আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার দৃশ্যমান এবং পরিসংখ্যানিক উন্নতিগুলো যে কাউকে সম্মোহিত করার যথেষ্ট শক্তি রাখে। পাবলিক পরীক্ষায় পাসের হার বাড়ছে শনৈঃশনৈঃ গতিতে, সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে অর্জিত সনদের ওজন ও ‘বাজারি’ উজ্জ্বলতা। বস্তুত আমাদের দেশে সনদ, মেধা ও প্রজ্ঞাকে একাকার করে দেখা হয়। উজ্জ্বল সনদধারীকেই গণ্য করা হয় মেধাবী ও জ্ঞানী হিসেবে। কিন্তু স্বাস্থ্য বেশি থাকা যেমন সুস্বাস্থ্যের লক্ষণ নয়, তেমনি জোছনা-সুরভিত ভারী সনদও জ্ঞান ও মেধার যথাযথ প্রতিভূ নয়। দুর্ভাগ্যজনক বিষয়, আমাদের শিক্ষার্থীরা স্ফীত গ্রেড বা ভারী সনদ অর্জনে যত না দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, জ্ঞানার্জনে ঠিক ততটাই নিস্পৃহ।
এই তো মাত্র কদিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স ভর্তি পরীক্ষার (শিক্ষাবর্ষ ২০২১-২২) ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। এ ফলাফল বস্তুত আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার একটা শোচনীয় দুর্বলতাকে সামনে নিয়ে এসেছে। পরীক্ষাটি দুটি ভাগে বিভক্ত ছিল। প্রথম অংশে ছিল ৬০ নম্বরের এমসিকিউ পরীক্ষা। এ অংশে শর্ত ছিল, বাংলা ও ইংরেজি বিষয়ে (কমবেশি ১৫ নম্বরের মধ্যে) ন্যূনতম ৫ নম্বর করে পেতে হবে। আর সাধারণ জ্ঞানে (কমবেশি ৩০ নম্বরের মধ্যে) পেতে হবে ন্যূনতম ১২ নম্বর। এমসিকিউয়ের ৬০ নম্বরের মধ্যে উল্লিখিত তিন বিষয় মিলিয়ে যাঁরা সাকল্যে ২৪ নম্বর পাবেন, কেবল তাঁদেরই ৪০ নম্বরের লিখিত পরীক্ষার খাতা মূল্যায়ন করা হবে এবং ওই দুই (এমসিকিউ ও লিখিত) অংশ মিলিয়ে যাঁরা ৪০ নম্বর করে পাবেন, তাঁদেরকেই ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হিসেবে বিবেচনা করা হবে।
এ শর্তসাপেক্ষে ক ইউনিটে (বিজ্ঞান বিভাগ) উত্তীর্ণ হয়েছেন ১০ দশমিক ৩৯ শতাংশ শিক্ষার্থী (২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষে ছিল ১০ দশমিক ৭৬ শতাংশ)। খ ইউনিটে (মানবিক) শিক্ষার্থী উত্তীর্ণের হার ৯ দশমিক ৮৭ (২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষে ছিল ১০ দশমিক ৭৬ শতাংশ)। গ ইউনিটে (ব্যবসায় শিক্ষা) উত্তীর্ণ হয়েছেন ১৪ দশমিক ৩০ শতাংশ শিক্ষার্থী (২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষে ছিল ২১ দশমিক ৭৫ শতাংশ)। ঘ ইউনিটে (সমন্বিত বিভাগ) উত্তীর্ণ হয়েছেন ৮ দশমিক ৫৮ শতাংশ শিক্ষার্থী (২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষে ছিল ৯ দশমিক ৮ শতাংশ)। ১০০ নম্বরের পরীক্ষায় ক ইউনিট থেকে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছেন ৩ জন—৯৫ করে। খ ইউনিটে প্রাপ্ত সর্বোচ্চ নম্বর ৭৬ দশমিক ৫০। গ ইউনিটে প্রাপ্ত সর্বোচ্চ নম্বর ৯৬ দশমিক ৭৫। ঘ ইউনিটে (সমন্বিত বিভাগ) বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগ থেকে প্রাপ্ত সর্বোচ্চ নম্বর যথাক্রমে ৮৩ দশমিক ৯৫, ৮৪ ও ৭৩ দশমিক ১০।
যাঁরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন, সনদের উজ্জ্বলতা ও পুরুত্বে তাঁরা কেউই কমজোরি ছিলেন না। উপরন্তু তাঁদের অধিকাংশই কয়েক মাস ধরে বিভিন্ন ‘শিউর সাকসেস কোচিং সেন্টার’ থেকে ব্যয়বহুল পাঠ গ্রহণ করেছেন। এর সঙ্গে ‘বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্র মেদিনী’ মনোভাব নিয়ে সবাই ওই ভর্তিসমরে অংশ নিয়েছেন। এ পরীক্ষায় বিভিন্ন ইউনিটে যাঁরা সর্বোচ্চ বা এর কাছাকাছি নম্বর পেয়েছেন, তাঁদের ওই মহিমান্বিত অর্জন দুটি তথ্য জানান দিচ্ছে। এক, ‘কষ্ট করলে কেষ্ট মেলে’। দুই, ওই ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র পরীক্ষার্থীকে বিপাকে ফেলার জন্য তৈরি হয়নি (এমনটা হলে প্রথম, দ্বিতীয় বা মেধাতালিকায় স্থানপ্রাপ্তরা এত বেশি নম্বর পেতেন না)। কথা হলো, কষ্ট করলেই যদি কেষ্ট মেলে এবং ওই ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র যদি ‘খুব কঠিন’ না হয়ে থাকে, তা হলে বিপুলসংখ্যক কথিত মেধাবী পরীক্ষার্থী ওই পরীক্ষাতে অকৃতকার্য হলেন কেন?
