বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারেই বিসিএসের প্রস্তুতি না নিয়ে উপায় কী

সরকারি চাকরির প্রস্তুতি নিতে লাইব্রেরিতে ঢুকতে মধ্যরাত থেকে ব্যাগ রাখার লাইন শুরু হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ফাইল ছবি

বছর দুয়েক আগে এক আলোচনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম বলেছিলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই গ্রন্থাগার কোনো গ্রন্থাগার নয়। গোটা পৃথিবীতে যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভেতরের বই বাইরে এনে শিক্ষার্থীরা মনের আনন্দে পড়তে পারে, সেখানে আমাদের দেশে শিক্ষার্থীরা বাইরের বই ভেতরে নিয়ে যায়।’

অনেকে মনে করতে পারেন, বাইরের বই বলতে তিনি বিসিএসকেন্দ্রিক বাজারি বইকেই নির্দেশ করেন। তিনি জোর দিয়ে বলেন, ‘এই গ্রন্থাগারকে যদি সত্যিকারের গ্রন্থাগার হিসেবে আমরা গড়ে তুলতে চাই, তবে বাইরের বই ভেতরে প্রবেশ করানো বন্ধ করতে হবে। কেউ যদি অন্য বই পড়ে, তবে বাইরে পড়বে, গ্রন্থাগারে নয়।’ মোহাম্মদ আজমের এ চিন্তা যে সুবিবেচনাপ্রসূত, এতে সন্দেহের অবকাশ নেই।

পত্রিকারন্তরে আমরা জানতে পারছি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারে বিসিএসকেন্দ্রিক বই নিয়ে প্রবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা চালু করা হবে বলে ভাবছে কর্তৃপক্ষ। গ্রন্থাগারকে অবশ্যই সব ধরনের গবেষণাবহির্ভূত ও একাডেমিক শিখনের প্রতিবন্ধকতা থেকে রক্ষা করা উচিত। কিন্তু এই চেষ্টা কি সমাজের মধ্যে বিদ্যমান অসুস্থ প্রতিযোগিতা রোধ করতে সক্ষম হবে?

যে সমাজের মানুষ সামান্যতম বিশেষ সুবিধা পাওয়ার জন্য ক্ষমতার সামনে নির্লজ্জ আত্মসমর্পণ করতে দ্বিধাবোধ করেন না, সেই সমাজের তরুণ-তরুণীরা যে সেই ক্ষমতার কেন্দ্রে যেতে চাইবেন, এটাই তো স্বাভাবিক।

আমরা অন্য পেশাগুলোকে সামাজিক ও অর্থনৈতিক মর্যাদার দিক থেকে এতটাই সংকুচিত করেছি যে কোনো তরুণ যদি আজ শিক্ষক হতে চান, তবে সমাজের অন্যরা তাঁর দিকে তাকিয়ে উপেক্ষার হাসি হাসেন। সন্তানের এমন নির্বুদ্ধিতার জন্য তাঁর অভিভাবক বন্ধু মহলে আক্ষেপ করেন।

অন্যদিকে, সারা দেশে প্রতিবছর লাখ লাখ শিক্ষার্থী স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ের শিক্ষা শেষ করছে কিন্তু তাঁরা অধিকাংশই জানেন না লেখাপড়া শেষ করে তাঁদের করণীয় কী। তাঁরা যে শিক্ষা অর্জন করেছেন, তা দক্ষতানির্ভর নয়। তাই চাইলেই কোনো একটা কাজে লেগে পড়া তাঁদের পক্ষে সম্ভব নয়। আবার একই সঙ্গে যে শিক্ষার্থীরা স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে একাডেমিক ক্ষেত্রে ভালো করেছেন, সেই জ্ঞান দেশের উন্নয়নে যে কাজে লাগাবে, সে সুযোগও অবারিত নয়।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে যে পরিমাণ শিক্ষার্থী প্রতিবছর পাস করছেন, সে পরিমাণ কাজ ও কর্মক্ষেত্র রাষ্ট্র তাঁদের দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। এমন হযবরল পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীরা উপায়ান্তর না পেয়ে অনেকটা বাধ্য হয়েই সরকারি চাকরিমুখী হয়ে পড়ছেন। এতে যদি সমাজকে সন্তুষ্ট করা বা মা-বাবার মলিন মুখে হাসি ফোটানো যায়!

রাষ্ট্র প্রতিবছর নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করছে, এতে উচ্চশিক্ষার পরিমাণগত বৃদ্ধি ঘটলেও গুণগতমানের উন্নয়ন হচ্ছে কী? এ প্রশ্ন এখন সময়ের দাবি। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চাহিদা পূরণে বাজারব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটছে। সেই বাজারের চাহিদা পূরণে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আদো সক্ষম কি?

প্রতিবছর কোটি কোটি টাকা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পেছনে রাষ্ট্র ব্যয় করছে অথচ সেই রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য যে জ্ঞান প্রয়োজন, সেই জ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়গুলো উৎপাদন করতে পারছে না। বিভিন্ন পত্রিকার মাধ্যমে জানা যায়, দেশের নানা বিশেষায়িত কাজের জন্য অন্য দেশ থেকে বিশেষজ্ঞ নিয়ে আসা হয়। অবিরত যদি তাই করা হয়, তাহলে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কোন চাহিদা পূরণের জন্য টিকে আছে? আর জনগণই-বা কেন সেসব বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যয়ভার বহন করছে?

আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যদি বাজার চাহিদা বিবেচনা করত, সেই চাহিদা অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ঢেলে সাজাত, সমাজ যদি সব পেশাকে সামাজিকভাবে মর্যাদার মনে করত, কোনো বিশেষ পেশায় যদি বিশেষ সুবিধা গ্রহণের সুযোগ না থাকত, আর্থিকভাবে যদি সব পেশা স্বাবলম্বী হতো, তবে এই অসুস্থ প্রতিযোগিতা থাকত না। বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে কেউ হয়তো-বা বিসিএস পড়তেন না।

আব্দুল্লাহ আল মামুন
শিক্ষার্থী, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়