রেডিও: ‘গানের পাখি হারানো দিনের লাগি আজিও কাঁদিয়া যায়’

আমার মতো অনেকের ছোটবেলা ও নব যৌবন অনেকটা কেটেছে রেডিও শুনে। বাড়িতে রেডিও শোনার চল ছিল। আবার পাশের বাড়িতে গিয়েও রেডিও শুনতাম।
সেই সময়ে সরকারি অফিস আদালত এবং স্কুল-কলেজ ছুটির দিন ছিল রবিবার। রবিবার সকালে শিশুদের অনুষ্ঠান হতো। যিনি ঢাকা রেডিওতে অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করতেন তিনি শুরুতে বলতেন, ‘ছোট্ট সোনা বন্ধুরা সব আদর ও ভালোবাসা নিও। কী ভাল আছ তো সব?’ এই শব্দবন্ধ দিয়ে। এ ছাড়াও বিকেলে হতো, ‘গল্পদাদুর আসর’। সবাই শুনতাম মনের মাধুরী মিশিয়ে গভীর মনোযোগ নিয়ে।

মা-খালারা শুনতে ভালোবাসতেন নাটক ও গান। মনে পড়ে সেই সময়ে গান শুনতে শুনতে কয়েকটা গান আমাদের মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। রিজিয়া খালা গুনগুন করে গাইতেন, ‘আমার গানের পাখি হারানো দিনের লাগি আজিও কাঁদিয়া যায়’, ‘দোল দোল দোলনি রাঙা মাথায় চিরুনি’, ‘শিয়ালদহ গোয়ালন্দ আজও আছ ভাই’ ইত্যাদি কত কী গান। সেই সময়ে সম্ভবত সবার প্রিয় শিল্পী ছিলেন ফেরদৌসী বেগম, আঞ্জুমান আরা বেগম, আফসারী খানম, গিরিন চক্রবর্তীরা।

বাংলাদেশ বেতারের সঙ্গীতানুষ্ঠানগুলোও অসম্ভব ভালো লাগার মতো ছিল সেই দিনগুলিতে। কিন্তু বর্তমানে রেডিওতে কি ধরনের সংগীতানুষ্ঠান হয়? তা শুনবার ও জানবার জন্য হঠাৎ হঠাৎ রেডিও খুলে শুনি। কিন্তু মনে হয়, নেই কোনো নতুনত্ব। নেই কোনো বৈচিত্র্য।

রবিবার দুপুরবেলা অনুরোধের আসরের গান বাড়ির সবাই মিলে শুনতাম। বড় ভাই ও বাবা শুনতেন বাংলা ও ইংরেজি খবর। সেই সময়ে খবর পাঠ করতেন অনেকেই, তবে সরকার কবিরউদ্দিন, কাফী খান নাম দুটি যেন এই পড়ন্ত বেলায় এসে ভুলতে পারছি না। সবচেয়ে মজার ব্যাপার, সেই সময়ে রেডিওকে বলা হতো ট্রানজিস্টর। তবে পাশের বাড়ির শাহাদাতের মা এর উচ্চারণটা ভুল করে বলতেন, টনজিস্টার। এ নিয়ে মহিলা মহলে কী ই না হাসাহাসি।

আসলে ১৯৫০, ১৯৬০ বা ১৯৭০ এর দশকে ঘরে বসে বিনোদন অথবা খবরের জন্য রেডিও, খবরের কাগজ আর গল্পের বই, সিনেমা হলে ছবি দেখা ছাড়া কোনও মাধ্যম ছিল না। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় কেটেছে রেডিওকে কানের কাছে নিয়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের খবর ও গান শুনে। আহা তখন গভীর মনোযোগ নিয়ে শুনতাম, ‘মুজিব বাইয়া যাওরে’-সহ অসংখ্য গান। আবদুল জব্বার ছিলেন আমাদের প্রিয় কণ্ঠশিল্পী।

বর্তমানে সংবাদ ও বিনোদনের অনেক মাধ্যম হয়েছে। টিভি তো এসেছে প্রায় ষাট বছর আগে। তবে ইদানীং স্মার্টফোন তো অসম্ভব জনপ্রিয়, এটিকেও গণমাধ্যম প্ল্যাটফর্ম বললে হয়তো ভুল বলা হবে না। এই স্মার্টফোনের মাধ্যমে আমরা সঙ্গে সঙ্গে খবরাখবর পেয়ে যাই। সিনেমা, গান সবই দেখতে ও শুনতে পাই। কিন্তু অভ্যাসবশে এখন কেউ রেডিও শোনেন কিনা তা আমার জানা নেই। যত দূর জানি, শহরের মানুষ রেডিও বিশেষ কেউ শোনেন না। অর্থাৎ রেডিও বা বেতার তাঁদের তেমন আকর্ষণ করে না। গ্রামাঞ্চলে এখনও কিছু মানুষ রেডিও শুনে থাকেন বলে লোক মুখে শুনেছি। তবে স্বচক্ষে কাউকে এখন আর রেডিও শুনতে দেখিনি।

রেডিওতে এখনও বিভিন্ন আকর্ষণীয় অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়। বিশেষ করে অনুরোধের আসর, নিবেদন, সমীপেষুসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যাঁদের নাম প্রচারিত হয়, তা হলে স্থানীয়দের মধ্যে তাঁরা একটু জনপ্রিয়তার আস্বাদন পান।

বাংলাদেশ বেতারের সঙ্গীতানুষ্ঠানগুলোও অসম্ভব ভালো লাগার মতো ছিল সেই দিনগুলিতে। কিন্তু বর্তমানে রেডিওতে কি ধরনের সংগীতানুষ্ঠান হয়? তা শুনবার ও জানবার জন্য হঠাৎ হঠাৎ রেডিও খুলে শুনি। কিন্তু মনে হয়, নেই কোনো নতুনত্ব। নেই কোনো বৈচিত্র্য। আগে রেডিও বাজতে বাজতে বন্ধ হয়ে যেতো। এখন ডিজিটাল পদ্ধতিতেও একই সমস্যা। ওটা নাকি সার্ভার সমস্যা। মনে হয়, যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে বাংলাদেশ বেতারের কোনো পরিবর্তন নেই। নেই কোনো আন্তরিক প্রচেষ্টা। বহু রোগব্যাধিতে জর্জরিত বাংলাদেশ বেতার। কিন্তু প্রশ্ন, কে দায়িত্ব নিয়ে সারাবে বেতারের বিভিন্ন রোগব্যাধি?

লিয়াকত হোসেন খোকন
রূপনগর, ঢাকা