কোরবানি যেন ‘শো অফ’ না হয়

ঈদের আনন্দ সব মানুষের একরকম হয় না। কোরবানির ঈদ যেমন একজন সামর্থ্যবান মানুষের জন্য উৎসবের উপলক্ষ, তেমনি একজন অসামর্থ্যবান মানুষের জন্য হয়ে দাঁড়ায় নানা অর্থনৈতিক হিসাব-নিকাশ আর চাপের কারণ।

নিম্ন আয়ের বা মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো এক অদ্ভুত দ্বিধার মধ্যে পড়ে যায় এই ঈদে। একদিকে ধর্মীয় দায়িত্ব পালন করতে চায়, অন্যদিকে বাজেট, ঋণ, বাজারদর আর সামাজিক চাপে কাতর হয়। পশুর দাম, জবাইয়ের খরচ, বিতরণের ব্যয়—সবকিছু সামলানোর চাপে কোরবানিই দেওয়া সম্ভব হয় না অনেকের পক্ষে।

এখানে একশ্রেণির মানুষ আছেন, যাঁরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দামি গরুকে বিভিন্নভাবে উপস্থাপন করে কোরবানিকে প্রতিযোগিতায় রূপ দেন। আর অসামর্থ্যবান পরিবারের মা-বাবা হিসাব করে দেখেন সন্তানদের হাসিমুখের পেছনে কতটা ত্যাগ জমা হয়ে আছে।

কোরবানি করা যেমন ইসলামের একটি মহান শিক্ষা, তেমনি সেটা সাধ্যের মধ্যে করাই মূল শিক্ষা। কিন্তু সমাজে একধরনের অদৃশ্য প্রতিযোগিতা তৈরি হয়েছে। কে কত বড় গরু কোরবানি দিচ্ছেন, এই প্রতিযোগিতার বোঝা সবচেয়ে বেশি পড়ে মধ্যবিত্তের লোকজনের ঘাড়ে। কারণ, তাঁরা চাইলেও না পারেন দেখাতে, না পারেন বাদ দিতে। মাঝামাঝি থেকে দুই দিক সামলানোই তাঁদের নিয়তি।

তবু তাঁরা কোরবানি করেন। কেউ ধারকর্জ করেন, কেউ সারা বছরের সঞ্চয় ভাঙেন। কারণ, তাঁরা জানেন, সন্তানদের সামনে আনন্দের মুখ গড়ে তুলতে হলে পেছনের ত্যাগ গোপন রাখতে হয়।

এই প্রবণতা কোরবানির মূল শিক্ষা ও উদ্দেশ্যকে আড়াল করে দিচ্ছে। এক পাশে আছে দামি গরুর ভিডিও ভাইরাল করার উন্মাদনা, অন্য পাশে আছে গরিব মানুষদের মধ্যে লুকিয়ে থাকার লজ্জা। একদিকে আলোকসজ্জিত কোরবানি, অন্যদিকে চুপচাপ নীরব থাকা অসহায় পরিবার।

কোরবানির মূল শিক্ষা সম্পর্কে মহান আল্লাহ তাআলা পরিষ্কারভাবে কোরআনে বলেছেন, ‘আল্লাহর নিকট তাদের মাংস ও রক্ত পৌঁছায় না, বরং পৌঁছায় তোমাদের তাকওয়া।’ (সুরা হজ: ৩৭) এই আয়াত আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, কোরবানির বাহ্যিক রূপ নয়, বরং অভ্যন্তরীণ খোদাভীতিই আসল।

কোরবানি এমন এক ইবাদত, যেখানে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনই একমাত্র লক্ষ্য। এখানে বড় গরু নয়, বড় নিয়তের মূল্য। এই কোরবানির ঈদে আমাদের দরকার একটু সহমর্মিতা, একটু বুঝেশুনে মূল্যায়ন করা—কে কী করলেন, তার চেয়ে বড় কথা হলো, কে কীভাবে ত্যাগ করলেন।

ঈদ যেন শুধু গরুর দাম নয়, বরং আত্মত্যাগ, সহানুভূতি আর মানবিকতার শিক্ষা দেয়। কোরবানি আমাদের কখনোই অর্থবিত্তের অহংকার দেখানো শেখায় না; বরং শেখায় ত্যাগের মর্মবাণী। তাই কোরবানির পশু কেনার অসুস্থ প্রতিযোগিতা পরিহার করি এবং পশুর দাম গোপন রাখি আর সেটাই প্রকৃত ত্যাগ বলে মনে করি।

  • ইসতিয়াক আহমেদ শিক্ষার্থী, নওগাঁ সরকারি কলেজ