বেসরকারি শিক্ষক: পাহাড়সম আর্থিক বৈষম্য নিয়েই যাঁদের পথচলা

সারা জীবন একটি সম্মানজনক পেশায় থেকেও যদি শিক্ষকদের জীবনমানের উন্নয়ন না ঘটে, তাহলে তাঁরা শিক্ষার্থীদের ভালো মানের শিক্ষা দেবেন কীভাবে। পেটে খিদে রেখে কোনো মানুষই সঠিকভাবে কাজ করতে পারেন না।

এ দেশের বেসরকারি শিক্ষকদের শুধু সম্মানই করা হয়, তাঁদের আর্থিক বিষয়টা সেভাবে কেউ তলিয়ে দেখেন না। শিক্ষকদের আর্থিক বিষয়টা গভীরভাবে তলিয়ে না দেখার কারণও আছে। শিক্ষকদের প্রতিদিন পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন কাপড়চোপড় দেখে অনেকেই মনে করেন, শিক্ষকদের কোনো অভাবই নেই। কিন্তু প্রকৃত অবস্থা যে তা নয়, এটি আর সাধারণের মধ্যে কেউ তলিয়ে দেখেন না। কেউ ভাবেন না, এক–দুই জোড়া শার্ট বা প্যান্ট এক–দুই দিন পরপর ধুয়েই তাঁদের চালিয়ে নিতে হয়।

সারা দেশের বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে কাজ করছেন প্রায় পাঁচ লক্ষাধিক শিক্ষক। তাঁদের পরিবারসহ এই পেশাজীবী গোষ্ঠীটির বর্তমান পরিসর বেশ বড়, প্রায় ১৫ লাখের মতো। এ দেশে শিক্ষা ক্ষেত্রে প্রায় ৯৭ ভাগ অবদান রেখে চলেছেন এই ৫ লাখ শিক্ষক। অথচ যাঁদের যাপিত জীবনের বিরাট অংশজুড়ে লেগে আছে আর্থিক অনটন আর বিভিন্ন ক্ষেত্রে বঞ্চনা। মূলত বেসরকারি শিক্ষকদের এ চিত্র অনেক আগে থেকেই।

১৯৮২ সালের আগে বেসরকারি শিক্ষকদের সরকারি অর্থ বিভাগ থেকে বেতন–ভাতার সরকারি অংশ প্রদান করা হতো মাত্র ৫০ ভাগ। ১৯৮২ সালে এরশাদ সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে তা ৮০ ভাগে উন্নীত করা হয়। সে সময় শিক্ষকদের বাড়িভাড়া ছিল ১০০ টাকা আর চিকিৎসা ভাতা ছিল ১৫০ টাকা। এমন অমানবিক ও অবিবেচনাপ্রসূত বাড়িভাড়া এবং চিকিৎসা ভাতার বিষয়ে শিক্ষকসমাজ বছরের পর বছর আন্দোলন করেও তা বাড়াতে পারেনি। এটি বাড়াতে না পারার পেছনে শিক্ষকনেতাদের দলাদলিও কম দায়ী নয়।

পরবর্তী সময়ে ১৯৯১ সালে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় এসে শিক্ষকদের জন্য কল্যাণ ট্রাস্টের ব্যবস্থা করে, যা ছিল বেসরকারি শিক্ষকদের জন্য একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এরপর ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে শিক্ষকদের বেতন–ভাতার সরকারি অংশ ৮০ ভাগ থেকে বাড়িয়ে ৯০ ভাগে উন্নীত করে। এটি বেশ প্রশংসনীয় হলেও শিক্ষকদের দীর্ঘদিনের দাবি বাসাভাড়া এবং চিকিৎসা ভাতা আগের মতোই থেকে যায়। এরপর ২০০১ সালে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় এলে শিক্ষকদের জন্য অবসর–সুবিধা ও ২০ ভাগ উৎসব ভাতার ব্যবস্থা করে এবং বেসরকারি শিক্ষকদের বেতন–ভাতার সরকারি অংশ ১০০ ভাগ করার ঘোষণা দেয়। কিন্তু তারা বেসরকারি শিক্ষকদের বেতন–ভাতার সরকারি অংশ ৯৫ ভাগ পর্যন্ত কার্যকর করতে পেরেছিল। কারণ, তখন ১–১১ সরকার বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এসেছিল। পরবর্তী সময়ে ১–১১ সরকার বিএনপির প্রতিশ্রুত বেসরকারি শিক্ষকদের বেতন–ভাতার সরকারি অংশ বাকি ৫ ভাগ কার্যকর করেছিল।

