‘একসময় চলনবিল অঞ্চলের অধিকাংশ ঘরই ছিল মাটির তৈরি। ঘরগুলো যেমন সুন্দর ছিল, তেমনই ছিল বসবাসের জন্য আরামদায়ক।’

সন্ধ্যা যখন ঘনিয়ে আসে, পাখি তখন নীড়ে ফেরে। মানুষও তা–ই। সারা দিন যেখানে যে কাজেই থাকুক না কেন, দিন শেষে মানুষকে ফিরতে হয় ঘরে। ঘরেই যে সুখ, ঘরেই যে শান্তি। সভ্যতার ক্রমবিকাশে মানুষ পাহাড়ের গুহা, বনবাদাড় ছেড়ে ঘর নির্মাণ করতে শেখে এবং সেখানেই বসবাস করতে শুরু করে। আর সেসব ঘর ছিল মাটির তৈরি। সেই সময় যেন মাটির ঘরই হয়ে ওঠে সভ্যতার প্রতীক, যার ইতিহাস সুদীর্ঘকালের। এই ইতিহাসের অংশ চলনবিল অঞ্চলের মানুষও।

একসময় চলনবিল অঞ্চলের অধিকাংশ ঘরই ছিল মাটির তৈরি। ঘরগুলো যেমন সুন্দর ছিল, তেমনই ছিল বসবাসের জন্য আরামদায়ক। পরিচিতি পেয়েছিল ‘মাটির এসি’ নামে। কিন্তু কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে চলনবিলের মাটির ঘর। এটি আধুনিকতার নামান্তর হলেও ঐতিহ্যগত যে শিকড় হারিয়ে যাচ্ছে, তা একই সঙ্গে দুঃখ ও পরিতাপের বিষয়। মাটির ঘর টিকিয়ে রাখা সম্ভব কি না, তা নিয়ে ভাবনার সুযোগও আছে।

মানুষ ক্রমান্বয়ে নিজেদের পরিবর্তনের মাধ্যমে সভ্যতার দিকে অগ্রসর হতে থাকে, এটাই যেন মানুষের বৈশিষ্ট্য। সেই অগ্রসরতা এখন মাটির ঘর ছাপিয়ে কংক্রিটের উঁচু দালানকোঠা নির্মাণের নেপথ্যে। কিন্তু সমাজে এখনো এমন শ্রেণির মানুষ আছেন, যাঁদের কিনা বর্তমান সভ্যতাকে স্পর্শ করা সম্ভব নয়। তাঁদের মাটির ঘরই একমাত্র শেষ ভরসার জায়গা। কিন্তু নিজের মাটির ঘরের পাশে যখন প্রতিবেশী দালানকোঠা তোলে, তখন প্রয়োজনবোধেই নিজের মাটির ঘরটা ভেঙে দালনাকোঠা না দিতে পারলেও টিনের ঘর বানাতে হয়। কিংবা সেই ধনী প্রতিবেশীর আক্রোশের শিকার হয়েও ভাঙতে হয় মাটির ঘরকে।

গত বছর সেপ্টেম্বরে চলনবিলের মাটির ঘর দেখতে যখন বের হয়েছিলাম, তখন এমনই একটি প্রসঙ্গ উঠে এসেছিল। আমার কথা হয়েছিল সিংড়া উপজেলার নিংগইন ভিটেপাড়ার বাসিন্দা দুলাল মৈত্রের (৬২) সঙ্গে। তাঁর দাদা চারুচরণ মৈত্র এক শ বছর আগে তৈরি করেছিল মাটির ঘর, যেটায় এখনো তিনি স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বসবাস করছেন।

তবে তিনি শিগগিরই মাটির ঘরটি ভেঙে ফেলবেন বলে জানান। কারণ হিসেবে বলতে গিয়ে তিনি দুঃখ করে বলেন, মানুষের দৃষ্টিতে মাটির ঘর এখন যুগের সঙ্গে যায় না। আগে মাটির বাড়ি ছিল বড়লোকদের, এখন যাঁদের আছে বড়লোক হলেও তাঁদের গরিব বলায় তাঁরা ভেঙে ফেলছেন। অনেকে দারিদ্র্যের কারণে ভেঙে ফেলতে পারছেন না।

তিনি এ রকমও বলেন, ‘সুযোগ থাকলে মাটির ঘর না ভেঙে সবাই মাটির ঘর রাখত, আমিও রাখতাম। পাশের বাড়িতে যখন দালান ওঠে, তখন আমাদের দিকে তাঁদের নজর পড়ে এ জন্য যে মাটির ঘরের কারণে তাঁদের দালানকোঠার সৌন্দর্য নষ্ট হচ্ছে।’

