একটা কাককে মারলে দলে দলে কাক এসে গলা ফাটিয়ে বিক্ষোভ জানায়। একজন শ্রমিককে লাঞ্ছিত করলে তার সহযোগীরা রাস্তা অচল করে দিয়ে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ করে। অন্যান্য পেশাজীবীদের ক্ষেত্রেও তেমনটি আমরা দেখতে পাই। এ-ক্ষেত্রে শিক্ষক সমাজই কেবল ব্যতিক্রম। একজন শিক্ষককে লাঞ্ছিত করলে, তাঁর হাত-পা ভেঙে দিলেও না-হয় প্রতিবাদ, না-পাওয়া যায় প্রতিকার। তাঁর স্বজাতি ভাবে, ‘এতে আমার কী আসে যায়’। অন্যরা ভাবে, ‘আগ বাড়িয়ে কেন যাবো ; যাদের ঘর, তারাই সামলাক।’
‘শিক্ষক-নিগ্রহ’ এটা যেন আমাদের দৈনন্দিন জীবনে স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবেই গণ্য হয়ে গেছে। প্রথমে একটুখানি হইচই হয়, দু’একটি বিবৃতি বা ‘প্রতীকী কর্ম-বিরতি’র সংবাদ পাওয়া যায়। এরপর ‘যথা পূর্বং তথা পরং’, সবকিছু ভুলে গিয়ে ‘ঝাঁকের কই ঝাঁকে মিশে’ প্রাত্যহিক জীবন-যাপনে ফিরে যায়।
কিন্তু এবার, বিশেষত গত মার্চ মাস (২০২২) থেকে আমাদের অভ্যস্ত-জীবন বড় রকমের টানা কয়েকটি ঝাঁকুনি খেলো ; ‘মার খেয়ে হজম করায় অভ্যস্ত’Ñসর্বংসহা শিক্ষকেরা আর বুঝি ‘বুকের কান্না’ গোপন করে রাখতে পারলেন না। তাঁরা খবরের শিরোনাম হলেন, কেউ কেউ শিরোনামে আসতে বাধ্যও হলেন।
এ-সব অবিশ্বাস্য অভাবিত ঘটনাপ্রবাহের খতিয়ান হচ্ছে: ‘মুন্সিগঞ্জের রামকুমার উচ্চ বিদ্যালয়ের বিজ্ঞান-শিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মণ্ডলকে গ্রেপ্তার করা হলো; তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ শ্রেণিকক্ষে পাঠদানকালে তিনি নাকি ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হেনেছেন। সে-অভিযোগের যথার্থতা বিচার করবার আগেই তাঁকে ‘কারাবাসে’ পাঠানো হলো এবং পক্ষাধিককাল পর ‘জামিন’ পেয়ে তিনি আবার প্রত্যাবর্তন করলেন তাঁর প্রিয় স্থান শ্রেণিকক্ষে। পরের ঘটনাস্থল গফরগাঁও সরকারি কলেজ, সেখানে ‘নগদপ্রাপ্তি’ থেকে হঠাৎ-বঞ্চিত কয়েকজন, কলেজ-প্রশাসনকে একটু ‘শিক্ষা’ দিতে চাইলো। এর সূত্র ধরে তারা ‘কলেজ-আধিকরিকদের’ সাথে ধাক্কাধাক্কি করলো, ওঁদেরকে কলেজ কক্ষে সারা দিন অবরুদ্ধ করে রাখলো। বিপন্ন শিক্ষক সমাজকে উদ্ধার করার জন্য না প্রশাসন, না জনপ্রতিনিধি কারো কোনো সাড়া পাওয়া গেলো না। পরের ঘটনাস্থল নড়াইল জেলার মির্জাপুর ইউনাইটেড কলেজ, সেখানেও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগে হ্যান্ডমাইকে ঘোষণা দিয়ে লোক জড়ো করা হলো এবং ওই কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসের গলায় জুতার মালা পরিয়ে পুলিশ-পরিবেষ্টিত অবস্থায় তাঁকে থানা-অবধি নিয়ে যাওয়া হলো।
