বিকেএসপি: ফিরে আসুক ঐতিহ্যবাহী সাদা পোশাক

বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে (বিকেএসপি)

‘সাদা সাদা কালা কালা
রং জমেছে সাদা কালা
হইছি আমি মন পাগেলা বসন্ত কালে...’

গানের কলিগুলো এখন প্রায় সবার মুখে মুখেই শোনা যায়। বেসুরো গলায় আমিও গাই। তবে মাথায় সাদা সাদা কথাটাই বেশি ঘুরপাক খায়। মনে পড়ে সাদা পোশাকের সেই রঙিন দিনগুলির গল্প। ক্লাস সেভেন থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত ছোট্ট জীবনের সেই সোনালি দিনগুলি, পোশাক সাদা হলেও বাহারি রঙে রঙিন ছিল সে কৈশোর।

আমার কৈশোর ও বাড় বাড়ন্ত বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে (বিকেএসপি)। খেলোয়াড় তৈরির প্রতিষ্ঠান ‘বিকেএসপি’ আমার কাছে চির যৌবনা আর জাদুকরী একটা নাম। শব্দটি কোথাও দেখলে বা শুনলে কলিজার মধ্যে নাড়া দেয়। প্রায় সাত বছরের বিকেএসপি অধ্যায়ে চার দেয়ালের বন্দী জীবন কখনোই কষ্ট দেয়নি। ছিল প্রাণ ভরা উচ্ছ্বাস, স্যারদের চোখ ফাঁকি দিয়ে দরজার আড়ালে ভীরু-ভীরু দীর্ঘশ্বাস। এক ঝাঁক মন মাতানো বন্ধুদের প্রতি ছিল অগাধ বিশ্বাস। বিকেএসপি দিয়েছে মাথা গোঁজার ঠাঁই, করেছে পেট ভরে খাবারের ব্যবস্থা, পেয়েছি মাথা তুলে দাঁড়াবার প্রাতিষ্ঠানিক দিক নির্দেশনা। তাই ছোট্ট এই জীবনে বিকেএসপির মতো করে আর কাউকে ভালোবাসতে পারিনি।

স্মৃতির সরণি বেয়ে ১৯ বছর আগে ফিরে গিয়ে ২০০৩ সালের জুলাইয়ের সেই প্রথম দিনটার কথা চোখের সামনে ভেসে উঠে। অনেক বাছাই পেরিয়ে বিকেএসপির সাদা পোশাক গায়ে জড়ানোর সৌভাগ্য হয়েছিল। আমাকে বিকেএসপিতে দিতে এসে আমার বাম হাতটা খুব শক্ত করে ধরা ছিল আব্বুর ডান হাতে। দুই জোড়া চোখেই ভবিষ্যতের স্বপ্ন আঁকা।

বহু বছর পেরিয়ে এসে বাম হাতটি ধরে রাখার সে মানুষটি আজ আর নেই। চোখে উঠেছে রঙিন সানগ্লাস। তবে হৃদয়ে সাদা রঙের পোশাকের উজ্জ্বলতা এখনো অমলিন। বিকেএসপি পাঠ চুকিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পরও আমার ট্রাঙ্কের মধ্যে ন্যাপথলিন দিয়ে যত্ন করে রাখা থাকত সে ধবধবে সাদা শার্ট-প্যান্ট। কয়েক দিন পর পর ষোলো আনা ভক্তি উজাড় করে নিয়ম কয়ে সাদা পোশাকটি দেখতাম। মনে করিয়ে দিত আমার ফুটবল-৩০১ পরিচয়। আমি নিশ্চিত, কলেজ ড্রেসের সাদা পোশাকটি বিকেএসপির সব ছাত্র-ছাত্রীদের কাছেই সাদার মতোই পবিত্র। পোশাকটি যে আমাদের সাবেক ছাত্রদের অস্তিত্ব।

সকালের অনুশীলন শেষে নাশতা সেরে সাদা পোশাকে লম্বা লাইনে কলেজ ভবনের দিকে এগিয়ে যেতাম। পেছন থেকে লাইন দেখে মনে হতো, যেন শান্তির পায়রাগুলো জ্ঞান অর্জনের উদ্দেশে বের হয়েছে। ক্লাসে গিয়ে বসার পর শরীর তখন ক্লান্তির হাওয়ায় দোলত। বীজগণিতের সূত্রগুলোকে মনে হতো বারমুডার ট্রায়াঙ্গেল। জ্যামিতি! যা কোনো দিনও প্রমাণিত হওয়ার নয়। এই ছিলাম আমি-আমরা। অথচ কত কায়দা করে সে জটিল বিষয়গুলো ইসবগুলের ভুসির মতো পানিতে ভিজিয়ে গলা দিয়ে ঢেলে দিতেন গণিতের শিক্ষকেরা। শিখব না, এই যেন ছিল আমাদের পণ। কিন্তু আমাদের শিখিয়ে ছাড়ার ধনুক ভাঙা পণ করেছিলেন শিক্ষকেরা। বাংলা ব্যাকরণ বা দুর্বোধ্য ইংরেজির কথা নাই বা বললাম।

