‘আমার বাচ্চা দেশ সেরা স্কুলে পড়ে, আপনার বাচ্চা কোথায় পড়ে?’

সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে সব বাবা-মা চিন্তামগ্ন থাকে, সেটিই স্বাভাবিক। কিন্তু আমার মনে হয়, সন্তানের ভবিষ্যতের চেয়ে আজকালকার বাবা-মায়েরা নিজেদের কথাই বেশি ভাবে। যদিও আমি জানি এবং বিশ্বাস করি, আমার এই কথার সাথে অনেক মানুষই একমত হতে পারবে না। এই যে, মা–বাবারা সন্তানকে নামি-দামি স্কুল, সেরা শিক্ষকের কাছে পড়াতে পিছপা হন না, তার একমাত্র কারণ নিশ্চয়ই সন্তানের ভবিষ্যৎ নয়; এর পেছনে আরও অনেক কারণ আছে, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো সমাজে নিজেদের ‘স্ট্যাটাস’ ঠিক রাখা। যেন পাশের বাসার ভাবি বলতে না পারেন, আমার বাচ্চা দেশ সেরা স্কুলে পড়ে, আপনার বাচ্চা কোথায় পড়ে?

এর বাইরে আরও যে কারণগুলো আছে তা হলো—সেরা স্কুল-কলেজে পড়লে বাচ্চার ভবিষ্যৎ বেশি উজ্জ্বল হবে, ফলে সে ভালো কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করবে, এরপর বেশি বেতনে ভালো চাকরি করবে। বৃদ্ধ বয়সে তারা সন্তানের সাথে খুব আরাম-আয়েশে দিন কাটাতে পারবে। এ কারণেই কোনো কোনো মা-বাবা সন্তানের নিজস্ব স্বপ্নকে গলাটিপে হত্যা করে, তার ওপর চাপিয়ে দেয় নিজেদের অপূরণীয় স্বপ্ন। হয়তো বাবা-মা নিজেরা চিকিৎসক হতে চেয়েছিলেন কিন্তু পারেননি। এখন তাঁরা স্বপ্ন দেখেন তাদের সন্তান চিকিৎসক হবে। সে অনুযায়ী নানাভাবে সন্তানকে চাপ দিতে থাকেন। ফলে সন্তানের প্রকৌশলী বা ক্রিকেটার বা শিক্ষক হওয়ার যে স্বপ্ন ছিল তা নিমেষেই মাটিতে চাপা পড়ে যায়। এভাবে না জানি, এ দেশের কতো ছেলে-মেয়ের নিজের স্বপ্ন নিজের অজান্তেই কোরবানি হয়ে গেছে। আমি যা বলছি, এটা একান্তই আমার ভাবনা থেকে বলছি। আমি বিশ্বাস করি, এই কথার সাথে অধিকাংশ অভিভাবকই একমত হবে না।

বাংলাদেশের সেই সব অভিভাবকের কাছে আমার প্রশ্ন, যারা সন্তানদের দেশ সেরা স্কুল-কলেজে ভর্তি করানোর জন্য সকাল-সন্ধ্যা সন্তানের ওপর বইয়ের বোঝা চাপিয়ে দিয়েছেন এবং মোটা অঙ্কের ডোনেশান দিয়েছেন; আপনারা কি নিশ্চিত করে বলতে পারবেন: যদি নামি-দামি সেই সব স্কুলে বাচ্চাকে ভর্তি করানোর পরও সেই বাচ্চাকে সেই স্কুলের স্যারদের কাছে কিংবা অন্য কোনো স্যার বা কোচিং-এ প্রাইভেট পড়াতে হবে না? যদি আপনার উত্তর ‘হ্যাঁ’ হয়, তাহলে নামি-দামি স্কুলে ভর্তি করে লাভ কী? এটা ঠিক যে, ভালো স্কুলের পরিবেশ ভালো হয় এবং পড়াশোনার মানও তুলনামূলকভাবে অনেক ভালো হয়। তার মানে এই নয় যে, অপেক্ষাকৃত সাধারণ মানের স্কুলের ছেলে-মেয়েরা কিছুই শেখে না এবং জীবনে কিছুই হতে পারে না।

