বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন হয়রানি কেন ঘটেই চলেছে?

২০০৮ সালের দিকে দেশে ইভটিজিং বেড়ে যাওয়ায় প্রেক্ষিতে অনেক নারী শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে এবং অনেকের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। কার্যত ইভটিজিং নিরোধে দেশে তখন কোনো আইন ছিল না এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ দেশের সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে নারীদের যৌন হয়রানি প্রতিরোধে কোনো কার্যকরী কমিটি বা নির্দেশনা ছিল না।

এ প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট সালমা আলী ২০০৮ সালের ৭ আগস্ট মহামান্য হাইকোর্টে শিক্ষার্থীদের যৌন হয়রানির ঘটনার বিচার চেয়ে একটি রিট করেন।

উক্ত রিটের প্রেক্ষিতে ২০০৯ সালের ১৪ মে দেশের উচ্চ আদালত যৌন হয়রানি প্রতিরোধে সকল সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লিখিত নির্দেশনা প্রদান করেন এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ১০(ক) ধারায় যৌন হয়রানির সংজ্ঞার ভেতরে ( নারীকে অশালীন মন্তব্য, অঙ্গভঙ্গি, সাংকেতিক চিহ্ন প্রদর্শনসহ ইন্টারনেট ও মোবাইলে হয়রানিকেও) আওতাভুক্ত করেন। যৌন হয়রানির বিচার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে ৬০ কর্মদিবসের মধ্য শেষ করতে বলা হয়েছে, ব্যর্থ হলে প্রচলিত আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলা আছে।

কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়-স্কুল-কলেজের অধিকাংশ শিক্ষার্থীই জানে না তাদের প্রতিষ্ঠানে যৌন নিপীড়ন ও নিরোধ সেল নামক একটি কমিটি আছে যেখানে তারা যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে পারবেন। অবশ্য শুধু শিক্ষার্থীদের দোষ দিলেই হবে না, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অধিকাংশ শিক্ষকেরাও জানেন না এইরকম একটি কমিটি আছে।

এই না জানার একটা বড় কারণ এই কমিটির অকার্যকারিতা। কমিটিতে যেই শিক্ষকেরা বিচারকার্য পরিচালনার জন্য আছেন তাদের অনেকেই যৌন হয়রানির সংজ্ঞাও ঠিকমতো জানেন না।

আমি দুঃখিত এভাবে বলার জন্য, কিন্তু এটাই সত্য। যৌন হয়রানির কোনো অভিযোগ এই সেলে আসলে দিনের পর দিন ফেলে রাখা, বিচারের দীর্ঘসূত্রতা খুবই সাধারণ বিষয়।

বছর দুই আগে, নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতাকালীন দেখেছি দুই শিক্ষার্থী অনলাইনে খুব বাজেভাবে যৌন হয়রানির শিকার হয়ে যৌন নিপীড়ন ও নিরোধ সেলে অভিযোগ জানায়।

তদন্তের একপর্যায়ে  ভুক্তভোগীর পোশাক নিয়ে আপত্তি জানান একজন শিক্ষক। বিভিন্নভাবে বোঝানোর চেষ্টা করা হয় ভুক্তভোগীর ইন্ধন ছিল উক্ত হয়রানির জন্য।

দুঃখজনক হলেও সত্য, একজন বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া মেয়েকেও যৌন হয়রানির বিচার চাইতে গিয়ে ভিকটিম ব্লেমিংয়ের শিকার হতে হয় নিজ শিক্ষকদের কাছ থেকে। কারণ যৌন হয়রানির বিচার যারা করবেন সেই শিক্ষকদের যৌন হয়রানির সংজ্ঞায়ন, তদন্ত পদ্ধতি, শাস্তি বা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন নিয়ে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়ে থাকে না। তাই তাঁদের কাছে যৌন হয়রানি নিয়ে এমন ভুল ধারণা থাকা অস্বাভাবিক নয়। এই চিত্র বাংলাদেশের প্রায় সকল সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে একই।

সম্প্রতি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েও একই ঘটনা ঘটেছে। শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ। গত কয়েক বছর সংবাদমাধ্যমে চোখ রাখলেই দেখা যায় দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থীরা যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে, কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বিচার বঞ্চিত হচ্ছে। যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর বা প্রক্টোরিয়াল বডিতে থাকেন তাদের দেশের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন সম্পর্কে তেমন ধারণা নাই।

বিশ্ববিদ্যালয় পরিমণ্ডলে নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটলে কীভাবে তদন্ত করতে হবে, ভুক্তভোগীকে কীভাবে মানসিক সহায়তা দিতে হবে, নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে এবং যৌন হয়রানির ঘটনা প্রতিরোধে আগে থেকে কী ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে তা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল বডি বা যৌন নিপীড়ন ও নিরোধ সেলের জানাশোনা নাই।

অথচ সারা বিশ্বেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যৌন হয়রানির বিষয়ে আলাদা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কমিটি থাকে, অভিযোগ জানানোর প্রক্রিয়ার  ব্যাপারে শিক্ষার্থীদের ভর্তির সময়েই জানানো হয়, হয়রানির শিকার নারীদের শারীরিক ও মানসিক সহায়তা দেওয়া হয়, সচেতনতামূলক প্রচারণা চালানো হয়ে থাকে এবং এসব ঘটনাকে খুবই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হয়ে থাকে।

তাই যে বিষয়ে যাদের দক্ষতা নেই, তাদের যদি আপনি সেই বিষয়ে দায়িত্ব দিয়ে থাকেন তাহলে আসলেই বিশ্ববিদ্যালয়ে এই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবেই এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতি চলমান থাকবেই।

  • সুব্রত ব্যানার্জী পিএইচডি গবেষক (নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা), অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি এবং সহযোগী অধ্যাপক, ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।