২০১০ সালে বিকেএসপিতে ছাত্রত্বের অধ্যায় শেষ হয়ে গেলেও সেখানে যাতায়াতের অভ্যাস এখনো আছে। সাদা কলেজ ড্রেসে ছোট ভাই-বোনদের দেখলে পেছনে ফিরে হয়ে যাই রাশেদ-ফুটবল ৩০১। সময় সুযোগ হলে ফুটবল মাঠে গিয়ে হই হুল্লোড় করার চেষ্টা করি। হাউসে ছোট ভাইদের ডেকে গল্প করি। মনে হয় নিজের জগতে আছি, ১০০ একরেরও বেশি জায়গার যে জগতের মালিকানা আমার নামে বরাদ্দ। আছে স্যার-ম্যাডামদের দেখলে আড়াল হওয়ার বৃথা চেষ্টাও। আসলে শঙ্কায় থাকি অসম্মানজনক কিছু করে ফেললাম কিনা! মনে হয় চুল এলোমেলো। এ অবস্থায় তাঁদের সামনে গিয়ে দাঁড়ানো তো লজ্জাজনকই বটে। বিকেএসপি নিয়ে লিখতে গেলে ভালোবাসার কথায়ই লিখতে হয়।

তবে বিকেএসপি নিয়ে আমার অভিযোগ ও অনুযোগেরও শেষ নেই। এই লেখাটি ভালোবাসা দিয়ে শুরু করলেও এখন অনুযোগের কথায় বলব। সে অভিযোগ চোখের সামনে আমাদের সাদা পোশাকের ঐতিহ্য নষ্ট হতে দেখার। গাবতলি বাস স্ট্যান্ডে কিছু বালিকার গায়ের যে পোশাক দেখেই বুঝে গিয়েছিলাম এরা তো বিকেএসপির ছাত্রী। বড় ভাই হিসেবে নিজ দায়িত্বে সে ছোট বোনদের গন্তব্যের গাড়িতে তুলে দেওয়ার মধ্যেও পেয়েছিলাম এক অনাবিল আনন্দ। বিকেএসপির ছাত্র ছাত্রীদের গায়ে আর সেই সাদা পোশাকটি নেই। তাই আর আজ আলাদা করে চিনতে পারি না ছোট ভাই-বোনদের। ছড়িয়ে দিতে পারি না সে মায়া-মমতাও।

গত বছর বদলে ফেলা হয়েছে সেই ঐতিহ্যের পোশাক। জামা সাদা রাখা হলেও ছেলেদের ক্ষেত্রে প্যান্ট করা হয়েছে কালো আর মেয়েদের পায়জামা নেভি ব্লু। এ নিয়ে আমরা সাবেক ছাত্রছাত্রীরা ক্ষুব্ধ। শুনেছি আমাদের মনের কথা শোনার মানুষ একজন আছেন। তিনি বিকেএসপির বর্তমান মহা পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম মাজহারুল হক।

বিকেএসপিতে আমরা যাদের ভালো মানুষ হিসেবে চিনি, তাঁরা সবাই বিকেএসপির বর্তমান মহাপরিচালকের প্রশংসা করেন। বর্তমান মহাপরিচালকের সততা ও বিনয়ের প্রশংসা প্রতিষ্ঠানের বর্তমান জ্যেষ্ঠ শিক্ষার্থীদের মুখ থেকেও শোনা যায়। শুনেছি মসজিদে নামাজ শেষে বাচ্চারা (ক্লাস সিক্স-সেভেনের) তাঁর সঙ্গে গিয়ে সরাসরি খাবারের ব্যাপারেও কথা বলে থাকে। এতেই বোঝা যায় মানুষটির উদারতা।
এই লেখার মাধ্যমে পোশাকের ব্যাপারে আমাদের হতাশার সেই কথাটি মহাপরিচালক স্যারের কানে যাওয়ার-ই কথা। স্যারের কাছে বিনীত অনুরোধ, স্যার যেন আমাদের ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনেন। বিকেএসপি বেঁচে থাকুক বিকেএসপির ঐতিহ্যকে সঙ্গী করেই।

  • রাশেদুল ইসলাম (বিকেএসপির ফুটবল বিভাগের সাবেক ছাত্র)
    ক্রীড়া সাংবাদিক, প্রথম আলো