আমার পরামর্শ হচ্ছে, যে টাকা আপনার বাচ্চাকে নামি-দামি স্কুলে ভর্তির জন্য খরচ করতে চাইছেন কিংবা ডোনেশান দিতে চাইছেন কিংবা কোচিং প্রাইভেট করে খরচ করবেন সেই টাকা আপনার হাতে রাখুন। বাচ্চাকে বাসার আশে-পাশের সাধারণ কোনো স্কুলে ভর্তি করান। তারপর সেই হাতে রাখা টাকাগুলো বাচ্চার পড়াশোনার এবং সার্বিক কল্যাণের জন্য খরচ করুন। দেখবেন আপনার বাচ্চা অনেক নামি-দামি স্কুলের সেরা ছাত্র-ছাত্রীর চেয়ে কোনো অংশেই খারাপ রেজাল্ট করবে না। বরং তার ওপর চাপ কম থাকায় সে বরং পড়াশোনার পাশাপাশি কো-কারিকুলার এক্টিভিটিসগুলোতেও ভালো করবে। তাদের শৈশব-কৈশোর হারিয়ে যাবে না। এখান থেকে ওখানে কিংবা ওখান থেকে এখানে যাওয়া-আসা করে যে সময় নষ্ট হয় সেই সময়টাও সে কাজে লাগাতে পারবে।

মূল কথা হচ্ছে ভালো স্কুলে ভর্তির জন্য যদি এতই দৌড়ঝাঁপ করবেন তাহলে কেন বাচ্চাকে ধর্ম কিংবা শারীরিক শিক্ষার মতো সাধারণ বিষয়ও স্কুলেরই শিক্ষকের বাসায় প্রাইভেট পড়তে যেতে হবে? তাহলে ভালো স্কুল, নামি-দামি স্কুল আপনার বাচ্চাকে কী দিচ্ছে? কোচিং-প্রাইভেটে যদি যেতেই হয় তাহলে নামি-দামি স্কুল আর ঘরের পাশের সাধারণ স্কুলের মধ্যে পার্থক্য কোথায়?

আমরা মনে করছি, ভালো স্কুল-কলেজে ভর্তি না করলে আমাদের সন্তানরা ভালো মানুষ হতে পারবে না, প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে না। এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। বেরিয়ে আসুন আপনাদের ‘দিবাস্বপ্ন’ থেকে। বাস্তবতা বুঝতে চেষ্টা করুন। এখন চলছে শিক্ষাবাণিজ্য। যে যাই বলুক না কেন, নিজ থেকে একটু চিন্তা করে দেখুন! তাহলেই সব পরিষ্কার হয়ে যাবে। এই সব শিক্ষাবাণিজ্যের বিরুদ্ধে এখনই সোচ্চার হোন।

প্রাইভেট এবং কোচিং যেখানে করতেই হচ্ছে সেখানে নামি-দামি স্কুলে পড়ানো আর না পড়ানো সমান কথা। আমি আবারও বলতে চাই নামি-দামি স্কুলের পরিবেশ অনেক ভালো এবং পড়াশোনার মানও অনেক অনেক ভালো কিন্তু ওইসব প্রতিষ্ঠান একই সাথে আপনার সন্তানের ওপর নানা চাপ তৈরি করছে এবং সাথে সাথে আপনার পকেট খালি হচ্ছে। আর সন্তানেরা মনের মধ্যে কী লড়াই একা একা করে চলেছে তার খবর আমরা কেউ রাখি না। ক’দিন আগে এক মেয়ে ভর্তি পরীক্ষায় টিকেনি বলে আত্মহত্যা করেছে, তার জন্য আমি আপনি সবাই কি দায়ী নই?
প্রতিযোগিতার এই বিশ্বে কাউকে না কাউকে হারতেই হবে কিন্তু একবার হার মানেই জীবন শেষ নয়, এই শিক্ষাটা আমরা কেউ আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে দিচ্ছি না। ফলে স্বপ্নগুলো মরে যাচ্ছে সেই সাথে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদেরই উজ্জ্বল সম্ভাবনাময় কোনো কিশোর-কিশোরী বা তরুণ-তরুণী। অনুরোধ, মিছে ভ্রমের পেছনে ছুটবেন না। বাচ্চার ভবিষ্যতের কথা যদি চিন্তা করতেই হয় তবে ভেবে দেখুন আপনি ভুল পথে এগোচ্ছেন কী না?

আলী ওসমান শেফায়েত
শিক্ষক, মাস্টার তালেব উল্লাহ মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ
কুতুবদিয়া, কক্সবাজার
ইমেইল: [email protected]