মাটি ও নাড়ির টান থেকে দূরে পাঠিয়ে, এ কেমন শিক্ষকতা!

‘আমার বাড়ি থেকে সাত শ কিলোমিটার দূরে। পাড়ি দিতে হয় দুর্গম উত্তাল সাগর।’

গ্রামের নিম্নবিত্ত পরিবারে জন্ম আমার। গ্রামের কাদামাটি গায়ে মেখে শৈশব কৈশোর কাটিয়েছি। গ্রামের নির্মল বাতাসে প্রাণ খুলে নিশ্বাস নিয়েছি। গ্রামের বিস্তীর্ণ সবুজে আর সুবিশাল নীল আকাশের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়েছি। দল বেঁধে হইচই করতে করতে গ্রামের মেঠো পথে হেঁটে হেঁটে পাঠশালায় গিয়েছি। পাড়ার ছেলে মেয়েরা মিলে গোল্লাছুট, দাড়িয়াবান্ধা, বউচি, ডাংগুলি আরও কত গ্রামীণ খেলা খেলেছি। নদীতে দীর্ঘ সময় ধরে সাঁতার কেটে দু চোখ লাল করে বাড়ি ফিরে মায়ের বকুনি খেয়েছি। গ্রামের সহজ সরল মানুষগুলোর কাছে কত কিচ্ছা কাহিনি শুনেছি। দাদার বয়সী মুরব্বিদের কাছে যুদ্ধের গল্প শুনেছি।

বাড়ি থেকে তিন কিলোমিটার দূরে উপজেলা শহরের স্কুল, কলেজ থেকেই উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশোনা করেছি। তারপর বিভাগীয় শহরের  কলেজ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করেছি। বন্ধুদের মধ্যে অনেকেই শহুরে জীবন যাপন পছন্দ করত। তারা শহরেই থেকে যাওয়ার স্বপ্ন দেখত। কিন্তু  শহরের কোলাহল, সাজসজ্জা আমার কখনোই মন কাড়তে পারেনি।

আমি যেখানেই গিয়েছি আমার গ্রামকে বুকে লালন করেই গিয়েছি। যে সোঁদা মাটির গন্ধে আমি আকুল হয়েছি, সে মাটির টান আমি ভুলি কী করে! আমার গ্রামের মানুষগুলোকে সবচেয়ে আপন বলে মনে হয়েছে। যার সাথে দ্বন্দ্ব করেছি তাকেও আপন ভেবেছি। তাই আমৃত্যু এই আপন মানুষগুলোর সাথে কাটানোর স্বপ্ন দেখেছি। আর মনে মনে প্রত্যাশা করেছি, এমন একটা কর্ম, যাতে গ্রামেই থেকে যেতে পারি।  শিক্ষকতা ছিল তাদের মধ্যে সবার আগে। কিন্তু হায়, আজ আমি এই আপন মানুষগুলোকে ছেড়ে কত দূরে থাকি!

হ্যাঁ, বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে, জীবিকার তাগিদে, এনটিআরসিএ’ন তৃতীয় গণবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়ে চট্টগ্রামের দ্বীপ উপজেলা সন্দ্বীপের একটি দাখিল মাদ্রাসায় সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেছি। আমার বাড়ি থেকে সাত শ কিলোমিটার দূরে। পাড়ি দিতে হয় দুর্গম উত্তাল সাগর। তবুও চাকরি নামক ‘সোনার হরিণ’ পেয়েছি বলে আনন্দের সীমা ছিল না। কিন্তু আমার সে আনন্দ অল্প দিনেই ফিকে হয়ে গেছে। এক হাজার টাকা বাড়ি ভাড়া ও পাঁচশত টাকা চিকিৎসা ভাতাসহ মাধ্যমিক স্তরের একজন এমপিওভুক্ত শিক্ষকের প্রারম্ভিক বেতন সর্বসাকল্যে মাত্র ১২,৭৫০ টাকা। প্রতিষ্ঠান থেকেও কোনো আর্থিক সম্মানী নেই।

বর্তমান দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বাজারে এই স্বল্প টাকায় একটি সংসার চালানো শুধু কষ্টসাধ্যই না। বরং রীতিমতো অসম্ভবও। আর যারা আমার মতো নিজ জেলার বাইরে শত শত কিলোমিটার দূরে শিক্ষকতা করছেন, তাদের সংসার চালানোর কথা কল্পনাই করা যায় না। যে টাকা বেতন পাই তা দিয়ে একার মোটামুটি চলে যায়। কিন্তু নিজে চলার পর এমন কিছুই অবশিষ্ট থাকে না যা দিয়ে পরিবারকে একটু সহযোগিতা করা যায়। বেতন তুলনামূলকভাবে কম হওয়ায় বাবা, মা, স্ত্রী, সন্তানকেও কাছে রাখতে পারছি না। তাদের যা প্রাপ্য তাও ঠিকভাবে দিতে পারছি না। আবার চাইলেও প্রতি মাসে তাদের কাছে যেতেও পারছি না। আমার কর্মস্থল থেকে একবার বাড়িতে যাতায়াত খরচ কমপক্ষে পাঁচ হাজার টাকা। যাতায়াতের জন্য হাতে নিতে হয় তিন দিন সময়।

