উনুনে দুধ উপচে পড়ার মতো ‘উন্নয়ন’ আর কত

উনুনের আগুনে পাতিলে দুধ সেদ্ধ করতে গেলে প্রথম দিকে তা অস্বাভাবিকভাবে ফুলতে থাকে। আগুনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ না করলে একপর্যায়ে পাতিল উপচে পড়তে শুরু করে। উনুনের আগুনের মাত্রা কমিয়ে তা নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে সম্পূর্ণ দুধই পাতিল উপচে বাইরে পড়ে যায়। ফলে পাতিল দুধশূন্য হয়ে যায়। আবার কখনো দুধ পড়ে আগুন নিভে যেতেও দেখা যায়। তখন পরিবারের সদস্যরা কাঙ্ক্ষিত দুধ পান থেকে বঞ্চিত হয়। আবার অসতর্কভাবে মেঝেতে গড়িয়ে পড়া দুধে পা দিলে পিছলে মারাত্মক জখমের সম্মুখীনের আশঙ্কাও থাকে।

উনুনে দুধ সেদ্ধ করার ধারণার সঙ্গে উন্নয়নশীল বিশ্বের উন্নয়নপ্রক্রিয়ার অনেকটা মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। উন্নয়নের প্রথম দিকে পাতিলে দুধের উথালপাথালের মতো অর্থনীতিতেও নানা উৎস থেকে অর্থের প্রবাহ আসতে থাকে। এ ক্ষেত্রে ঔপনিবেশিক মানসিকতার একশ্রেণির আমলা, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী এবং মধ্যস্বত্বভোগী নিজেদের আখের গোছানোর জন্য উন্নয়নপ্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত হয়ে দুর্নীতিতে লিপ্ত হন। উনুনের আগুনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণের মতো তাঁদের সুশাসনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। নয়তো তাঁরা দেশের অর্থ লোপাট করে দেশের বাইরে পাচার করে ফেলেন। নানা কৌশলে তাঁরা নীতিনির্ধারণী মহলের মন জয় করেন। তারপর সুযোগ বুঝে নিজেদের আখের গোছায়। তাঁরা এতটা কৌশলী যে দেশ সময়মতো তাঁদের দুরভিসন্ধি ধরতে ব্যর্থ হয়।

তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নের সুফল পাতিলের গায়ে, উনুনের পেটে কিংবা মেঝেতে গড়াগড়ি খায়। আর জনগণের কপালে জোটে ক্ষুধা, দারিদ্র্য, বেকারত্ব, মূল্যস্ফীতি, মুদ্রাস্ফীতিসহ নানা বঞ্চনা। এ সবকিছুর উৎকৃষ্ট উদাহরণ বর্তমান শ্রীলঙ্কা।

কৌশলের অংশ হিসেবে তাঁরা আগুনের তাপে পাতিলে দুধ ফুলতে থাকা উন্নয়নের প্রক্রিয়াকে উন্নয়ন হিসেবে প্রচার করে নীতিনির্ধারণী মহলকে ফাঁদে ফেলেন। সুশাসনের মাধ্যমে উন্নয়নপ্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত লুটেরাদের নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হলে তাঁদের পাতানো ফাঁদে পড়ে যায়। এই সুযোগে উনুন থেকে দুধ উপচে পড়ার মতো উন্নয়নের মুখোশধারীরা জনগণের অর্থ আত্মসাৎ এবং তা বিদেশে পাচারে ব্যস্ত থাকেন। সেই টাকা সুইস ব্যাংকে জমা হয় কিংবা বেগমপাড়ার মতো নিরাপদ গন্তব্যে ঠাঁই পান। আর উপচে পড়া দুধশূন্য পাতিলের মতো দেশ অর্থশূন্য হয়ে পড়ে। ফলে পরিবারের সদস্যদের দুধ পান থেকে বঞ্চিত হওয়ার মতো জনগণও উন্নয়নের কাঙ্ক্ষিত সুফল থেকে বঞ্চিত হয়।

অন্যদিকে উন্নয়নপ্রক্রিয়ায় উন্নয়নের সুফল যতটুকু দেশে রয়ে যায়, তা–ও ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কেননা, উন্নয়নপ্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত লুটেরাদের চক্রান্তে দেশে দুর্বল কিংবা ব্যবহার অনুপযোগী নিম্নমানের অবকাঠামো গড়ে ওঠে, যা মেঝেতে গড়ানো দুধের মতো উপকার তো নয়, বরং মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়ে ওঠে। তবে মেঝেতে গড়ানো দুধেও লুটেরাদের উন্নয়নের ছোঁয়া খুঁজে পায়। কারণ, এই গড়ানো দুধ তাঁদের নিজেদের সন্তানদের বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ায় না। কেননা, তাঁদের সন্তানেরা তো বেগমপাড়ার মতো নিরাপদ স্থানের বাসিন্দা।

তাই এককথায় বলা যায়, তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নের সুফল পাতিলের গায়ে, উনুনের পেটে কিংবা মেঝেতে গড়াগড়ি খায়। আর জনগণের কপালে জোটে ক্ষুধা, দারিদ্র্য, বেকারত্ব, মূল্যস্ফীতি, মুদ্রাস্ফীতিসহ নানা বঞ্চনা। এ সবকিছুর উৎকৃষ্ট উদাহরণ বর্তমান শ্রীলঙ্কা।

  • ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ অধ্যাপক, স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়