৩ সালে শিক্ষার্থীদের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করে দাবি করে পিইসি ও জেএসসি পরীক্ষা বাতিল ঘোষণা করা হয়। সরকারের এ রকম পরীক্ষামূলকভাবে গৃহীত অপরিকল্পিত পদক্ষেপের মাশুল দিতে হয় একজন খুদে শিক্ষার্থীকে তার শৈশবের আনন্দকে বিসর্জনের মাধ্যমে। একজন খুদে শিক্ষার্থীর পড়াশোনা হবে খেলাধুলার মতো আনন্দময়। এ রকম অপ্রয়োজনীয় প্রতিযোগিতা শিক্ষার্থীকে শিক্ষাবিমুখ করে তোলে।

নারায়ণগঞ্জের খান সাহেব ওসমান আলী স্টেডিয়াম, খুলনার শেখ আবু নাসের স্টেডিয়ামের মতো আন্তর্জাতিক ভেন্যুগুলো অকেজো ফেলে রেখে ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা ব্যয়ে রাজধানীর পূর্বাচলে নতুন আরেকটি ক্রিকেট স্টেডিয়াম নির্মাণ কি বিলাসিতা নয়?

আমাদের দেশে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর দীর্ঘমেয়াদি কল্যাণের পরিবর্তে তাৎক্ষণিক মনোরঞ্জনের কথা বিবেচনায় রেখেই অনেক প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। এসব প্রকল্প জনগণের কোনো উপকারে তো আসছেই না; বরং জনগণের ট্যাক্সের হাজার হাজার কোটি টাকার অপচয় হচ্ছে। আছে বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প, নেই পরিকল্পিত ব্যবস্থাপনা। অপরিকল্পিত প্রকল্প গ্রহণের ফলে মেয়াদ বাড়ছে, প্রকল্প ব্যয় বাড়ছে। তারই ফলে বাড়ছে অপরিকল্পিত সরকারি ঋণ। সম্পদের ব্যবহার যত সঠিক হবে, লক্ষ্য অর্জনও ততই সহজ হবে।

ফাতেমা তুজ জোহরা
শিক্ষার্থী, গণিত বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়