দুই.
অস্বীকার করার উপায় নেই, আমাদের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা সর্বতোভাবে ‘পরীক্ষামুখী’, স্পষ্টত ‘নম্বর’ বা ‘সনদমুখী’। এ শিক্ষাতে ‘জ্ঞান বা বোধের বিস্তৃতি’ গৌণ, ভারী সনদ অর্জনই মুখ্য বিষয়। এ শিক্ষা তথ্য মুখস্থ করায়, তত্ত্ব বিশ্লেষণে মনোযোগ দেয় না। তাই প্রাতিষ্ঠানিক বা পাবলিক পরীক্ষায় আমাদের শিক্ষার্থীরা মুখস্থ করা তথ্য উদ্গিরণ করে দিয়ে চোখধাঁধানো নম্বর পেয়ে যান। কিন্তু যে পরীক্ষার সঙ্গে মুখস্থ তথ্যের সম্পর্ক কম, যেখানে উত্তর লিখতে হয় জ্ঞান বা বোধের অক্ষরসহযোগে, আমাদের কথিত মেধাবী শিক্ষার্থীরা সেখানে যেন দুচোখ দিয়ে কেবলই শর্ষে ফুল দেখতে থাকেন।
মুখস্থনির্ভর শিক্ষার যে ধারাটি আজ আমাদের দেশে বিপর্যয় ডেকে আনছে, এটা হাঁটি হাঁটি পা পা করে যাত্রা শুরু করেছিল বহুকাল আগেই। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর বিখ্যাত রচনা ‘ধর্মতত্ত্ব’-এ আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটি নির্দেশ করে বলেছিলেন, ‘মুখস্থ কর, মনে রাখ, জিজ্ঞাসা করিলে যেন চটপট করিয়া বলিতে পার। তারপর বুদ্ধি তীক্ষ্ণ হইল, কি শুষ্ক কাষ্ঠ কোপাইতে কোপাইতে ভোঁতা হইয়া গেল, স্বশক্ত্যবলম্বিনী হইল, কি প্রাচীন পুস্তক-প্রণেতা এবং সমাজের শাসনকর্তৃরূপ বৃদ্ধ পিতামহীবর্গের আঁচল ধরিয়া চলিল, জ্ঞানার্জনী বৃত্তিগুলি বুড়ো খোকার মতো কেবল গিলাইয়া দিলে গিলিতে পারে, কি আপনি আহারার্জনে সক্ষম হইল সে বিষয়ে কেহ ভ্রমেও চিন্তা করেন না। এই সকল শিক্ষিত গর্দ্দভ জ্ঞানের ছালা পিঠে করিয়া নিতান্ত ব্যাকুল হইয়া বেড়ায় বিস্মৃতি নামে করুণাময়ী দেবী আসিয়া ভার নামাইয়া লইলে, তাহারা পালে মিশিয়া স্বচ্ছন্দে ঘাস খাইতে থাকে।’
তিন.