বেসরকারি শিক্ষকদের বেতন–ভাতার সরকারি অংশ ১০০ ভাগে ভাগে উন্নীত হলেও বাড়িভাড়া, চিকিৎসা ভাতা সেই তিমিরেই রয়ে যায়। এর ফলে সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষকদের মধ্যে বেতন–ভাতার একটি বড় ফারাক রয়ে যায়।

২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এলে শিক্ষকদের দীর্ঘদিনের দাবি বাড়িভাড়া ১০০ থেকে বাড়িয়ে ৫০০ টাকা এবং চিকিৎসা ভাতা ১৫০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১০০০ টাকা করে। অন্যদিকে সরকারি–বেসরকারি সব কর্মচারী–কর্মকর্তার জন্য ২০ ভাগ হারে বৈশাখী ভাতার ব্যবস্থা করে। তা ছাড়া দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে চাকরিজীবীদের জীবনযাপনে যাতে কোনো অসুবিধার সৃষ্টি না হয়, সে জন্য সরকারি–বেসরকারি চাকরিজীবীদের জন্য সময়ে সময়ে মহার্ঘ ভাতার ব্যবস্থা ছিল। আওয়ামী লীগ সরকার এটা তুলে দিয়ে প্রতিবছর চাকরিজীবীদের জন্য ৫ ভাগ হারে ইনক্রিমেন্টের ব্যবস্থা করে। বেসরকারি শিক্ষকদের জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ ছিল খুবই ভালো।

বর্তমানে সেই বাসাভাড়া এবং চিকিৎসা ভাতা নিয়েই শিক্ষকেরা পথ চলছেন। অথচ ২০১৫ সালে আওয়ামী লীগ সরকার যে যুগান্তকরী পে স্কেলের ঘোষণা করেছিল, তাতে সরকারি–বেসরকারি সব কর্মকর্তা–কর্মচারীর বেতন প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেলেও শুধু বেসরকারি শিক্ষকদের বাসাভাড়া এবং চিকিৎসা ভাতা না বাড়ার কারণে তাঁরা আর্থিকভাবে তেমন লাভবান হননি।

একজন সরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারী তাঁর মূল বেতনের প্রায় ৩৫ থেকে ৪০ ভাগ এবং জায়গা ও ক্ষেত্রবিশেষে ৪৫ থেকে ৫০ ভাগ পর্যন্ত বাড়িভাড়া পেয়ে থাকেন। এর ফলে তাঁদের বেতনের সঙ্গে বেসরকারি শিক্ষক–কর্মচারীদের বড় একটি বৈষম্য লেগেই থাকে। তা ছাড়া একজন সরকারি শিক্ষক বা কর্মচারী ১ হাজার ৫০০ টাকা চিকিৎসা ভাতা এবং দুজন পড়ুয়া সন্তানের জন্য মাসিক ১ হাজার ৫০০ টাকা করে শিক্ষা ভাতা পেয়ে থাকেন, যার প্রচলন বেসরকারি শিক্ষকদের ক্ষেত্রে নেই।

এর বাইরে সরকারি শিক্ষকেরা বছরে দুবার উৎসব ভাতা পান মূল বেতনের সমপরিমাণ। বেসরকারি শিক্ষকেরা উৎসব ভাতা পান মূল বেতনের ২৫ ভাগ আর কর্মচারীরা পান ৫০ ভাগ। যে নিয়ম পৃথিবীর কোনো দেশে নেই। অন্যদিকে সরকারি কর্মচারীরা তাঁদের সমগ্র চাকরিজীবনে আর্থিকভাবে অনেক সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকেন। এর ফলে তাঁদের পরিবারে আর্থিক দৈন্য তেমন একটা থাকে না বললেই চলে।

