পেটে খাবার না থাকলে উন্নয়ন দিয়ে কী হবে

অঙ্কের ছাত্র ছিলাম। উচ্চতর শিক্ষায় ছিল হিসাবশাস্ত্র বিষয়। অর্থনীতি ও ব্যবস্থাপনাও ছিল। তাই অর্থনীতির হিসাবটা কমবেশি বুঝি। আর পরিণত বয়সে এসে খুব বেশি বুঝেছি; যখন দেখি আমার মতো সীমিত আয়ের লোকের পণ্য কেনায় খুব একটা সামর্থ্য নেই। অর্থনীতিবিদ টমাস রবার্ট ম্যালথাসের জনসংখ্যা তত্ত্বের মতো আমাদের বাজারে পণ্যমূল্য বাড়ে জ্যামিতিক হারে, গাণিতিক হারে নয়! অর্থনীতিতে সরবরাহ বেশি থাকলে দ্রব্যের মূল্য হ্রাস পায়, সে সূত্রও আমাদের  দেশে কাজ করে না।

সাধারণ মানুষের সহজলভ্য পণ্য আলু কেনাও নাগালের বাইরে এখন। দেশে উৎপাদিত যে আলু মৌসুমে প্রতি কেজি ১৫ টাকায় কেনা যায়, তা না হয় অমৌসুমে দ্বিগুণ হবে। কিন্তু  ৫০ থেকে ৬০ টাকা হবে কোন যুক্তিতে? এখানেও ‘সিন্ডিকেট’! ‘আলুর দোষ’ তাহলে কোল্ডস্টোরেজের মালিক ও আড়তদারদেরও? আলু খাওয়াটাও তাহলে ছেড়ে দেব? বলুন তো, কোন পণ্যের দাম কম? সৎভাবে রোজগারে যাঁরা নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কেনেন, তাঁদের বাজারে গিয়ে হাহুতাশ করা ছাড়া উপায় নেই।

অথচ বাজার ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত আছে জনগণের করে পরিচালিত সরকারের নানা প্রতিষ্ঠান। উচ্চ মূল্যের কারণে আমিষ খাওয়া তো ছেড়ে দিয়েছি প্রায়। নিরামিষ পণ্য কেনারও সামর্থ্য হারিয়ে ফেলেছি। কাঁচা তরকারি কোনোটার এক কেজি সবজির দাম ৬০ টাকার নিচে নেই। সাধ থাকলেও সাধ্য নেই যেন! বাজারে দীর্ঘদিন ধরেই চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে সবজি। ডিম বিক্রি হচ্ছে ডজন ১৫০ টাকায়। মাসাধিককাল ধরে চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে কাঁচা মরিচ। কাঁচা মরিচের কেজির দামও অনেক।  

বিক্রেতা এক কেজির নিচে পণ্য বিক্রি করতে চান না। অতিরিক্ত দামের কারণে আজ দুটি প্রিয় কাঁচা সবজি কিনতে না পেরে বেশ কষ্ট পেয়েছি। বিক্রেতা যে ক্রেতা পাচ্ছেন না, তা তো নয়। সকালে ৫৫ টাকা দিয়ে এক কেজি আলু, আধা কেজি শসা এবং এক কেজি পেঁপে নিয়ে ঘরে ফিরেছি। ফিরতে ফিরতে ভেবেছি, সবজির বাজারও মুনাফাখোর সংঘবদ্ধ (সিন্ডিকেট) চক্রের নিয়ন্ত্রণে?  গা জ্বলেছে ৫৫ টাকায় আলু কিনতে গিয়ে।

কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক কদিন আগে বলেছেন, ‘আলু ও পেঁয়াজের দাম নিয়ন্ত্রণ করতে না পারাটা আমাদের দুর্বল দিক। আমরা পেঁয়াজের দাম নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না, আলুর দামও নয়।’ সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলেছেন, ‘এ নিয়ে সমালোচনা করেন, আমরা মেনে নেব। কারণ, এটা আমাদের দুর্বল দিক, আমাদের সবল দিকগুলোও মিডিয়াতে তুলে ধরুন।’ বাজার পরিস্থিতি নিয়ে নির্বাচনের আগে মন্ত্রীর এমন বক্তব্য স্বাভাবিকই বটে। কিন্তু আলু ও পেঁয়াজের অতিরিক্ত দামে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি নিরসনে সরকার কী কী পদক্ষেপ নিয়েছে, তা তিনি বলেনননি।

আমাদের বাণিজ্যমন্ত্রী নিজেই নাকি একজন ব্যবসায়ী। তিনি ব্যবসায়ীদের ‘সিন্ডিকেশন’ সম্পর্কে বলেছেন, এখানে হাত দিলে বাজার ব্যবস্থাপনা ভেঙে পড়বে। আলোচিত কোনো পণ্যের আমদানির সিদ্ধান্ত সরকার নিলেও বাজারে মূল্য খুব একটা কমে না। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কোনো কোনো পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দিচ্ছে। কিন্তু ব্যবসায়ীরা পাত্তাই দেন না। আজব এই দেশ, যেখানে সরকার পণ্যমূল্য নির্ধারণ করে দেওয়ার পর দ্রব্যের দাম বেড়ে যায়!

কিছুতেই অসাধু ও মুনাফাখোর ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। সিন্ডিকেট ভাঙতে সরকার ব্যর্থ। কৃত্রিম সংকট, অপর্যাপ্ত সরবরাহ এবং নানা অজুহাত দেখিয়ে বাজার অস্থিতিশীল করে যাচ্ছে এই সংঘবদ্ধ গোষ্ঠী। মূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখার জন্য সরকারের নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানগুলো অকার্যকর।

বাজারে দ্রব্যমূল্য স্বাভাবিক রাখা, নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করা এবং ক্রেতার অধিকার বাস্তবায়ন করতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং প্রশাসনের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। ভোক্তা ঠকানো, জালিয়াতি, কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে অতি মুনাফা এবং বাজার অস্থিতিশীল করায় অভিযুক্ত ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে আর্থিক জরিমানা ছাড়া কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখিনি। দেশে রাস্তাঘাট, উড়ালসড়ক এবং পরিবহনব্যবস্থার অভূতপূর্ব উন্নয়ন হয়েছে। পেটে খাবার না থাকলে এ উন্নয়ন দিয়ে কী হবে?

  • প্রণব মজুমদার কবি ও সাংবাদিক