এবারের ঘটনাস্থল ঢাকার সাভারের হাজী ইউনুছ আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজ। সেখানে এক ছাত্রের হামলায় নিহত হন সহকারী অধ্যাপক উৎপল কুমার সরকার। মৃত্যুমাত্রই শোক ও যন্ত্রণার-বিষয়। এ-যন্ত্রণার মধ্যেও ঘটনার কয়েকটি দিক আমাদেরকে নতুন করে ভাবালো। মনের গভীরে প্রশ্ন জাগলো, উৎপল সরকার কি মরে গিয়ে বেঁচে গিয়েছেন? তিনি যদি ছাত্রের আঘাতে বিছানায় পড়ে কাতরাতেন কিংবা পঙ্গু-হয়ে ‘মৃতবৎ বেঁচে থাকতেন’, তা হলে আমাদের ‘সর্বংসহা’ চরিত্র কি বিন্দুমাত্রও তরঙ্গায়িত হতো? তাঁর পক্ষ হয়ে ‘বিচার-চাওয়া’ কণ্ঠগুলো রাস্তায় নেমে এসে মোটেও কি সোচ্চার হতো ? না, হতো না, হতো না। ক্রিকেট-স্ট্যাম্পের আঘাতে উৎপলের কষ্টকর মৃত্যু এবং ওই মৃত্যুই যেন কিছু সংখ্যক মানুষের বিবেককে ‘অপরাধী’ হিসেবে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। আমাদের ভাবনা-বিন্দুর গতিপথ একটুখানি বদলে দিয়েছে।
ভাবনার ওই নতুন প্রেক্ষণবিন্দু আমাদেরকে আর একটা কঠিন ও কঠোর সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। এসব ঘটনার অভিন্ন দুই প্রতিপক্ষ ; নির্যাতিত পক্ষের নাম শিক্ষক, পীড়নকারী পক্ষের নাম শিক্ষার্থী (শিক্ষার্থীর সহযোগী শক্তি হিসেবে অন্য কেউ থাকলেও এরা কাজ করেছে প্রভাবক হিসেবে, মূল শক্তি হিসেবে নয়)। ব্যাপারটা ভাবতে গিয়ে শোচনীয় বিভ্রমের মধ্যে পড়ে যাই, এ কী অবস্থা আমাদের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর ? শিক্ষক যাদের কাছে ‘গুরুতুল্য’, ‘প্রাতঃনমস্য’ হিসেবে গণ্য হওয়ার কথা, তারাই হয়ে গেছে শিক্ষকের প্রধান প্রতিপক্ষ ? তারা শিক্ষককে সম্মান না দিয়ে সম্মান-হরণে মরিয়া হয়ে উঠেছে? কিন্তু কেন?
২.
মাছের পচন ধরে মাথা থেকে, সমাজের ক্ষেত্রেও তাই। ছাত্রছাত্রীরা সমাজের মাথা তো নয়ই, বোধকরি দেহের মধ্যভাগও নয়। কাজেই তাদের উগ্র, উন্মত্ত, বীভৎস রূপের মধ্য দিয়ে আমাদের নবীন-প্রজন্মের চিন্তাচেতনায় যে পচন-প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, এর স্বরূপ এবং কেন্দ্রস্থল সম্পর্কে আমাদেরকে সবিশেষ মনোযোগ দিতে হবে। কিন্তু কীভাবে ?
