লক্ষ্মীপুরে জেলা সাহিত্য মেলার এমন জগাখিচুড়ি কেন

৫ ও ৬ অক্টোবর লক্ষ্মীপুর টাউন হল মিলনায়তনে জেলা সাহিত্য মেলা অনুষ্ঠিত হয়।

বাংলা একাডেমি ও সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে জেলা প্রশাসনের বাস্তবায়নে সারা দেশের মতো লক্ষ্মীপুরেও দুই দিনব্যাপী সাহিত্য মেলার আয়োজন করা হয়। ৫ ও ৬ অক্টোবর বৃহস্পতি ও শুক্রবার স্থানীয় টাউন হল মিলনায়তনে এ মেলা অনুষ্ঠিত হয়।

টানা বৈরী আবহাওয়া উপেক্ষা করে জেলার বিভিন্ন উপজেলা ও প্রত্যন্ত এলাকা থেকে কবি, সাহিত্যিক ও সাহিত্যকর্মীরা উপস্থিত হন। নির্ধারিত সূচি অনুযায়ী, সকাল ৯টায় নাম নিবন্ধনের মধ্য দিয়ে কার্যক্রম শুরু হওয়ার কথা থাকলেও অনুষ্ঠান শুরু হয় ১২টার দিকে। বেলা তিনটার দিকে লেখকদের মধ্যাহ্নভোজের জন্য মিষ্টির কার্টনজাত পলিথিন মোড়া খাবার পরিবেশন করা হয়। এ খাবার দুর্গন্ধ হওয়ায় অনেক লেখক তা খেতে না পেরে ফেলে দেন। বিষয়টি জেলা কালচারাল অফিসারকে জানানো হলে তিনি বলেন, ‘সকালে অর্ডার করেছি তো, তাই তারা সকাল-সকাল প্যাকেট করায় এ রকম হয়েছে।’

লিখিয়েদের নিয়ে কর্মশালা হওয়ার কথা থাকলেও স্থানীয় এক লেখক দিয়ে পূর্বে লিখে রাখা যৎসামান্য লেখা বসে বসে পাঠের মধ্য দিয়ে কর্মশালা শেষ করেন। সূচিতে বিকেলবেলায় কর্মসূচি দেওয়া থাকলেও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শুরু হয় সন্ধ্যার অনেক পরে।

২.

দ্বিতীয় দিন শুক্রবারের কর্মসূচি সকাল ১০টায় স্থানীয় লেখকদের সাহিত্য পাঠ, কবি কণ্ঠে কবিতা পাঠ, ছড়া, কথাসাহিত্যের ছোট গল্প ইত্যাদি হওয়ার কথা থাকলেও তা শুরু হয় সকাল সাড়ে ১১টায়। শুধু স্থানীয় কবিদের কবিতা পাঠ দিয়েই প্রথম অধিবেশন চালানো হয়। এতে জেলা প্রশাসনের কোনো প্রতিনিধি বা কালচারাল অফিসার কেউ-ই উপস্থিত ছিলেন না। শুক্রবার হওয়ায় দুপুরের বিরতি একটু আগে দেওয়ার দাবি থাকলেও তা দেওয়া হয় দেরিতে। উল্লেখ্য, সকালবেলার অধিবেশনে কবি–সাহিত্যিকদের জন্য কোনো চা–বিরতি বা আপ্যায়নের ব্যবস্থা করা হয়নি।

দুঃখজনক হলেও সত্য যে দুপুরের বিরতির পর এসেও অনুষ্ঠানস্থলে কবি-লেখকেরা প্রশাসনের কিংবা অনুষ্ঠানের আয়োজকদের কাউকেই দেখতে পাননি। অংশগ্রহণকারীদের জন্য কোনো খাবারের আয়োজন নেই, চা-নাশতা-পানি দেওয়া বা খোঁজখবর নেওয়ার মতো কোনো লোক নেই। কিন্তু অনুষ্ঠানসূচি অনুযায়ী সকাল ১০টায় শুরু হয়ে বিকেল সাড়ে চারটায় টানা প্রোগ্রাম চলার কথা ছিল।

