বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার কেন চাকরির প্রস্তুতির পাঠকক্ষ হবে

বিসিএসের প্রস্তুতি নিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে ঢুকতে শিক্ষার্থীদের ভীড়ফাইল ছবি

আমরা সভ্যতার একুশ শতকে পদার্পণ করেও গ্রন্থাগারের মর্মার্থ বুঝে উঠতে পারিনি। বাংলা সাহিত্যের খ্যাতিমান সাহিত্যিকেরা গ্রন্থাগারের গুরুত্ব নিয়ে লিখে গেলেও তা বোঝার সামর্থ্য এখনো আমাদের হয়নি। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম সাহিত্যিক প্রমথ চৌধুরী গ্রন্থাগারকে মনের হাসপাতাল বলেছেন। তিনি গ্রন্থাগারকে মনের হাসপাতাল না বলে যদি ‘চাকরির প্রস্তুতি পাঠকক্ষ’ বলতেন, তাহলে এ দেশে গ্রন্থাগার নিয়ে তর্কবিতর্ক হতো না। বরং বহু আগেই এই দেশের শিক্ষিত সমাজ গ্রন্থাগারের সুবাদে চাকরির বিশ্ববাজারে বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলত!

আমরা এখনো গ্রন্থাগার নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার নিয়ে। আমরা দোটানায় পড়ে আছি যে গ্রন্থাগার শিল্প, সংস্কৃতি, ইতিহাস, বিজ্ঞান, সাহিত্য, রাজনীতিচর্চা এবং গবেষণার জায়গা নাকি চাকরির প্রস্তুতিবিষয়ক বইয়ের নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন মুখস্থ করার জায়গা।

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘লাইব্রেরির মধ্যে আমরা সহস্র পথের চৌমাথার ওপরে দাঁড়াইয়া আছি। কোনো পথ অনন্ত সমুদ্রে গিয়াছে, কোনো পথ অনন্ত শিখরে উঠিয়াছে, কোনো পথ মানব-হৃদয়ের অতল স্পর্শে নামিয়াছে। যে যে দিকে ধাবমান হও, কোথাও বাধা পাইবে না।’

অথচ আমরা লাইব্রেরি বা গ্রন্থাগারকে ‘চাকরির প্রস্তুতি পাঠকক্ষ’ নামে কেবল একটি পথে গ্রন্থাগারকে আটকে রাখতে চাই। চাকরির জন্য পড়াশোনা করা দোষের নয়। আমাদের দেশের বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে চাকরির পড়া ছাড়া উপায়ান্তরও নেই। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারকে চাকরির প্রস্তুতি পাঠকক্ষ হিসেবে ব্যবহার করা কতটুকু যৌক্তিক, তা বিবেচনার বিষয়। আমাদের উচিত শিক্ষার্থীদের চাহিদা অনুযায়ী গ্রন্থাগার-সংলগ্ন অথবা আলাদা জায়গায় চাকরির প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য পাঠকক্ষ তৈরি করে দেওয়া।

একটি জাতির ভারসাম্য ধরে রাখতে, জ্ঞানের সব শাখার জ্ঞানী-গুণী মানুষের প্রয়োজন। কেবল সরকারি চাকরিজীবী দিয়ে জাতির ভারসাম্য ধরে রাখা সম্ভব নয়। চাকরিপ্রত্যাশী ও চাকরির প্রস্তুতিবিষয়ক বই দিয়ে যদি গ্রন্থাগার কানায়-কানায় ভরপুর থাকে, তাহলে সেটাকে গ্রন্থাগার বলা যায় না, বড়জোর সাধারণ পাঠকক্ষ বলা যায়।

আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাপদ্ধতির সঙ্গে চাকরির পরীক্ষাপদ্ধতির সামঞ্জস্য নেই বললেই চলে। ফলে চাকরির পরীক্ষার জন্য আলাদাভাবে দীর্ঘ সময় ধরে প্রস্তুতি নিতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাট চুকানোর আগেই চাকরি পাওয়ার জন্য স্বপ্নে হাবুডুবু খেতে হয়। চাকরি হাসিল করার জন্য চাকরির প্রস্তুতি বই নিয়ে গ্রন্থাগারে সাধনায় বসতে হয়। তা ছাড়া গ্রন্থাগারে চেয়ার ধরার সংগ্রাম তো আছেই।

গ্রন্থাগার হলো, যুগ যুগ সঞ্চিত জ্ঞানধারার মিলনক্ষেত্র এবং শত শত বইয়ের মধ্যে বিগত এবং বর্তমান মনীষাদের জ্ঞান ও চিন্তারাজি সঞ্চিত থাকে। রবীন্দ্রনাথ গ্রন্থাগারের পরিচয়ে বলেছেন, ‘মহাসমুদ্রের শত বৎসরের কল্লোল কেহ যদি এমন করিয়া বাঁধিয়া রাখিতে পারিত যে, সে ঘুমাইয়া পড়া শিশুটির মতো চুপ করিয়া থাকিত, তবে সেই নীরব মহাশব্দের সহিত এই লাইব্রেরির তুলনা হইত। এখানে ভাষা চুপ করিয়া আছে, প্রবাহ স্থির হইয়া আছে, মানবাত্মার অমর আলোক কালো অক্ষরের শৃঙ্খলে কাগজের কারাগারে বাঁধা পড়িয়া আছে।’

আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাপদ্ধতির সঙ্গে চাকরির পরীক্ষাপদ্ধতির সামঞ্জস্য নেই বললেই চলে। ফলে চাকরির পরীক্ষার জন্য আলাদাভাবে দীর্ঘ সময় ধরে প্রস্তুতি নিতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাট চুকানোর আগেই চাকরি পাওয়ার জন্য স্বপ্নে হাবুডুবু খেতে হয়। চাকরি হাসিল করার জন্য চাকরির প্রস্তুতি বই নিয়ে গ্রন্থাগারে সাধনায় বসতে হয়। তা ছাড়া গ্রন্থাগারে চেয়ার ধরার সংগ্রাম তো আছেই।

আরও পড়ুন

শিক্ষার্থীরা একাডেমি পড়াশোনার পাশাপাশি চাকরির প্রস্তুতিও যেন নিতে পারে, সেই জন্য আলাদা পাঠকক্ষ তৈরি করা উচিত। এবং দেশ ও জাতির মঙ্গলের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারকে জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প, সাহিত্য, ইতিহাস, সংস্কৃতি, রাজনীতিচর্চা এবং গবেষণার কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা উচিত। তবেই গ্রন্থাগার দেশ ও জাতিকে সমৃদ্ধ করবে।    

  • মো. আব্দুন নূর শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়