অন্যদিকে বেসরকারি শিক্ষকেরা সরকারি নিয়ম অনুযায়ী তাঁদের বেতনের অনেক কিছু থেকেই বঞ্চিত হওয়ার কারণে তাঁদের পরিবারে আর্থিক দৈন্য লেগেই থাকে। আরও একটি বিষয় হচ্ছে, বেসরকারি শিক্ষকদের চাকরিজীবন শেষে তাঁদেরই জমাকৃত অর্থ থেকে যে অবসর–সুবিধার টাকা দেওয়া হয়, তা–ও অনেক সময় এসব শিক্ষকেরা জীবিত অবস্থায় পান না। এসব টাকা পেতে দীর্ঘ সময় লেগে যায়। এর ফলে চাকরি শেষে বেসরকারি শিক্ষকেরা আরও অসহায় হয়ে পড়েন। জীবনের স্বর্ণালি সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কাটানো শিক্ষকদের অনেক সময় দেখা যায়, নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে অবসরের সময় কোনো আর্থিক সুবিধাও পান না। শেষ বয়সে যেটি একজন শিক্ষকের জন্য সত্যিই দুঃখজনক।

এখন সময় এসেছে দেশের বিশালসংখ্যক বেসরকারি শিক্ষকদের নিয়ে ভাবার। তাঁদের যৌক্তিক দাবিগুলো আন্তরিকতার সহিত বিবেচনা করার। বেসরকারি শিক্ষকদের বাড়িভাড়া একটি যৌক্তিক শতাংশে উন্নীত করা সময়ের দাবি। তা ছাড়া শিক্ষকদের শতভাগ উৎসব ভাতা প্রদান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ুয়া তাঁদের সন্তানদের শিক্ষা ভাতার ব্যবস্থা করা এবং বেতনকাঠামো একটি সম্মানজনক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া। চাকরিজীবন শেষে তাঁরা অবসর–সুবিধা এবং কল্যাণ ট্রাস্টের টাকা যেন খুব স্বল্প সময়ের মধ্যে পেতে পারেন, সে পদক্ষেপও নেওয়া উচিত। কারণ, একজন বেসরকারি শিক্ষক ৬০ বছর বয়স হওয়ার পর তাঁকে যদি অবসর এবং কল্যাণ–সুবিধার জন্য আরও ৩ বছর ঘুরতে হয়, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, এ টাকা তিনি কেন জমিয়েছিলেন? তা ছাড়া বেসরকারি শিক্ষকদের বেতন–ভাতার সরকারি অংশ ব্যাংকে জমা হতে হতে প্রতি মাসের ৮ থেকে ১০ তারিখ পার হয়ে যায়। অনেক সময় এর চেয়েও বেশি সময় লাগে। অথচ সরকারি শিক্ষকেরা তাঁদের বেতন মাসের ১ থেকে ২ তারিখের মধ্যে পেয়ে যান।

আমরা প্রত্যাশা করব, সরকার বেসরকারি শিক্ষকদের দীর্ঘদিনের দাবিগুলো বিচার-বিবেচনা করে এ বিষয়ে  শিক্ষকবান্ধব এবং যুগোপযোগী পদক্ষেপ নেবে। এ বিবেচনায় শিক্ষকদের আর্থিক বিষয়টি সর্বাগ্রে প্রাধান্য দেবে এবং এগুলো বাস্তবায়নে যথাযথ পদক্ষেপ নেবে। আমরা সরকারি এবং বেসরকারি শিক্ষকদের মধ্যে পাহাড়সম আর্থিক বৈষম্য ঘোচাতে রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের কাছ থেকে সুবিবেচনাপ্রসূত পদক্ষেপ প্রত্যাশা করছি।

রতন কুমার তুরী
সিনিয়র প্রভাষক, ইতিহাস বিভাগ,
রাঙ্গুনিয়া হাসিনা জামাল ডিগ্রি কলেজ
রাঙ্গুনিয়া, চট্টগ্রাম