অনুষ্ঠানসূচিতে শুক্রবারের জুমার নামাজ ও মধ্যাহ্নভোজের কোনো বিরতি রাখা হয়নি। সারা দিনের অভুক্ত কবি-লেখকেরা ঘোরাঘুরি করে সন্ধ্যার জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। তাঁদের মধ্যে জেলার প্রথম সারির কবি-লেখকেরা এসব অবহেলার কারণে জেলা সাহিত্য মেলা বর্জন করে অনুষ্ঠানস্থল ত্যাগ করতে শুরু করেন, অনেকে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন।

একপর্যায়ে সন্ধ্যার আগমুহূর্তে সমাপনী দিনের অনুষ্ঠান সভাপতি অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মেহের নিগার এলে তাঁকে কবি-লেখকেরা বিষয়টি জানালে তিনি উল্টো অংশগ্রহণকারীদের ওপর বিরক্তি প্রকাশ করেন এবং কালচারাল অফিসারকে ডেকে রাগ প্রকাশ করেন।

অনুষ্ঠানে কোনো মেহমান না থাকা, অনুষ্ঠানের কোনো খোঁজখবর না রাখা, দুপুরে খাওয়াদাওয়ার আয়োজন না করা, চা–নাশতা কিংবা পানিও না দেওয়ার বিষয়টি কবি-লেখকেরা অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মেহের নিগারকে জানালে ‘তিনি বা তাঁর এসব দেখার বিষয় নয়’ বা ’তাঁকে এসব কেন জানানো হচ্ছে’ এমন মন্তব্যও করেন তিনি।

দুপুরের পর থেকে সন্ধ্যার আগমুহূর্ত পর্যন্ত আয়োজকদের কাউকে দেখা না গেলেও রাতে একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও উপস্থিত কয়েক কবি-লেখকের হাতে একটা পানির মগ ও অভিনন্দনপত্র দেওয়ার মধ্য দিয়ে দুই দিনের আয়োজন শেষ করা হয়। অংশগ্রহণকারীদের কোনো যাতায়াত সম্মানীও দেওয়া হয়নি।

৩.

দুই দিনব্যাপী এ অনুষ্ঠানস্থলে ছিলেন নোয়াখালীর কবি ও লোকগবেষক ম. পানা উল্যাহ। তিনি বলেন, ‘এটা কোনো আয়োজনই হয়নি। আমাদের নোয়াখালীতে প্রাণবন্ত ও আনন্দঘন দুই দিনের অনুষ্ঠানেই দুপুরে খাওয়ার আয়োজন ছিল, সকালে ও বিকেলে চা–বিরতি ছিল। সমাপনী দিনে কবি–সাহিত্যিকদের ক্রেস্ট ও উত্তরীয় পরিয়ে দিয়ে কবি-লেখকদের সম্মানিত করা হয়েছে। যাওয়ার সময় খামে পুরে যাতায়াত খরচ বাবদ এক হাজার টাকা এবং যাঁরা প্রবন্ধ লিখেছেন, তাঁদের দুই হাজার টাকা করে সম্মানী দিয়েছেন জেলা প্রশাসক। কিন্তু আপনাদের লক্ষ্মীপুরে এটা কী অনুষ্ঠান হয়েছে! এত কৃপণতা করে! আমার বুঝে আসে না।’

এমনটিই বললেন চট্টগ্রাম থেকে আসা বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক ও কবি ড. আজাদ বুলবুল। তিনি বলেন, ‘আমি বিস্মিত ও হতাশ হয়েছি, লক্ষ্মীপুরের কবিদের মূল্যায়ন করা হয়নি। দুপুরে লাঞ্চ পর্যন্ত করানো হয়নি শুনে আমার ভিরমি খাওয়ার দশা হয়েছে।’

