সরকারি হাসপাতালে শৌচাগার ‘অসুস্থ’ থাকে কেন

আপনি কি কখনো দেশের কোনো সরকারি হাসপাতালে রোগী হিসেবে গেছেন? আউটডোরে? কিংবা ইন-প্যাশেন্ট হিসেবে? নিদেনপক্ষে একজন ভিজিটর বা দর্শনার্থী হিসেবে ওখানে যাওয়ার অভিজ্ঞতা আপনার হয়ে থাকবে।

একজন রোগী হিসেবে যদি আপনি কোনো সরকারি হাসপাতালের জেনারেল বেডে ভর্তি হয়ে থাকেন কিংবা তাঁর অ্যাটেনডেন্ট হিসেবে ওখানে অবস্থান করেন, তাহলে নিশ্চয়ই আপনাকে ওখানকার টয়লেট বা শৌচাগারগুলো ব্যবহার করতে হয়েছে।

এ ক্ষেত্রে কিছু অপ্রত্যাশিত ব্যতিক্রম বাদ দিলে আপনার খুব কষ্টকর একটি অভিজ্ঞতা হয়ে থাকবে।

দেশের বিপুলসংখ্যক নিম্ন আয়ের মানুষের চিকিৎসার জন্য শেষ আশ্রয় এই সরকারি হাসপাতালগুলো। বেসরকারি হাসপাতাল/ক্লিনিকগুলোর বিপুল ব্যয়ের তুলনায় সরকারি হাসপাতালগুলোর চিকিৎসাসেবা একরকম ফ্রি।

থাকা-খাওয়ার জন্যও আপনার তেমন কোনো খরচ লাগছে না। তবে আপনাকে হয়তো হাসপাতাল জোগান দিতে না পারলে বাইরে থেকে ওষুধ কেনা লাগতে পারে। কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্যও চার্জ দিতে হতে পারে, তবে তা বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর তুলনায় অনেক কম।

এ ছাড়া আপনি যদি দেশের কোনো বড় হাসপাতালে ইন-প্যাশেন্ট হিসেবে ভর্তি হয়ে থাকেন, তাহলে দেশের সেরা চিকিৎসকদের সেবা পাচ্ছেন। তাঁরা প্রতিদিন এক থেকে দুবার রাউন্ডে এসে আপনাকে দেখে যাবেন।

বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে তাঁরাই কিংবা তাঁদের সমকক্ষ কেউ হয়তো আপনার চিকিৎসা দিতেন। তবে হ্যাঁ, এটা ঠিক যে বেসরকারি হাসপাতালগুলোর মতো আপনার নিজস্ব পছন্দের কোনো চিকিৎসককে ওখানে আপনি চিকিৎসা দেওয়ার জন্য পাবেন না।

এত কিছুর পরেও, যদি না আপনি কোনো কেবিন বরাদ্দ পেয়ে থাকেন, বরং একজন ইন-প্যাশেন্ট হিসেবে জেনারেল বেডে আপনার স্থান হয়, তাহলে ২৪ ঘণ্টা যেতে না যেতেই আপনার মনে হবে, কবে আল্লাহ এখান থেকে বের করে নিয়ে যাবেন।

আপনার দেখাশোনার জন্য যদি কেউ সঙ্গে থাকেন, তাঁরও একই অনুভূতি হবে। কিন্তু কেন? না, চিকিৎসাসংশ্লিষ্ট কোনো অব্যবস্থাপনা বা ঘাটতির জন্য নয়—শুধু টয়লেটগুলোর করুণ অবস্থার জন্য।

টয়লেট ব্যবহার করতে গিয়ে হয়তো দেখবেন, দুর্গন্ধের জন্য ঢোকাই যাচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যাবে, টয়লেট ব্যবহার করার পর যে ফ্ল্যাশ করবেন, সেই জো নেই। সেগুলো নষ্ট হয়ে পড়ে আছে।

কোথাও হয়তো দেখবেন, টয়লেটের মেঝেতে নোংরা পানি জমে আছে। কোথাও বা পানির কলগুলো ঠিকমতো কাজ করছে না। টয়লেট টিস্যু বা হাত ধোয়ার জন্য সাবানের কোনো ব্যবস্থা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে পেয়ে থাকলে নিজেকে সৌভাগ্যবান ভাবতে পারেন।