কখনো কখনো ছুটি পেলেও টাকার অভাবে বাড়ি যাওয়া হয় না। আবার কখনো কখনো কোনোভাবে টাকার জোগাড় হলেও যাওয়ার সুযোগ হয় না বৈরী আবহাওয়ার কারণে। এমনও হয় যে, বাড়ি যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে ঘাটে গিয়ে জানতে পেরেছি ‘আবহাওয়া অনুকূলে না থাকায় সব ধরনের নৌযান বন্ধ।’ তখন বিষণ্নতায়  বুকভরা ব্যথা নিয়ে ক্ষুণ্ন মনে ফিরে আসতে হয়েছে।  সে যে কী কষ্ট! বলে বোঝাবার মতো নয়।

উত্তাল ঢেউ উপেক্ষা করে ছোট নৌকায় করে জাহাজে ওঠানামা করতে কত যে ভয় হয়, তা কেবল আমার মতো ভুক্তভোগীই বোঝেন। নিকট আত্মীয়ের মৃত্যুর পর তার জানাজাতেও অংশ নিতে পারি না দূরত্ব আর সাগর পারাপারের কারণে। বুকের ভেতর একরাশ কষ্ট চাপা দিয়ে চলতে হয়। ঘুমের ঘোরে দুঃস্বপ্নে আঁতকে উঠি।

আমি যেখানে শিক্ষকতা করছি, সেখানকার স্থানীয় ভাষা, সংস্কৃতির সাথে আমার ভাষা ও সংস্কৃতির বিস্তর পার্থক্য। এখানকার ভাষা যেমন আমার কাছে দুর্বোধ্য, আমার ভাষাও তাদের কাছে সহজ নয়। শিক্ষার্থীদের কথা আমি বুঝতে পারি না। আমার কথাও তাদের বুঝতে কষ্ট হয়। এভাবে শ্রেণি কার্য পরিচালনা করা অত্যন্ত কঠিন। সহকর্মীরা যখন নিজেদের মধ্যে কথোপকথন করেন, আমি কিছুই বুঝতে পারি না। ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি শুধু।

বদলি ব্যবস্থা না থাকায় আমার মতো যারা দূরে দূরে শিক্ষকতা করছেন তারা সহকর্মীদের কাছে প্রতিনিয়তই নানা ভাবে হচ্ছেন বুলিং বা লাঞ্ছনার শিকার। নারী শিক্ষকেরা শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের পাশাপাশি হচ্ছেন। এমনও শোনা যায় যে, স্বামী বা স্ত্রী দীর্ঘদিন দূরে থাকায় বাড়ছে দাম্পত্য কলহ। সে কলহ কখনো বিবাহ বিচ্ছেদে রূপ নিচ্ছে। প্রতিষ্ঠানের পিয়নও দূরের শিক্ষকদের কোনো কাজের আদেশ করতে কুণ্ঠাবোধ করেন না। পিয়নও সাজেন প্রিন্সিপাল। অতিরিক্ত ক্লাসের চাপ তো আছেই। কী যে কষ্ট আর মানসিক যন্ত্রণায় দিনাতিপাত করছি আমরা,  তা কেবল আমার মতো ভুক্তভোগীরাই বোঝেন। এসব কেবল বদলি না থাকার কুফল।

আমি শহরের নামীদামি প্রতিষ্ঠানে নয়, বরং বাড়ির কাছের প্রতিষ্ঠানেই যেতে চাই।  বনের পাখি যেমন খাঁচায় বন্দী থাকতে চায় না। আমিও তেমনি এই বন্দিদশায় থাকতে চাই না। আমি আমার গ্রামের মানুষদের সাথে সুখে দুঃখে আপদে বিপদে এক সাথে মিলেমিশে থাকতে চাই। এত দূরের কর্মস্থল এখন শিক্ষকদের কাছে কারাগারসম। এরূপ দুর্বিষহ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে বদলি কিংবা আলাদা গণবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে নিজ এলাকার প্রতিষ্ঠানে ফিরে যাওয়ার বিকল্প নেই। তাই, শিক্ষকদের এই দুর্ভোগ লাঘবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি কামনা করছি।

মুহাম্মদ আলী
সহকারী শিক্ষক
পূর্ব সন্দ্বীপ ইসলামিয়া দাখিল মাদ্রাসা
সন্দ্বীপ,  চট্টগ্রাম।
নিজ জেলা: কুড়িগ্রাম।
[email protected]