কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে পটিয়ার ঐতিহ্যবাহী আমজুর বলীখেলা

আমজুর বলীখেলার ১০১তম আসরে বিজয়ী টেকনাফের ছিদ্দিক বলীর সাথে করিমুদ্দিন বলীর খেলার দৃশ্য। পটিয়া, ২৭ এপ্রিল ২০০৯
ছবি সৌজন্য: ইকবাল হোসেন

অনেকটা আনন্দমাখা কুস্তিগিরি শক্তি পরীক্ষার খেলা হলো বলীখেলা। মেলা-পার্বণ লোকসাহিত্যের ইতিহাসে দেখা যায়, বাংলাদেশে বলীখেলা শুধু চাটগাঁইয়াদের। চট্টগ্রামের নিজস্ব সংস্কৃতিও বটে। এটি অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি খেলা। বলী শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো শক্তিশালী বা পরাক্রমশালী লোক, বীরপুরুষ, শক্তসামর্থ্য। অর্থ শুনে বোঝা যায়, বলীখেলা মানে শক্তিশালীর মল্লযুদ্ধ বা কুস্তি প্রতিযোগিতা। বলীখেলা চট্টগ্রামের লোকসংস্কৃতির একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ। চাটগাঁর মল্ল নামে খ্যাত বহু পরিবার আদিকালের হিন্দু-মুসলিম পরিবারে দেখা যায়। মল্ল শব্দের অর্থ কুস্তিগির, বলী হলো খালি হাতে কুস্তি ধরা।

গবেষক আবদুল হক চৌধুরীর মতে, ‘চট্টগ্রামের ২২টি মল্ল পরিবার ইতিহাস বিখ্যাত। এসব পরিবারের প্রায় সব কটিই পটিয়া থানায় অবস্থিত। যেমন, পটিয়া আশিয়া গ্রামের আমান শাহ মল্ল, চাতরির চিকন মল্ল, জিরির ইদ ও নওয়াব মল্ল, পারিগ্রামের হরি মল্ল, হাইদগাঁওয়ের অলি মল্ল, পেরালার নানু মল্ল ও মোজাহিদ মল্ল, গোরাহিত মল্ল, পটিয়ার হিলাল মল্ল, শোভদণ্ডির তোরপাচ মল্ল, নাইখাইনের বোতাত মল্ল, গৈড়লার ছুয়ান মল্ল। এ মল্ল হলো বলী বা কুস্তিগির। যাঁরা কুস্তি বা বলী ধরে তাঁদের মল্ল বলা হয়।’

ব্রিটিশ আমল থেকেই পটিয়ায় বলীখেলার আয়োজন হয়ে আসছে। সে সময় বিত্তবানেরা মাইকিং করে ঢাকঢোল পিটিয়ে বলীখেলার আয়োজন করতেন। সুনাম ও খ্যাতি অর্জনের জন্য অনেকে এ খেলার আয়োজন করতেন, যা আজ আর কারও অজানা নয়।

১৯০৯ সালের ২৬ এপ্রিল চট্টগ্রামে বকশিহাটের বদরপাতি এলাকার গোলাম রসুল সওদাগরের পুত্র আবদুল জব্বার সওদাগর ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে যুবসমাজকে শারীরিকভাবে ঐক্যবদ্ধ করতে বলীখেলার আয়োজন করেন। জব্বারের বলীখেলা ধারাবাহিকভাবে আয়োজন হয় চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক লালদীঘি মাঠে। কোভিড-১৯–এর কারণে গত দুই বছর বন্ধ থাকলেও চলতি বছরের মে মাসে ঐতিহাসিক লালদীঘির মাঠে ১১৩তম জব্বারের বলীখেলা সম্পন্ন হয়।

পটিয়ার চরকানাই ও বাজি পুইজ্যার বলীখেলা পটিয়ার অন্যতম বলীখেলা। সত্তরের দশকে এ বলীখেলা ও মেলা বন্ধ হয়ে যায়। এর অপর নাম সফর আলী মুন্সীর বলীখেলা। যেদিন বলীখেলা হতো সেদিন খেলা শেষে নানা প্রকারের বাজি পোড়ানো বা ফোটানো হতো, এ জন্য এটি ‘বাজপুইজ্যার বলীখেলা’ নামেও পরিচিত ছিল।

বলীখেলার দিনতারিখ ঠিক হলে হাটবাজারে ঢোল পিটিয়ে লোকজনদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হতো। কেউ কেউ কেরোসিনের টিন/চামড়ার ঢোল পিটিয়ে গ্রামেগঞ্জে বলীখেলার দাওয়াত করত।

বলীখেলার উদ্ভবের ইতিকথা–সম্পর্কিত বিবরণে কবি আলাদীন আলীনূর লিখেছেন, ‘কবি কালীদাসের জন্মভূমি পশ্চিম মালব, অর্থাৎ পটিয়ার মালিয়ারা থেকে এবং কবি আফজাল আলীর জন্মভূমি পূর্ব মল্লর, অর্থাৎ সাতকানিয়ার মল্ল বা মিলুয়া থেকে প্রথম মল্লক্রীড়ার অনুষঙ্গী হিসেবে বলীখেলার উদ্ভব হয় এবং তা সমগ্র চট্টগ্রামে জনপ্রিয়তা লাভ করে।’