ষাটোর্ধ্ব দুলাল মৈত্রের কথা থেকে যে বিষয়টি সুস্পষ্ট, তা হচ্ছে প্রাচীন সভ্যতার সঙ্গে বর্তমান প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের চরম দ্বন্দ্ব। যেখানে পাড়া-মহল্লায় অধিকাংশ বাড়িঘর ইট-সিমেন্টের হচ্ছে, সেখানে গুটিকয়েক বাড়িঘর মাটির থাকবে, তা যেন মেনে নিতে পারছেন না অন্যরা। তাই নিরুপায় হয়েই ঐতিহ্যকে ধ্বংস করে আধুনিকতায় পা রাখতে হচ্ছে চলনবিল অঞ্চলের মানুষকে। তবে এটি করতে কারও-কারও যে কী পরিমাণ কষ্টের মুখোমুখি হতে হচ্ছে, তা চলনবিলের মাটির মানুষ দুলাল মৈত্রের কণ্ঠস্বরের দিকে নজর দিলে উপলব্ধির সুযোগ মেলে।

চলনবিল অঞ্চলে বর্ষার প্রকোপ একটু বেশিই চোখে পড়ে। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিলে তেমন পানি বাড়ে না। তবে একসময় বিলের পানি মানুষের ভিটেমাটিতে উঠত। যার কারণেও এ অঞ্চলে অনেক মাটির ঘর বিলুপ্ত হয়েছে বলেও আমি সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছি।

‘বর্ষা মৌসুমে মাটির ঘরগুলো ঝুঁকিপূর্ণ মনে হলেও গরমের সময় এসব ঘর শীতল থাকে।’

বর্ষার পানি যখন মাটির ঘরে প্রবেশ করে, তখন সে মাটির ঘর নরম হয়ে ওঠে। বন্যার পানি দীর্ঘস্থায়ী হলে সে মাটির ঘর ভেঙে পড়ে। তখন বিপদের মুখোমুখি হতে হয় মাটির ঘরওয়ালাদের। যাঁরা ধনিক শ্রেণির, তাঁরা বর্ষার পরে মাটির ঘর ভেঙে টিনের বা ইটের ঘর বানাতে পারেন; কিন্তু যাঁরা সে সামর্থ্য রাখেন না, তাঁদের পড়তে হয় চরম বিপাকে। দুই সন্তানের মা মোছা. সালমা বেগম (৩১) এমনই একজন ভুক্তভোগী।

প্রতিবছর বন্যায় ঘরের মেঝেতে পানি আসায় মাটির ঘর ভেঙে পড়ার অবস্থা হয়ে যায় তাঁর। কিন্তু তিনি চান, মাটির ঘরটি ঐতিহ্য হিসেবে টিকে থাকুক। বর্ষা মৌসুমে বন্যা প্রতিরোধ করে কীভাবে তাঁর ঘর রক্ষা করা যায়, সে বিষয়ে তিনি উপজেলা পরিষদসহ নানামহলের পরামর্শ ও সহযোগিতা প্রত্যাশা করেন।

চলনবিলের সিংড়া উপজেলার নিংগইন ভিটেপাড়ায় খোঁজখবর নিয়ে আমি যতদ্দুর জানতে পারি, এ পাড়ায় শ খানেক মাটির ঘর ছিল, যা বন্যার কারণে ভেঙে পড়েছে। বর্ষায় ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় কিছু ব্যক্তি উদ্যোগে ভেঙে দালান তৈরি করা হয়েছে। বন্যা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হলে হয়তো এ এলাকায় মাটির ঘরগুলো ভাঙা হতো না। মহল্লার পাশ দিয়ে চলনবিল বিধৌত গুড়নাই নদ বহমান হওয়ায় হয়তো বন্যা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়ে না ওঠায় বন্যার কবলে পড়ে বছর বছর হারিয়ে যাচ্ছে মাটির ঘরগুলো।

শৈশবে আমার দাদার বাড়িতেও মাটির ঘর দেখেছি। সেসব ঘরের কোনো কোনোটা আবার দোতলা ছিল। সভ্যতার কুঠারাঘাত, অতি বন্যাসহ নানা কারণেই সেসব ঘর আর নেই। তবে চলনবিল অঞ্চল–অধ্যুষিত নওগাঁর ভান্ডার গ্রাম, নবগ্রাম; সিংড়া উপজেলার সাতপুকুরিয়া, ত্রিরেল, ইটালি, তাজপুর, পাকুরিয়া, মাগুরা, থালৈ, চৌগ্রাম, হুলহুলিয়া, স্থাপনদিঘি, মুষ্টিগড়, কলমসহ, নাটোরের অন্যান্য কিছু গ্রাম এবং সিরাজগঞ্জ, পাবনা জেলার বেশ কিছু গ্রাম-মহল্লায় মাটির ঘর এখনো আছে। তবে এসব হাতে গোনা। বিশেষ করে কিছু হিন্দু ও সাঁওতাল জাতিগোষ্ঠীর মানুষজন এই মাটির ঘরকে টিকিয়ে রেখেছে।