এই দুরবস্থা দেখে আপনার শঙ্কা হতে পারে, এখান থেকে আপনাকে নতুন কোনো রোগ বাধিয়ে ফিরতে হয় কি না।

বিষয়টিকে হালকাভাবে নেওয়ার সুযোগ নেই। কারণ, দেখা গেছে, নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর পাবলিক টয়লেট—যা অনেক লোক একসঙ্গে ব্যবহার করে থাকে, সেখান থেকে জন জনান্তিকে নানাবিধ রোগ ছড়াতে পারে।

পাবলিক টয়লেটের মাধ্যমে সচরাচর যেসব রোগ বা জীবাণু ছড়াতে পারে, তার মধ্যে রয়েছে ই-কোলাই, স্যালমোনেলা, নরোভাইরাস, এমআরএসএ, হেপাটাইটিস এ, ইনফ্লুয়েঞ্জা, এমনকি কমন কোল্ড।

কিছু ক্ষেত্রে এসব রোগের কারণে তীব্র পেটব্যথা, জ্বর ও শারীরিক অবসাদ দেখা দিতে পারে। আবার কিছু ক্ষেত্রে গলা ও ত্বকের সমস্যা দেখা যায়। কখনো কখনো রোগের উপসর্গ সপ্তাহখানেক স্থায়ী হতে পারে।

কিছু বিরল ক্ষেত্রে এসব রোগের কোনো কোনোটির কারণে জীবন সংশয় হতে পারে। খুব গুরুতর নয়, এমন ক্ষেত্রেও আক্রান্ত ব্যক্তি অফিস মিস করার মতো যথেষ্ট অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন।

সাধারণভাবে মনে করা হয়ে থাকে, বেশির ভাগ বাথরুমের জীবাণু টয়লেটের সিটে থাকে। কিন্তু বাস্তবতা হলো টয়লেটের মেঝে ও অধিক স্পর্শ লাগে এমন পৃষ্ঠগুলো—যেমন ধরুন সিংক, কলের হাতল, হ্যান্ড ড্রয়ার, লাইটের সুইচ, দরজার নব—এসবে অনেক বেশি সংখ্যায় জীবাণুর উপস্থিতি থাকে।

আমেরিকান সংবাদমাধ্যম এবিসি নিউজের এক অনুসন্ধানে দেখা গেছে, পাবলিক টয়লেটের মেঝেতে প্রতি ইঞ্চিতে প্রায় ২০ লাখ ব্যাকটেরিয়া থাকে। কাজেই, আপনি যদি কোনো কিছু স্পর্শ নাও করেন, আপনার জুতার তলায় করেও আপনি জীবাণু বহন করে নিয়ে যেতে পারেন।

শুধু তা–ই নয়, নারীদের হ্যান্ডব্যাগ যদি টয়লেটের মেঝেতে বা সিংকের কাউন্টারে রাখা হয়ে থাকে, তাহলে সেটার সঙ্গেও জীবাণুবাহিত হতে পারে। এ কারণে আপনার সঙ্গে থাকা জিনিসপত্র ঝুলিয়ে রাখার জন্য দরজায় বা দেয়ালে যে অন্তত একটি হুক থাকা দরকার, সেটা কেন জানি অনেকের মাথায় আসতে চায় না।

এখন আপনি যদি টয়লেটের জীবাণু বহন করছে এমন কোনো দূষিত বস্তু বা পৃষ্ঠ স্পর্শ করেন, পরে ঠিকমতো হাত না ধুয়ে ওই হাত ব্যবহার করে খাবার প্রস্তুত বা গ্রহণ করেন, তাহলে হাতে থাকা জীবাণু দ্বারা সংক্রমিত হতে পারেন।

এ ধরনের খাবার অন্য কেউ গ্রহণ করলে সে–ও সংক্রমিত হতে পারে। অপরিচ্ছন্ন টয়লেট ফ্ল্যাশ করার সময় চারদিকের বাতাসে ছড়িয়ে পড়া জলকণা নিশ্বাসের সঙ্গে গ্রহণ করলেও তাতে থাকা জীবাণুতে সংক্রমিত হতে পারেন।