একসময় আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় গুরু-শিষ্যের সম্পর্কটি পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ ছিল। সেখানে শিক্ষক ছিলেন উদার, নির্লোভদাতা আর শিষ্য ছিলেন প্রশ্নহীন অনুগত গ্রহীতা। কালান্তরে শ্রদ্ধা-ভক্তি, নীতি-নৈতিকতাকে পাশে ঠেলে অর্থ যখন সমাজ নিয়ন্ত্রকের অন্যতম উপাদান হয়ে উঠল, তখন থেকে শিক্ষাও পরিগণিত হতে থাকল বিনিময়যোগ্য পণ্য হিসেবে।
রবীন্দ্রনাথের লেখাতে পাই সে হতাশা ও আক্ষেপের অনুরণন, ‘আজকাল প্রয়োজনের নিয়মে শিক্ষকের গরজ ছাত্রের কাছে আসা, কিন্তু স্বভাবের নিয়মে শিষ্যের গরজ গুরুকে লাভ করা। শিক্ষক দোকানদার, বিদ্যাদান তাঁহার ব্যবসায়। তিনি খরিদ্দারের সন্ধানে ফেরেন। ব্যবসাদারের কাছে লোকে বস্তু কিনতে পারে, কিন্তু তাহার পণ্য তালিকার মধ্যে শ্রদ্ধা নিষ্ঠা প্রভৃতি হৃদয়ের সামগ্রী থাকিবে এমন কেহ প্রত্যাশা করিতে পারে না। এই প্রত্যাশা অনুসারেই শিক্ষক বেতন গ্রহণ করেন ও বিদ্যাবস্তু বিক্রয় করেন এইখানে ছাত্রের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক শেষ।’ (শিক্ষা সমস্যা: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)।
সত্যিই তা-ই। এখনকার শিক্ষক-শিক্ষার্থী সমাজবিচ্ছিন্ন আলাদা বৈশিষ্ট্যের কেউ নন। দুজনই দুজনের কাছে ‘গড় মানুষ’, শিক্ষার্থী বিদ্যার ক্রেতা, শিক্ষক বিদ্যা বিক্রেতা। ক্রেতার সাধারণ প্রবণতা হলো, বাজার যাচাই করে অপেক্ষাকৃত সস্তা দরে পণ্য কেনা। বিক্রেতার সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো, অধিক মুনাফা খোঁজা। বর্তমান কারবারির যুগে যেখানে ‘সবার ওপরে মুনাফা সত্য’, সেখানে শিক্ষক কখনো নিজের ঘরে (প্রাইভেট টিউটর হিসেবে) কখনোবা কোচিং সেন্টারে তাঁর পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসে থাকেন। শিক্ষা ক্রেতারা নিজেদের সুবিধামতো জায়গায় গিয়ে অর্থের বিনিময়ে সে পণ্য কিনে নিয়ে আসেন। যেসব ছাত্রের হাতে খুব বেশি টাকা নেই, অর্থাৎ যাঁরা অঢেল অর্থ ঢেলে বিদ্যা ক্রয় করতে অসমর্থ, তাঁরাও কিন্তু শ্রেণিমুখী বিদ্যার্জনে আগ্রহ দেখান না। তাঁদেরকে বিদ্যার্জনের শর্টকাট রাস্তা দেখানোর জন্য আমাদের করিতকর্মা শিক্ষাব্যবসায়ীরা বাজারে ছেড়েছেন ‘শিউর সাকসেস’ বা ‘শেষ সম্বল’-জাতীয় গাইড বা নোটবই। কম খরচ করে অথবা কম কষ্ট করে যদি ‘রেডি’ উত্তরপত্রের পাশাপাশি ভালো নম্বরপ্রাপ্তির সুযোগ পাওয়া যায়। তবে ‘বাঙালি নন্দনদের’ মধ্যে কে যায় মাথার ঘাম পায়ে ফেলে বিদ্যার্জনের কঠিন ঝামেলায়?
চার.
অপ্রিয় হলেও এটাই সত্য যে বর্তমান সময়ে ‘শ্রেণি শিক্ষা কার্যক্রম’ ক্রমে গুরুত্ব হারিয়ে ফেলছে। শিক্ষার্থীর লক্ষ্য যেহেতু ‘ভালো গ্রেড অর্জন’ আর ‘সীমিত পরিসরের সিলেবাস’ পড়েই ওই ‘গ্রেড’ অর্জন করা যায়, তাই শ্রেণিকক্ষের ‘সার্বিক পাঠ’ শিক্ষার্থীমাত্রকেই এড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। বিপরীতে ‘সীমিত পরিসর’-এর সিলেবাসের পাঠকে ‘অনায়াসসাধ্য’ করার জন্য হয় তাঁরা ‘প্রাইভেট টিউটর’, নয়তো ‘কোচিং সেন্টার’ অভিমুখে ছুটে যান। এতে ‘পাবলিক পরীক্ষায়’ তাঁরা ভালো নম্বর পান বটে, কিন্তু যেখানে ‘মৌলিক জ্ঞান ও বোধের’ পরীক্ষা দিতে হয়, সেখানে তাঁরা যে শোচনীয় পরিণতির সম্মুখীন হন, বস্তুত সে করুণ চিত্রটিরই প্রতিফলন ঘটেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার ফলাফলে।
বিধান মিত্র অধ্যাপক, নেত্রকোনা সরকারি কলেজ, নেত্রকোনা।