প্রগতি লেখক সংঘের জাতীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য ও বাংলাদেশ রাইটার্স ইউনিয়নের সভাপতি জেলার সর্বজন শ্রদ্ধেয় কবি মুজতবা আল মামুন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেন, ‘শুনেছি, পাঁচ লাখ টাকা বরাদ্দ হয়েছে জেলা সাহিত্য মেলা করার জন্য। কিন্তু লক্ষ্মীপুরে জেলা প্রশাসনের সামগ্রিক অব্যবস্থাপনা, অসংগতিমূলক নানা বিতর্কের মাধ্যমে শেষ করেছেন দুই দিনের এ অনুষ্ঠান। এতে আমি হতাশ। তাই এসবের প্রতিবাদস্বরূপ আমি দ্বিতীয় দিনের সব কর্মসূচি বর্জন করেছি।’

জেলার সাহিত্য সংস্কৃতিসেবী নজরুল একাডেমি লক্ষ্মীপুর জেলা সভাপতি সাংবাদিক ও লেখক সেলিম উদ্দিন নিজামী বলেন, ‘দুই দিনের এ মেলার আয়োজনে যেসব অব্যবস্থাপনা ও অসামঞ্জস্য দেখেছি, তাতে আমি লক্ষ্মীপুরের নাগরিক হিসেবে লজ্জিত ও অনুতপ্ত । এটা লক্ষ্মীপুর জেলাবাসীর জন্য, বিশেষ করে কবি ও সাহিত্যসেবীদের জন্য একটা লজ্জার বিষয়। আমরা সংশ্লিষ্ট প্রশাসন ও কর্তৃপক্ষের নিকট এমনটি আশা করিনি। প্রত্যাশা করি, আগামী দিনের কোনো আয়োজনে আমরা নিজেদের যথাযথভাবে উপস্থাপন করতে সক্ষম হব। এ ছাড়া এ অনুষ্ঠানের আয়োজনেও অব্যবস্থাপনায় যাঁরা নানাভাবে হয়রানির শিকার ও কষ্ট পেয়েছেন, আমি তাঁদের জন্য সমবেদনা প্রকাশ করছি।’

৪.

কবি–সাহিত্যিকেরা আরও অভিমত ব্যক্ত করেন, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী কবি–সাহিত্যিকদের মর্যাদা বৃদ্ধিসহ সাহিত্যচর্চাকে আরও প্রসারিত করার জন্য দেশব্যাপী এমন কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন। কিন্তু লক্ষ্মীপুরে এমন আয়োজন সত্যিই হতাশাজনক।

নির্দেশনা অনুযায়ী জেলা–উপজেলা পর্যায়ে কবি, সাহিত্যিক ও সাহিত্যকর্মীদের মূল্যায়ন করার জন্য, সাহিত্য ও সংস্কৃতিচর্চা তৃণমূল পর্যায়ে বেগবান করার লক্ষ্যে বইমেলা উদ্বোধনীতে বাংলা একাডেমি ও সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়কে নির্দেশনা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তারই ধারাবাহিকতায় জেলা পর্যায়ে পাঁচ লাখ টাকা ও উপজেলা পর্যায়ে তিন লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে বলে জানা যায়।

কবি সাহিত্যিক ও সাহিত্যকর্মীদের নিয়ে জেলা সাহিত্য মেলার আয়োজন করার জন্য। এ সাহিত্য মেলার মূল লক্ষ্য হচ্ছে জেলা-উপজেলাভিত্তিক কবি-সাহিত্যিকদের সাহিত্যচর্চাকে প্রসারিত করে তাদের একত্রিত করে তাদের নাম, ছবি ও প্রকাশনা কর্মের তালিকা ডেটাবেইস আকারে সংরক্ষণ করে জাতীয় পর্যায়ে তুলে ধরা।

কিন্তু লক্ষ্মীপুরে জেলা–উপজেলাসহ প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আসা অধিকাংশ কবি-সাহিত্যিক-সংস্কৃতিসেবীরা অবমূল্যায়িত হচ্ছেন সব সময়। সরকারি এমন আয়োজন প্রশ্নবোধক হবে, তা কবি-লেখক-সাহিত্যিকেরা কখনো ভাবতেই পারেননি।

  • অ আ আবীর আকাশ সাহিত্যকর্মী, লক্ষ্মীপুর
    [email protected]