কাজেই, বোঝা যাচ্ছে, পাবলিক টয়লেট নিয়মিত পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন রাখা, এর মেঝে–দরজা ইত্যাদি নিয়মিত বিরতিতে জীবাণু মুক্ত করা এবং টয়লেটের বাতাস দূষণমুক্ত রাখা, টয়লেটবাহিত রোগব্যাধি ছড়িয়ে পড়া রোধ করার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

হাসপাতালের মতো জায়গায় এর গুরুত্ব সমধিক, কারণ এখানে নানা রকমের রোগব্যাধি নিয়ে অসংখ্য মানুষ এসে থাকেন।

দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোর টয়লেট ব্যবস্থাপনার যে করুণ চিত্র ওপরে তুলে ধরেছি, তা থেকে বেরিয়ে আসা যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা এই আলোচনা থেকে সহজেই অনুমেয়।

টয়লেট ব্যবস্থাপনার করুণ দশার একটি কারণ হতে পারে, এসব হাসপাতালে ধারণক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি রোগী ভর্তি হয়ে থাকেন। হতে পারে, টয়লেটগুলো যতসংখ্যক লোক ব্যবহার করে, তার তুলনায় পরিচ্ছন্নতাকর্মী সংখ্যায় অপ্রতুল। ঢিলেঢালা প্রশাসন এবং অপর্যাপ্ত নজরদারিও কারণ হিসেবে কাজ করে থাকতে পারে।

প্রশ্ন হলো দেশের বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে যদি একটা ছিমছাম ও পরিচ্ছন্ন স্যানিটেশন সিস্টেম বাস্তবায়ন করা যায়, তাহলে সরকারি হাসপাতালে করা যাবে না কেন?

দেশে যানবাহনের ব্যস্ত রুটগুলো, যেমন ধরুন ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে বিপুলসংখ্যক যাত্রীর রিফ্রেশমেন্টের জন্য মাঝপথে যানবাহন যাত্রাবিরতি করে থাকে। সেখানে এই বিপুলসংখ্যক যানবাহনে যাতায়াতকারী যাত্রীদের প্রায় সবাই রেস্তোরাঁর টয়লেট–সুবিধা নিয়ে থাকেন।

আপনি কদাচিৎ দেখবেন, এগুলো ঠিকমতো পরিষ্কার করা হচ্ছে না। হজের সময় লাখ লাখ হাজি কাবা শরিফ ও মসজিদে নববীর টয়লেট–সুবিধা ব্যবহার করে থাকেন। এগুলোর পরিষ্কারের ক্ষেত্রে কোনো রকম অব্যবস্থাপনার অভিযোগ কদাচিৎ পাবেন।

তাহলে আমাদের দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোর টয়লেট সুবিধা—যেগুলো বড় জোর দৈনিক কয়েক শ থেকে কয়েক হাজার লোক ব্যবহার করে থাকেন—যথাযথভাবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা এত কঠিন হবে কেন?

পরিচ্ছন্নতাকর্মীর সংখ্যা অপ্রতুল হলে তাদের সংখ্যা বাড়াতে হবে। স্থায়ী ভাবে পরিচ্ছন্নতা কর্মীর সংখ্যা বাড়ানো না গেলে, প্রয়োজনে খণ্ডকালীন নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। এটার জন্য বাজেট সংকট হওয়ার কথা নয়।

আর যদি হয়েও থাকে, উন্নত স্যানিটেশন নিশ্চিত করতে প্রয়োজনে রোগীরা আলাদা চার্জ জোগাতে সানন্দে রাজি হবেন বলে বিশ্বাস। শুধু জরাজীর্ণ টয়লেট ব্যবস্থাপনার কারণে দেশের সরকারি হাসপাতালগুলো উন্নত চিকিৎসাসেবা দিয়েও যে মারাত্মক ইমেজ–সংকটে আছে, সে বিষয়টি হাসপাতালের ব্যবস্থাপনায় যাঁরা আছেন, তাঁরা যত তাড়াতাড়ি বুঝবেন ততই মঙ্গল।

  • ড. মুহম্মদ দিদারে আলম মুহসিন অধ্যাপক, ফার্মেসি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।