পটিয়ায় তুফান আলী মুন্সীর বলীখেলা ও টেগর পুনির বলীখেলার বেশ সুখ্যাতি ছিল। বৈশাখ মাসে এ খেলার আয়োজন করা হতো। পটিয়ায় প্রথম খেলার আয়োজন করেন পটিয়া পৌরসভার ৬ নম্বর ওয়ার্ডের (পাইকপাড়া) পরীর দিঘি এলাকার প্রয়াত তুফান আলী মুন্সী। পরীর দিঘির দক্ষিণ পাড়ে তোফায়েল আলী মুন্সীর খেলা নামেও একসময় বলীখেলার প্রচলন ছিল। পরবর্তীকালে পরীর দিঘির খেলা নামে যা পরিচিতি লাভ করে। পাকিস্তান আমলে পরীর দিঘির বলীখেলা বিলুপ্ত হয়ে যায়। পরবর্তীকালে চল্লিশের দশকের দিকে তাঁর ছেলে পটিয়া ইউনিয়ন পরিষদের তৎকালীন চেয়ারম্যান মনির আহমেদ বলীখেলার আয়োজন করতেন।

পরবর্তীকালে পঞ্চাশের দশকের দিকে পটিয়া ইউপি চেয়ারম্যান প্রয়াত আমজু সওদাগর এ খেলা নিজ নামে প্রবর্তন করেন। ফলে পটিয়ায় ‘আমজুর বলীখেলা’ নামে প্রচলন হয়। আমজু মিয়া সওদাগর মারা যাওয়ার পর তাঁর ছেলে আবু মুছা সওদাগর এ খেলার আয়োজন করতেন। বর্তমানে আমজু মিয়া সওদাগরের উত্তরসূরি এ খেলার আয়োজন করেন। আমজু মিয়া সওদাগরের চাচাতো ভাই হাজি আবুল বশর (৭৩) জানান, ‘১৯৫৫ সাল থেকে আমজু মিয়ার বলীখেলা উপভোগ করে আসছি, তবে তাঁর পূর্বে বলীখেলার প্রচলন শুরু হয় পটিয়ায়। ছোটবেলায় দেখতাম, বলীখেলাকে কেন্দ্র করে বিশাল মেলা বসত এবং বহু দূরদূরান্ত থেকে বেশ লোকের সমাগম হতো। ঢোল বাজা ব্যান্ডপার্টিসহ নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন হতো বাড়ির সামনের খোলা মাঠে। কী যে আনন্দ হতো তখন, কিন্তু এখন আর সেই আনন্দ নেই। সর্বশেষ ২০১৮ সালে আমজু মিয়ার ১১৫তম বলীখেলা ও বৈশাখী মেলার আয়োজন হয়। একসময় পটিয়ার ভাটিখাইন নিবাসী মরহুম আবদুল বারিক চৌধুরী ভাটিখাইন গ্রামে এ বলীখেলার আয়োজন করতেন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁরই উত্তরসূরিরা বলীখেলার আয়োজন করতেন, যা আজ বিলুপ্ত।’

বলীখেলা নিয়ে চট্টগ্রাম সরকারি সিটি কলেজের বাংলা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আবদুল আলিম বলেন, ‘যে খেলায় নির্মল আনন্দ আছে, যে খেলায় সর্বস্তরের মানুষ নির্মল আনন্দ খুঁজে পায়, সেটার নামই বলীখেলা। ১৯৬৯-৭০ সালের কথা, ছেলেবেলায় নির্মল আনন্দ খুঁজে পেতাম আমজু মিয়ার বলীখেলায়। প্রতীক্ষায় থাকতাম, কখন বৈশাখ মাস আসবে, কখন বলীখেলা শুরু হবে। বলীখেলার চেয়েও বেশি আনন্দ পেতাম মেলায়। ঢোলের তালে তালে শুরু হতো বলীখেলা। খেলার মাঠের চারদিকে হাজার হাজার লোক দাঁড়িয়ে-বসে বলীখেলা উপভোগ করত। বাঁশির আওয়াজ, উপচে পড়া মানুষের ভিড়, চিৎকার চেঁচামেচি, সন্ধ্যায় আতশবাজির উৎসব—আহা কী নির্মল আনন্দ! সেদিন উপভোগ করতাম। কালের বিবর্তনে আজ সেটা এখন হারিয়ে যেতে বসেছে।’

পটিয়ায় আমজু মিয়ার বলীখেলা প্রতিবছর বৈশাখ মাসের মাঝামাঝিতে অনুষ্ঠিত হয়। পটিয়া বাসস্ট্যান্ডের দক্ষিণ পাশে বৈলতলী রোড–সংলগ্ন আমজু মিয়া সওদাগরের বাড়ির সামনে খোলা মাঠে বলীখেলার আসর বসত। কিন্তু কালের বিবর্তনের আমজুর বলীখেলাও আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। পাঁচ বছর ধরে আমজু মিয়ার বলীখেলার আয়োজন হয় না।

পটিয়ার সম্মানিত জনপ্রতিনিধি ও উপজেলা প্রশাসনের প্রতি সবিনয় নিবেদন, বলীখেলা আমাদের চট্টগ্রামের নিজস্ব লোকসংস্কৃতির অংশ। আকাশ-সংস্কৃতি ও ডিজিটালের জাঁতাকলে বলীখেলা যেন হারিয়ে না যায়। ঢাকঢোল পিটিয়ে আতশবাজি উৎসবের মাধ্যমে আবারও বলীখেলার আয়োজন করা হোক। নাগরদোলা, বাঁশি, টমটম গাড়ির শব্দ, লোকজ শিল্পের পণ্যের মেলায় মানুষের নির্মল আনন্দ ফিরে আসুক এই গ্রামবাংলায়।

  • রশীদ এনাম চট্টগ্রামের লোকজ সংস্কৃতি নিয়ে গবেষণার সঙ্গে যুক্ত আছেন এবং সমন্বয় সহকারী, ইতিহাসের খসড়া। [email protected]