মেয়েটির জীবনের ট্রেনই অন্য পথে চলে গেল

মেয়েটা শুধু ভুল করে অন্য ট্রেনে উঠেছিলেন, আর এতে তাঁর জীবনের ট্রেনই অন্য পথে চলে গেল। হ্যাঁ, বলছিলাম গত মঙ্গলবার রাতে ঢাকা থেকে লালমনিরহাটগামী ‘লালমনি এক্সপ্রেস’ ট্রেনে ভুলবশত উঠে ধর্ষণের শিকার হওয়া আমাদের দুর্ভাগা বোনটির কথা।

সরকার বিভিন্নভাবে চেষ্টা করছে, বেসরকারি সংস্থাগুলো চেষ্টা করছে, সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করা হয়েছে, তবুও থামছে না ধর্ষণ। তবুও নিরাপদ নন আমাদের মেয়েরা, আমাদের বোনেরা।

আর আমাদের সমাজব্যবস্থায় অপরাধীর তুলনায় ভুক্তভোগীকে বেশি সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। বিশেষ করে এ ধরনের নির্যাতনের ক্ষেত্রে। ওই মেয়েটির বাবা বলেছেন, তাঁকে নিয়ে আর গ্রামে ফিরবেন না। কারণ, এলাকার মানুষের বাক্যবাণে তাঁর মেয়ে সারা জীবন জর্জরিত হবেন। হয়তো শহরে থাকবেন, যেখানে তাঁদের কেউ চিনবেন না।

দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় একটা প্রতিবেদন দেখে চোখ আটকে গেল। ২০২২ সালের ২ আগস্ট কুষ্টিয়া থেকে নারায়ণগঞ্জগামী ঈগল পরিবহনের চলন্ত বাসের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ডাকাতি ও ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। ভুক্তভোগী ওই নারীর গ্রামের লোকজন তাঁদের সঙ্গে ঝগড়া হলেই সেই কথা তুলে গালমন্দ করেন। যেখানে তাঁর কোনো দোষ নেই, সেখানে তাঁকেই প্রতিনিয়ত কথা শুনতে হচ্ছে।

নজরুলের ভাষায়—‘বিশ্বে যা কিছু মহান চির কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর’। অর্থাৎ সব কল্যাণকর ব্যাপারে যতটুকু পুরুষের অবদান, ঠিক ততটুকুই নারীর অবদান। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে বেশি অবদান নারীর। কিন্তু তারপরও সমাজে নারীকে পুরুষের সমান মর্যাদা দেওয়া হয় না। নারী-পুরুষ সমঅধিকার এই বিষয় এখনো অনেকাংশে কাগজে–কলমে থেকে গেছে।

দেশের অর্ধেক জনসংখ্যা নারী আর নারীরা যে শুধু বাইরে হেনস্তার শিকার হচ্ছেন তা নয়, ঘরেও হচ্ছেন। সব খবর হয়তো বাইরে আসে না কিন্তু ঘরে হেনস্তার শিকার নারীর সংখ্যা নেহাতই কম নয়। কোনো দেশের অর্ধেক জনসংখ্যাই যদি প্রতিনিয়ত ঘরে-বাইরে হেনস্তার শিকার হতে থাকেন, তাহলে দেশ ও জাতি কীভাবে এগিয়ে যাবে।

আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশে নারীদের যোগ্য সম্মান না দেওয়াটা অনেক সময় দেখা যায়। কুসংস্কার ও সুবিধাভোগী মনোভাব এই অঞ্চলের মানুষের মধ্যে বেশি।

বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। সব দিক থেকে এগিয়ে চলছে কিন্তু নারীর প্রতি সহিংসতা দিন দিন বেড়েই চলেছে। আন্দোলনের মুখে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে আইন পাস করেছে সরকার। ধারণা করা হয়েছিল ধর্ষণের সংখ্যা আস্তে আস্তে কমে যাবে, কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। নির্যাতনের হার দিন দিন বেড়েই চলেছে। পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুসারে, ২০২২ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ১৯ হাজার ৫৬টি, ২০২১ সালে ২২ হাজার ১২৪টি, ২০২০ সালে ২২ হাজার ৫০১টি, ২০১৯ সালে ২৭ হাজার ৭৫২টি, ২০১৮ সালে ১৬ হাজার ২৩৪টি মামলা হয়েছে। গত বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত ৭ মাসে ১৮ হাজার ৫৩টি মামলা হয়েছে। ২০২৩ ও ২০২২ সালে মামলার ৫২ শতাংশ ছিল ধর্ষণের, আগের ৪ বছরে এ হার ৪৮ শতাংশের নিচে ছিল। (তথ্যসূত্র- প্রথম আলো, ১৯ জানুয়ারি ২০২৪)

নারী নির্যাতনের ঘটনার বিচারে দীর্ঘসূত্রতা অনেকাংশে নারী নির্যাতনের জন্য দায়ী। সঠিক সময়ে অপরাধের সঠিক বিচার হলে এই অপরাধ বাড়ত না। সগিরা মোর্শেদ নামের এক নারীকে হত্যা করা হয় ১৯৮৯ সালে। তাঁকে হত্যার ৩০ বছর পর বিচারকার্য শুরু হয়। এ রকম হাজারো উদাহরণ রয়েছে। একে তো বিচার হয় না অধিকাংশ ঘটনার, তার ওপর বিচারের দীর্ঘসূত্রতার কারণেই ধর্ষণ বেড়ে চলেছে।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে নারীরা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন ও রাজপথে আন্দোলন করেছেন। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে নারীরা অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং সম্মুখযুদ্ধে পুরুষের পাশাপাশি যুদ্ধ করেছেন। স্বাধীনতার জন্য তিন লাখ মা–বোন তাঁদের সম্ভ্রম হারিয়েছেন। এসব তো অনেক আগের ঘটনা। তখন খুব কমসংখ্যক মানুষ শিক্ষিত ছিল। আর এখন শিক্ষার আলো সমাজের কোণে কোণে আলোকিত করছে। মানুষের চিন্তাধারার উন্নতি হয়েছে কিন্তু যখনই নারীর অধিকারের প্রশ্ন সম্মুখে এসেছে, তখনই এই সমাজের মানুষের কথায়, চিন্তাধারা দেখে মনে হয় সমাজের অগ্রযাত্রা হয়তো আরও দুই শ বছর পেছনে চলে গেছে।

দেশের অর্ধেক জনসংখ্যা নারী আর নারীরা যে শুধু বাইরে হেনস্তার শিকার হচ্ছেন তা নয়, ঘরেও হচ্ছেন। সব খবর হয়তো বাইরে আসে না কিন্তু ঘরে হেনস্তার শিকার নারীর সংখ্যা নেহাতই কম নয়। কোনো দেশের অর্ধেক জনসংখ্যাই যদি প্রতিনিয়ত ঘরে-বাইরে হেনস্তার শিকার হতে থাকেন, তাহলে দেশ ও জাতি কীভাবে এগিয়ে যাবে।

সুকান্ত দাস
শিক্ষার্থী, ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।