বিজ্ঞান বলে, বেশ কটা ছোট ছোট ভূমিকম্প মিলে (ঘটে) পূর্বাভাস দিয়ে যায় যে, বড়ো ভূমিকম্প আসন্নপ্রায়। আমাদের সামাজিক ঘটনাপ্রবাহের অভিঘাতগুলোÑবিজ্ঞান-বিচ্ছিন্ন প্রপঞ্চ নয়। কয়েকটি ছোট ঘটনা (মুন্সিগঞ্জ, গফরগাঁও প্রসঙ্গ) ইঙ্গিত দিয়ে যাচ্ছিল বড়ো ঘটনা আসন্নপ্রায় (উৎপল-হত্যা)। যথাযথ উদ্যোগ নিতে আমাদের অনেক দেরি হয়ে গেছে, তবুও বিশ্বাস করি, ‘লেট ইজ বেটার দেন নেভার’।
যে-যাই বলুন, এটা অস্বীকার করবার উপায় নেই, শিক্ষকের সামাজিক মর্যাদা ও সম্মান বহুকাল আগেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে (এ-প্রসঙ্গে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক খ্যাতিমানসম্পন্ন পদার্থবিদ অরুণ কুমার বসাকের ‘ভিটে-দখল’-সংক্রান্ত ঘটনাটি মাথায় রাখুন)। হাটে-বাজারে, ট্রেনে-বাসে, অফিস-আদালতে শিক্ষক যেন অন্ত্যজ অপেক্ষাও অন্ত্যজতর। হারাধনের দশটি ছেলের মধ্যে সর্বশেষ ছেলেটি শিক্ষার্থী, যার উপর ভরসা বা নির্ভর করা যেতো, কালক্রমে সে-ও এখন প্রতিপক্ষের ভূমিকায় চলে গিয়েছে ; কিন্তু কেন? এ-বিপর্যয়ের পেছনে অনেকেরই অনেক দায় আছে, কিন্তু এর ভেতরে শিক্ষকের কি কোনো দায়ই নেই?
৩.
গত ২ জুলাই, ‘নিজের বাসা’র ভেতরে হামলার শিকার হয়েছেন প্রখ্যাত লেখক, নাট্যকার ড. অধ্যাপক রতন সিদ্দিকী। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তড়িৎ-সহযোগিতা তাঁকে ওই সঙ্ঘবদ্ধ আক্রমণ থেকে রক্ষা করেছে। যথাযথ সহযোগিতা যথাসময়ে না-পেলে রতন সিদ্দিকীর ভাগ্যে কী ঘটতো, ভাবতে গেলে শিউরে উঠতে হয়। ক’দিন যেতে না যেতেই ‘শিক্ষক-নির্যাতনের’ অতি চমকপ্রদ ঘটনা ঘটে গেছে, রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে। সারা দেশের সংবাদ-মাধ্যমে প্রচারিত হলো, গত ৭ জুলাই রাজশাহী-১ আসনের সংসদ সদস্য কর্তৃক বেধড়ক পিটুনির শিকার হয়েছেন রাজাবাড়ী ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ সেলিম রেজা। কিন্তু কী আশ্চর্য, ১৪ জুলাই সংবাদ সম্মেলন করে অধ্যক্ষ সেলিম রেজা জানালেন, না, ওই দিন সংসদ সদস্য তাকে লাঞ্ছিত করেননি, কোনো কটু কথাও বলেননি। তবে হ্যাঁ, ওই দিন তাঁর উপস্থিতিতে কয়েকজন অধ্যক্ষ মিলে হাতাহাতি করেছেন, ধাক্কাধাক্কি করেছেন। ওই শিশুতুল্য ঝগড়াকালে তিনি আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছেন; এতে এমপি মহোদয়ের কোনো দোষ নেই, তিনি নিষ্পাপ, পবিত্র! তো ওই ১৪ তারিখের সংবাদ সম্মেলনে অধ্যক্ষ সেলিম রেজার বক্তব্য-শোনবার পর আমাদের সন্দেহ রইলো না যে, মহান সংসদ সদস্যর চরিত্র ‘সত্যি সত্যিই ফুলের মতো পবিত্র।’
চারদিকের ঘটনাবলি শিক্ষকদের উদ্দেশ্যে এই অশনি-সংকেত দিচ্ছে যে—মার খেলেও, সে-কথা বলা যাবে না ; আর কে মেরেছে সেটা কুক্ষণেও মুখে আনা যাবে না, শিক্ষক হিসেবে মান-সম্মান-শ্রদ্ধা, এটা এখন গৌণ বিষয় মূখ্য বিষয় হলো লাঞ্ছনা-নির্যাতন এড়িয়ে অক্ষতদেহে বেঁচে থাকা। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ’র লালসালু উপন্যাসের রহিমার কথা কিঞ্চিৎ বদলে দিয়ে চিৎকার করে বলতে চাই, ‘মান-সম্মান দিয়া কি হইব, মানুষের জান যদি না থাকে।’
বিধান মিত্র অধ্যাপক, নেত্রকোনা সরকারি কলেজ, নেত্রকোনা।