পটিয়ার শ্রীমতী খালের জৌলুশ হারিয়ে যেতে বসেছে

শ্রীমতী খাল

‘আষাঢ়ে বাদল নামে, নদী ভর ভর/ মাতিয়া ছুটিয়া চলে ধারা খরতর।/ মহাবেগে কলকল কোলাহল ওঠে,/ ঘোলা জলে পাকগুলি ঘুরে ঘুরে ছোটে।/ দুই কুলে বনে বনে পড়ে যায় সাড়া,/ বরষার উৎসব জেগে ওঠে পাড়া।’

পটিয়ার শ্রীমতী খালের পাড়ে আসলে রবি ঠাকুরের ‘আমাদের ছোট নদী’ কবিতার চরণগুলো মনে পড়ে। বনে সাড়া না পড়লেও  শ্রীমতী খালের কলকলানো পানির ঢলে কিন্তু গ্রামে সাড়া পড়ে যায়। নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত হয় মন। শৈশবে ফুফুবাড়িতে বেড়ানোর স্মৃতিগুলো চোখের সামনে জলছবির মতো ভেসে ওঠে। শ্রীমতী খালের পাশে বিসিক শিল্পের মাঠে সাইকেল চালানো শেখা, ক্রিকেট খেলা, শ্রীমতী খালে জাল দিয়ে মাছ ধরা, আহা দুরন্ত কৈশোর! কেউ কি ফিরিয়ে দেবে আমায়?

‘কেঁ কোঁরত কেঁ কোরত’ দাঁড় টানার শব্দে চলত সাম্পান আর নৌকা। পটিয়া শ্রীমতী খালের উৎপত্তি মূলত শ্রীমাই পাহাড় থেকে। শ্রীমতী রানির নাম অনুসারে শ্রীমাই পাহাড়। এ খালের কিছু অংশ নয়নাভিরাম হাইদগাঁও গ্রামের পড়েছে। বুদবুদ চর, সাদা মাটির পাহাড়, কিছু পাহাড়ি গ্রাম। যেখানে প্রাচীনকালে বন্য হাতি নেমে দলবদ্ধ হয়ে ঘোরাফেরা করত বলে ওই এলাকার আদি নাম ছিল হস্তীগ্রাম। এই হস্তীগ্রামের পরবর্তী সময়ে নাম হয় হাইদগাঁও।

প্রাচীন জনশ্রুতি মতে জানা যায়, শ্রীমতী খালের উত্তর পশ্চিম তীর ঘেঁষে জনৈক সাধু ঋষি ‘শিলা চক্র পূজা’ চর্চায় নিজেকে নিয়োগ করেন। এ সময়কালের মধ্যে এক রাজা এ পথ দিয়ে কোথাও যাচ্ছিলেন। রাজা সাধুকে নানা পরীক্ষা করে দেখেন এবং শিলা চক্র পূজার প্রভাব লক্ষ্য করে এর স্মারক চিহ্নরূপে স্থানের নামকরণ করেন ‘চক্রশালা’।

এ প্রসঙ্গে খ্যাতনামা ইতিহাসবিদ ড. আবদুল করিমের অভিমত—  চন্ডিলাহ রাজার রৌপ্য মুদ্রার লিপি পাঠ থেকে জানা যায় যে ‘চাকশোয়ানা’ নামের শব্দ থেকে সম্ভবত আধুনিক ‘চক্রশালা’ নামের উৎপত্তি। কচুয়াই ইউনিয়নের, আজিমপুর গ্রামের পূর্ব নাম ‘চাষকোলা’ থেকে চক্রশালার নামের উৎপত্তি। চক্রশালা ও শ্রীমতী খালকে ঘিরে রয়েছে এ রকম অনেক অজানা কাহিনি। শ্রীমতী খাল দেখতে ছোট নদীর মতো। পাহাড়ি জলধারার স্রোতে খালের সৃষ্টি হয়। শ্রীমতী খাল বরইতলী থেকে এঁকেবেঁকে কেরাঞ্জ খালে গিয়ে মিলিত হয়েছে।

