সুস্থ সংস্কৃতিচর্চার মাধ্যমেই গড়তে হবে আলোকিত মানুষ

বর্তমান সমাজ যে ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে, তার থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে সমাজের আলোকিত মানুষগুলোকে সামনে এগিয়ে আসতে হবে। সামাজিক সভ্য সংস্কৃতি আজ প্রায় ধ্বংসের মুখে। আমাদের তরুণ প্রজন্ম অস্থির সময় পার করছে। ভিন্ন সংস্কৃতির আগ্রাসনে দোলাচলে ভাসছে, বিভ্রান্ত হচ্ছে। ভালো-মন্দ বিচার করতে গিয়ে সংকটে পড়ছে। সঠিক পথ বেছে নিতে গিয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের দিকনির্দেশক হতে পারেন আলোকিত মানুষেরা। সুস্থ সংস্কৃতিচর্চার মাধ্যমেই আলোকিত মানুষ গড়া সম্ভব। সব অপশক্তিকে প্রতিহত করার অন্যতম উপায় হলো সুস্থ সংস্কৃতিচর্চা। তাই সব অপশক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়াতে সংস্কৃতিচর্চার কোনো বিকল্প নেই।

অনেক রসবৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ আমাদের মাতৃভূমি বাংলাদেশ। অজস্র গ্রামগঞ্জে গাথা আমাদের এ প্রিয় দেশ। সহজ–সরল গ্রাম্য মানুষের আচার, আচরণ, অভ্যাস, স্মৃতি, সংস্কার, কুসংস্কাররিদ্ধ ইতিহাস–ঐতিহ্যের রূপকথা দ্বারা নির্মিত আমাদের মাতৃভূমি বাংলাদেশের প্রকৃত পরিচয়। আমাদের শিকড় সংস্কৃতি ছাড়া দেশের ইতিহাস পরিপূর্ণতা দাবি করতে পারে না। তাই অকৃত্রিম ও সব ইতিহাসের মা আবহমান গ্রাম-বাংলার সংস্কৃতিকে জানা প্রয়োজন। আমাদের দেশের অন্তর্দৃষ্টি মেলে জানতে হলে তার গ্রামীণ মানুষ, তার ভাষা–সাহিত্য, লৌকিক শিল্পপ্রকৃতি, তার গ্রামীণ সমাজকে অবশ্যই বাস্তব দৃষ্টিতে অকপটে নিরীক্ষণ করা চাই। ঐতিহাসিক, ভৌগোলিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও জনগোষ্ঠীর নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যের পটভূমিতে আমাদের গ্রামীণ জীবন বিবেচ্য। লৌকিক প্রতিবেশে লোকজীবনের ভাষা–সাহিত্য, সংগীত, নৃত্যনাট্য, শিল্প, ধর্মবিশ্বাস, উৎসব–পার্বণ ইত্যাদি বহু বিচিত্র অভিব্যক্তি যুক্ত এবং আদি পল্লীজীবন ও আরণ্য জনপদই সেই আবহমান সংস্কৃতির শিকড়ের লালনক্ষেত্র।

বোধ করি মানুষ ও তার পারিপার্শ্বিক বিচিত্র ও সচেতন সহযোগিতার ব্যাপার নিয়ে আমাদের সাংস্কৃতিক জগৎ। বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল কৃষিপ্রধান দেশের শতকরা ৭০ জনই খেতখামার করে জীবিকা নির্বাহ করে। নিতান্ত অশিক্ষিত বা অর্ধশিক্ষিত যাঁরা, তাঁদের অধিকাংশ বাংলার পল্লিতে কৃষি ও অন্যান্য সামান্য ছোট কাজকর্ম করে জীবিকা চালান। গ্রামপ্রধান বাংলাদেশের সিংহভাগ লোকই বহির্জগতের সুন্দর সুশিক্ষিত পরিবেশ থেকে বঞ্চিত। তবু আছে তাঁদের জীবনচর্যা, জীবনের সুখ–দুঃখ, সমাজ, ধর্ম, দেহমনের বিবিধ ভাবনা। আর এরই ফল হলো আমাদের গ্রাম–বাংলার আবহমান সংস্কৃতি। সত্যি বলতে কী, আমাদের পুরো দেশটাই হলো গ্রামীণ সংস্কৃতির দেশ। এ দেশ লোকসাহিত্যের দেশ, এখানে রয়েছে ভাটিয়ালির ভাটির স্রোতের গান, শাশ্বত বাংলার ফসল তোলার গান, নানা রকম লোকজ উৎসব। নগরজীবনেও আমাদের সুস্থ সংস্কৃতির বাস্তব প্রতিভাস একেবারে অনুপস্থিত নয়। কাজের তাগিদে বাংলাদেশের পল্লির সাধারণ অনেক মানুষই শহরের গণ্ডিবদ্ধ জীবনে বাস করতে বাধ্য। মুচি, মেথর, ডোম, কুলিকামিন, শ্রমিক, মজুর, রিকশাওয়ালা, অশিক্ষিত অমার্জিত দোকানদার, হকার ইত্যাদি শ্রেণির লোক কিন্তু গ্রামের আবেষ্টনী থেকে বিচ্যুত হলেও তাঁদের মনমেজাজ, চিন্তাচেতনা গ্রামীণ প্রতিবেশের ওপর নির্ভরশীল।

তাঁদের পূর্বপুরুষের ঐতিহ্য অনুযায়ী তাঁরা নগরজীবনের পাশাপাশি গ্রামীণ সাংস্কৃতিক জীবনের বিবিধ ভাব প্রদর্শন করতে সব সময়ই উন্মুখ। এ দিক থেকে গ্রাম–বাংলার আবহমান সাংস্কৃতিক জীবনের নানা প্রতিচ্ছবির আনাগোনা আধুনিকতম শহুরে জীবনেও অনেকখানি উপস্থিত বলে প্রতীয়মান হয়। তবু আমাদের দেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ধর্মের নামে বিভিন্ন সন্ত্রাস চলছে প্রতিনিয়ত। সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও মানুষ হত্যা সারা বিশ্বে এখন আতঙ্কের বিষয়। একটি দেশের অন্যতম চালিকা শক্তি হলো সে দেশের আগামী প্রজন্ম। এই প্রেক্ষাপটে আমাদের দেশের আগামী প্রজন্মকে সুস্থ সাংস্কৃতিক মূলধারায় আনা প্রয়োজন। তাই সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমনে দেশে একটি সাংস্কৃতিক গণজাগরণ তৈরি করতে হবে। জেলা-উপজেলায় শিল্পকলা একাডেমি-শিশু একাডেমিগুলো এখন ঘুমাচ্ছে, তাদের জাগিয়ে তুলতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ও বিতর্ক প্রতিযোগিতার মতো সহশিক্ষা কার্যক্রম জোরদার করতে হবে।

নিয়মিতভাবে বাঙালি বা জাতিসত্তার সংস্কৃতিচর্চা থাকতে হবে। একটা জাতির মানবিক গঠনের পেছনে তাই আবহমান সংস্কৃতির গুরুত্ব অপরিসীম। এই অস্থির সময়ে আমাদের আগামী প্রজন্মকে তাই সুস্থ সাংস্কৃতিক ধারায় ফিরিয়ে আনতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অনুপ্রাণিত করতে হবে। তাদের গড়ে তুলতে হবে আলোকিত মানুষ হিসেবে।

সুপ্রতিম বড়ুয়া

সহযোগী অধ্যাপক,

রামু সরকারি কলেজ

রামু, কক্সবাজার