সামসুল ওয়ারেস: গুরুর জন্মদিনে

স্থপতি সামসুল ওয়ারেস

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপত্যের প্রথম ক্লাস সেই ১৯৮৪ সালের শেষের দিকে। খানিক বাবরি চুলে চওড়া কাঁধ আর মধ্য উচ্চতার ঋজু ও গম্ভীর এক শিক্ষক প্রথম দর্শনেই ভক্তিজাগানিয়া অনুভূতি জাগ্রত করলেন সবার ভেতর। তারপর ধীরে ধীরে তিনি আমাদের আবিষ্ট করলেন কখনো নান্দনিক দর্শনে, কখনো সংগীতে, ইতিহাস-ঐতিহ্যে কিংবা কৃষ্টি-সংস্কৃতির বহুমাত্রিকতায়, কিন্তু সর্বদা দেশজ চিন্তনে। সেই থেকে তাঁর হাত ধরেই, পথ হাঁটতে লাগলাম পথভ্রষ্ট না হওয়ার তাগিদে। তিনিই আমাদের শিক্ষক গুরু সামসুল ওয়ারেস। জন্ম তাঁর ১৯৪৬ সালের ২১ জানুয়ারি।

হিমায়িত সংগীতের উপমায় স্থাপত্যের অবয়ব অনুভব করা কিংবা চোখ দুটো মুদে ‘এক্সপ্রেশনিজম’, কখনো বা বুঁদ হয়ে অর্ধনিমীলিত চোখে ‘ইম্প্রেশনিজম’ দর্শনের শিল্পচর্চার বোধকে উপলব্ধির প্রয়াস, তাঁর কাছ থেকেই শেখা।

জীবনের সংবেদনশীল উপলব্ধি থেকে শুরু করে দায়িত্বশীল জীবনাচরণের মাধ্যমে স্থাপত্যের অনুভব আর চর্চার পাঠও অনেকটা তাঁর কাছ থেকেই। এমনকি স্থাপত্যাচার্য মাজহারুল ইসলাম স্যারের সান্নিধ্যে আসাটাও তাঁরই হাত ধরে। বিশ্বাসে ও চর্চায় সত্যনিষ্ঠতা আর সেই সঙ্গে তার আত্নস্থতা যে সঠিক শিল্পবোধের জন্য কত জরুরি, স্থাপত্যাচার্য আর সামসুল ওয়ারেস স্যার উভয়েই ক্রমাগত তাঁদের কর্ম আর জীবনাচরণের মাধ্যমে প্রজন্মান্তরের অনুগামীদের তাগিদ দিয়েছেন, সাহস জুগিয়েছেন।

শিল্পভাবনায় বিবিধ কলার পারস্পরিক সম্পর্ক যুক্ততাকে অন্তর্গত করে, তার বিবর্তনের ঐতিহাসিক ভিত্তিতে বর্তমান আর ভবিষ্যৎ স্থাপত্যকলার ‘কবি’ হিসেবে নিজেদের প্রস্তুত করার তাগিদও তাঁর।

পেশাজীবী স্থপতি হিসেবে তাঁর করা অনন্য সৃষ্টিগুলোর চেয়ে গত ৫০ বছরের ক্লান্তিহীন জ্ঞানচর্চার মাধ্যমেই এই সমাজ তথা এই দেশের অর্থবহ ‘উন্নততর সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলমুখী’ উত্তরণ নিশ্চিত করার জন্য নিরলস প্রয়াসই, অধ্যাপক স্থপতি সামসুল ওয়ারেস স্যারকে সবার কাছে অনন্য এক উচ্চতায় আসীন করেছে।

এভাবেই পরম শ্রদ্ধার মানুষটি তাঁর যৌবন আর প্রৌঢ়ত্ব তুলে দিয়েছেন অগণিত ভবিষ্যতের বাস্তুকলাবিদদের হাতে। আর তাই, তাঁদের পথপরিক্রমায় সৃষ্ট প্রতিটি অর্থবহ কাজে এই শিক্ষকের অন্তর্গত অংশগ্রহণ রয়েছে, যেমনি আমার বেলায়ও। সেই ১৯৯৫ সালে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরের পরামর্শক হিসেবে কাজের সময় কমিটির পক্ষে উপদেষ্টা হিসেবে কিংবা স্বাধীনতা–উত্তর বাংলাদেশের প্রথম নগর জলনিসর্গ প্রকল্প ‘ধানমন্ডি লেক’ প্রকল্পের সময় গুরু হিসেবে তাঁর অভিভাবকত্ব স্মরণীয়।

যেমনি করে আমাদের ছাত্রাবস্থায় দিন শেষেও কত রাতবিরাতে তাঁর একান্ত পারিবারিক সময়কেও আমাদের অভিভাবকত্বের খাতিরে ঢেলে দিয়েছেন, তেমনই পরবর্তীকালে বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটের একাধিকবারের সভাপতি হিসেবে তাঁর নেতৃত্বের একনিষ্ঠতাও ছিল কিংবদন্তিতুল্য।

নবীন যুগ্ম সম্পাদক হিসেবে ১৯৯৮ সালের এই লেখক স্থপতি ইনস্টিটিউটে তাঁরই নেতৃত্বে, একজন ডেভেলপার কর্তৃক কতিপয় স্থপতির অপমানজনক পদচ্যুতির বিরুদ্ধে সাফল্যজনক আন্দোলন গড়ে তুলে পেশাজীবীদের সম্মান রক্ষার্থে মামলা-মোকদ্দমার বিরুদ্ধেও সার্থক সাফল্যের অংশীদার হই। পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য অনুষদের ছাত্রদের ‘নিজস্বতা’ সংরক্ষণের সংগ্রামে একাত্মতার মাধ্যমে এবং ধারাবাহিকভাবে স্থাপত্য প্রতিযোগিতাকে গ্রহণযোগ্য ও জনপ্রিয় করে তুলে নবীন প্রজন্মের যৌক্তিক অন্তর্ভুক্তিতা নিশ্চিতের নিরলস কার্যক্রমে তাঁর অনুগামী হয়ে সঠিক নেতৃত্বের অনমনীয়তা ও দৃঢ়তায় দীক্ষিত হই।

অসাধারণ শিল্পবোধসমৃদ্ধ এই স্থপতি-শিক্ষক, এখনো তাঁর আনুষ্ঠানিক কিংবা অনানুষ্ঠানিক উপস্থাপনের মন্ত্রমুগ্ধতায় বিদগ্ধদের কিংবা নবীনদের উদ্বেলিত আর সমৃদ্ধ করে চলেছেন নিরবচ্ছিন্নভাবে। শিল্প সমালোচক বা বিচারক হিসেবে এখনো তিনি ‘একমেবদ্বিতীয়ম’।

পেশাজীবী স্থপতি হিসেবে তাঁর করা অনন্য সৃষ্টিগুলোর চেয়ে গত ৫০ বছরের ক্লান্তিহীন জ্ঞানচর্চার মাধ্যমেই এই সমাজ তথা এই দেশের অর্থবহ ‘উন্নততর সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলমুখী’ উত্তরণ নিশ্চিত করার জন্য নিরলস প্রয়াসই, অধ্যাপক স্থপতি সামসুল ওয়ারেস স্যারকে সবার কাছে অনন্য এক উচ্চতায় আসীন করেছে।
আজ তাঁর জন্মদিনে, সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনায় অফুরন্ত শ্রদ্ধা জানাই।
জয়তু হে গুরু মোদের।

  • ইকবাল হাবিব, স্থপতি ও পরিবেশকর্মী