বর্ষায় খালটি পানিতে টইটম্বুর থাকে। পাহাড়ি ঢলের স্রোতে ভেসে যায় মানুষের বাড়িঘর। প্লাবিত হয় পটিয়ার বিভিন্ন ইউনিয়ন। বন্যার সময় শ্রীমতী খালের ঢলে পটিয়ার বাহুলি, ভাটিখাইন, ছনহরা, বাথুয়া, মোড়লী, কচুয়াই ইউনিয়নের অনেক বাড়িঘর তলিয়ে যায়। একসময় শ্রীমতী খালের পাহাড়ি ঢলের পানি গ্রাম ছাড়িয়ে পটিয়া শহরও প্লাবিত হতো। তৎকালীন পটিয়ার প্রয়াত চেয়ারম্যান শামসুল আলম মাস্টারের উদ্যোগে শ্রীমতী খালের ওপর প্রথম বাঁধ নির্মাণ করা হয়। প্রত্যন্ত অঞ্চলের গ্রামগুলো বন্যার কবল থেকে থেকে রক্ষা পায়।

শ্রীমতী খালের শুভ্র কাচবালু দালান-কোঠা নির্মাণে ব্যবহৃত হয়। সম্প্রতি শ্রীমতী খালের প্রয়োজনাতিরিক্ত বালু উত্তোলনের ফলে খালের প্রাকৃতিক পরিবেশ অনেকটা নষ্ট হয়ে গেছে। বর্ষা মৌসুম এলে খালের দুই পাশে বাঁধ এবং বাড়িঘর শ্রীমতী খালে বিলীন হয়ে যায়। আবার কিছু এলাকায় খাল ভরাট হয়ে  গেছে। শীত মৌসুমে খালের পানি শুকিয়ে যায়। পানি শুকিয়ে গেলে পাহাড় থেকে বিভিন্ন বন্য প্রাণীর বিচরণ দেখা যায়।

আদিকাল থেকে শ্রীমতী খালের পাড়ে প্রচুর কচু এবং নানা রকমের সবজির চাষাবাদ হতো। কথিত আছে, কচু থেকে কচুয়াই ইউনিয়ন। কোনো এক পল্লিকবি চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চলের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছিলেন,
‘আসল সৈয়দ যারা মাইল্যাপাড়া
হারালাতে ফকির বেশ
পটিয়াতে কচুছড়া
চরকানাইতে ভোয়ইয়া বেশ।’

শ্রীমতী খালের ওপর দুটি সেতু। শ্রীমাই ব্রিজ নামে পরিচিত। শ্রীমতী খালকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বিসিক শিল্পনগরী। ব্রিজের পাশে খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের উপাসনালয়, অপর পাশে অবকাশযাপনের জন্য চমৎকার শ্রীমতী খালের বাঁধ। বাঁধের পাড়ে অনেক ভ্রমণপিপাসু বেড়ানোর জন্য আসেন। শ্রীমতী খালের ভরাট হয়ে যাওয়া অংশগুলো আবার খনন করে দুপাশে খালের বাঁধগুলো আরও মজবুত করে নির্মাণ করলে শ্রীমতী খাল তার প্রাণ ফিরে পাবে। নৌকা সাম্পানও চলাচল করতে পারবে। শ্রীমতী তাঁর আগের জৌলুশ ফিরে পাবে।

শ্রীমতী খালসহ এর শাখা–উপশাখা দখল হয়ে যাওয়া খালগুলো পুনরুদ্ধার খনন করা অতি জরুরি, না হয় অদূরভবিষ্যতে পটিয়া পৌরসভাসহ পার্শ্ববর্তী ইউনিয়নগুলো ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ ব্যাপারে পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি কামনা করছি।

রশীদ এনাম
সমন্বয় সহকারী
ইতিহাসের খসড়া