সিংড়া উপজেলার চৌগ্রামে অবস্থিত মাটির তৈরি ‘রাজা রমাকান্ত রায় বাহাদুর প্রোপার্টি’ এখনো অক্ষত আছে, যা দেখতে দর্শনার্থীরা আসেন। কালেভদ্রে বিষয়টা এখন এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে মাটির ঘর এই প্রজন্মের কাছে এখন বিস্ময়ের এক জিনিস।

মাটির ঘর কীভাবে তৈরি করা হয়, তা জানতে চেয়েছিলাম পঞ্চাশোর্ধ্ব গৃহিণী বাবলি মৈত্রের কাছে। তিনি বলেন, একটি মাটির ঘর বানাতে ১০-১২ জন মানুষের দু-তিন মাস সময় লাগে। পুকুর-নদী থেকে দোআঁশ ও এঁটেল মাটি সংগ্রহ করে এক সপ্তাহ মন্থন করতে হয়। এর সঙ্গে মেশানো হয় কুচি কুচি করে কাটা খড়, যাতে মাটিকে ধরে রাখতে পারে।

এরপর কোদাল দিয়ে সে মাটি কেটে আড়াই হাত ভিত রেখে তৈরি করতে হয় ঘরের দেয়াল। একেকটি ঘরে রাখা হয় দু-তিনটি জানালা। দেয়ালের গাঁথুনি শেষ হলে ওপরে টিনের চালা দেওয়া হয়। যদিও আগে খড়ের চালাই বেশি ব্যবহার করত মানুষ। প্রতিবছর পূজার সময় এলে এসব মাটির ঘর কাদামাটি দিয়ে লেপে বলেও জানান বাবলি মৈত্র। তিনি মাটির ঘরেই তার জীবন পাড় করবেন বলেও আশাবাদী। মাটির ঘর তৈরিতে খরচ কম হওয়ায় সব শ্রেণির মানুষের কাছে এটি ছিল গ্রহণযোগ্য।

বর্ষা মৌসুমে মাটির ঘরগুলো ঝুঁকিপূর্ণ মনে হলেও গরমের সময় এসব ঘর শীতল থাকে। যার কারণে বিদ্যুৎবিহীন যুগে এসব ঘর ছিল বেশ জনপ্রিয়। এখন ঘরে-ঘরে বিদ্যুৎ হওয়ায় প্রাকৃতিক শীতলতার প্রয়োজনবোধ যেমন ফুরিয়ে এসেছে, তেমনই মানুষও চায় না মাটির ঘরে ফ্যান চলুক, বাতি জ্বলুক। তাই সবাই মাটির ঘর ভেঙে দালানকোঠার দিকে মনোযোগ দিতে শুরু করেছে আরও দুই দশক আগে থেকে। যার কারণে চলনবিল অঞ্চলসহ দেশের অনেক অঞ্চল থেকে বিলুপ্তপ্রায় মাটির ঘর।

তবে মাটির ঘরের প্রয়োজনীয়তাবোধ, সংরক্ষণের উপায় নির্ধারণ, বন্যা থেকে টিকিয়ে রাখতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ ও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে মাটির ঘরগুলো টিকিয়ে রাখা যেমন সম্ভব, তেমনই মানুষকে মাটির ঘর তৈরির বিষয়ে এখনো উদ্বুদ্ধ করা সম্ভব। তবে যে বিষয়টি সবচেয়ে জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে, তা হচ্ছে কারও দালানকোঠার পাশে মাটির ঘর শোভা পাওয়ায় তাদের মানসম্মান নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় অন্যকে মাটির ঘর ভাঙতে হবে বা বানাতে দেবেন না—এই মানসিকতারও পরিবর্তন দরকার। তাহলে যাঁদের মাটির ঘর আছে, তাঁরা হীনম্মন্যতায় না ভুগে মাটির ঘরে বসবাসের বিষয়ে উৎসাহী হবেন। সেই সঙ্গে দেশের সব অঞ্চলেই বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পেতে পারে মাটির ঘর।

আমাদের প্রত্যাশা, বাড়ির আঙিনায় দালানকোঠাও উঠুক, সেই সঙ্গে শত শত বছরের পুরোনো মাটির ঘরটিও অক্ষত থাকুক। এ যেন বাংলা প্রাচীন ঐতিহ্যের সঙ্গে আধুনিক যুগের এক মেলবন্ধন। এ জন্য আমাদের হতে হবে ঐতিহ্যপ্রেমী ও সচেতন। আশা করি, চলনবিল অঞ্চলসহ সারা দেশের মাটির ঘরগুলো রক্ষা ও পুনর্নির্মাণের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেবে।

  • মোহাম্মদ অংকন প্রকৌশলী ও সরকারি চাকরিজীবী
    ই-মেইল: [email protected]