জন্মনিবন্ধনের এই হয়রানি দিয়ে স্মার্ট বাংলাদেশ কীভাবে সম্ভব

একটি শিশুর জন্ম নেওয়াটা স্বাভাবিক হলেও জন্মনিবন্ধন করাটা বর্তমানে অস্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। জন্মনিবন্ধনজনিত জটিলতায় যাঁরা পড়েননি, তাঁদের এ কথার মর্মার্থ বুঝতে অনেকটা কষ্ট হবে। একে তো ইউনিয়ন পরিষদ কর্মকর্তাদের কাজের প্রতি অবহেলা, তার ওপর বর্তমানে নতুন সমস্যা এসে দাঁড়িয়েছে সার্ভার সমস্যা।

এক বা দেড় মাস আগে কাগজপত্র জমা দেওয়া, প্রতিদিন বাড়ি থেকে ইউনিয়ন পরিষদ, ইউনিয়ন পরিষদ থেকে বাড়ি দৌড়াদৌড়ি কতজন মানুষই–বা স্বাভাবিকভাবে নিতে পারেন। বাংলাদেশ গেজেট অনুযায়ী একটি শিশুর জন্মনিবন্ধন করতে ৫০ টাকা সরকারি ফি জমা দিতে হয়। কিন্তু তা শুধু গেজেট পর্যন্তই সীমাবদ্ধ। এর বাস্তবায়ন আদৌ কোথাও হয়েছে বলে মনে হয় না। গ্রামের একটা ইউনিয়ন পরিষদে জন্মনিবন্ধন করতে অভিভাবকে গুনতে হয় প্রায় হাজার টাকা সঙ্গে হয়রানি বিনা মূল্যে। তা ছাড়া থাকছে বারবার বিভিন্ন সংশোধন আপডেট দেওয়ার ঝামেলা। প্রথমত, হাতে লেখা জন্মনিবন্ধন, তারপর এল অনলাইন কপি, আবার বাংলা ও ইংরেজি দুইটা একসঙ্গে থাকার বাধ্যবাধকতা। এর প্রতিটি ধাপে সাধারণ মানুষকে হতে হয় হয়রানির শিকার।

জন্মনিবন্ধন–সম্পর্কিত বিভিন্ন কাজের পদ্ধতি আপনি যখন অনলাইনে দেখবেন অনেকটা সহজ সাধ্য কাজ মনে হবে বটে, কিন্তু যখন কাজ শুরু করবেন, তখন বুঝবেন কত ধানে কত চাল। সহজ পদ্ধতিটা কখন জটিল বনে গেল আপনার মাথায় আসবে না। দুই ঘণ্টার কাজের জন্য আপনাকে দুই মাস দৌড়াদৌড়ির ওপর থাকতে হবে।

এবার জন্মনিবন্ধন সংশোধন–সম্পর্কিত কিছু কথা বলা যাক। ২০০৪ সালে জন্মনিবন্ধন আইন পাসের পর ২০০৬ সালে তা কার্যকর হলেও গ্রামাঞ্চলের সাধারণ মানুষকে এর আওতায় আনতে আরও কিছু বছর গত হয়। গ্রামের মানুষ বেশির ভাগই নিরক্ষর। তাঁরা সঠিকভাবে তথ্য সরবরাহ করতেও ব্যর্থ হয়েছিলেন। যার প্রমাণস্বরূপ আপনারা যেকোনো একদিন ইউনিয়ন পরিষদ অফিসে গেলেই বুঝতে পারবেন কতজন লোক জন্মনিবন্ধন সংশোধন করতে লাইন দিয়ে অপেক্ষা করছে।  এই সংশোধনেও রয়েছে নানা রকম ভোগান্তি, যা আপনার মানসিক অবস্থাকে পচা পুকুরে চুবানোর সঙ্গে তুলনা করলে ভুল হবে না। কারও সমস্যা নামের বানানে, কারও সমস্যা জন্মতারিখে।

পূজার ছুটিতে যখন বাড়িতে গেলাম তখন আমার জন্মনিবন্ধনে একটা নামের বানান সংশোধন করার জন্য ইউনিয়ন পরিষদে গিয়েছিলাম। অর্জন করে ফেললাম এক তিক্ত অভিজ্ঞতা। অফিস টাইম সকাল ৯টা হলেও অফিসের কর্মকর্তারা অফিসে এলেন ১০টার পর। আসার পর বললাম, ‘আমার জন্মনিবন্ধন সংশোধনের একটা আবেদন করতে হবে।’ তাঁরা বললেন, ‘বাইরে কম্পিউটার অপারেটরের দোকান থেকে করে আনুন। আমরা এখন ব্যস্ত, আমাদের হাতে একদমই সময় নেই।’ আমি মনে মনে ভাবলাম, তাঁরা কী কাজে ব্যস্ত? তাঁদের কাজই তো সাধারণ জনগণকে সেবা দেওয়া।

সেটা বাদ দিয়ে তাঁরা নানা অজুহাত দেখিয়ে সাধারণ জনগণকে ফেলছেন হয়রানিতে। কাগজপত্র সব জমা দিয়ে এলাম। পরদিন বাসা থেকে ফোন দিয়ে বললাম কাজ কি হয়েছে? তাঁরা বললেন, ‘আপনি কবে কাগজপত্র জমা দিয়েছেন?’ উত্তরে আমি বললাম, ‘গতকাল।’ উনি বললেন, ‘তাহলে হয়নি।’ এটা কোন ধরনের নিয়ম বুঝলাম না। আবার দেখলাম কোনো এক প্রবাসগামী ব্যক্তির কাগজপত্র সংশোধনের কাজে এসেছেন। কান উঁচু করে শুনলাম বিকেলে চারটার দিকে তাঁর ট্রেন। ঢাকায় যাবেন এই কাগজ দিয়ে অন্যান্য কাজ সারতে। কিন্তু তাঁরা সে কাজ করে দিতে ব্যর্থ। এই হয়রানির শেষ কোথায়?

বেশির ভাগ সংশোধনীর কারণ হলো জন্মনিবন্ধন ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কাগজপত্রের সঙ্গে বৈসাদৃশ্য। জন্মনিবন্ধন সংশোধনীতে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের অফিস নতুন এক দৌড়াদৌড়ির এক তিক্ত সুযোগের উত্থান হয়। সংশোধন ফি ৫০ টাকা হলেও সব মিলিয়ে আপনার আনুমানিক ৫০০ টাকা খরচা হয়। তারপরও আপনি সেই সংশোধিত ডকুমেন্ট কবে নাগাদ হাতে পাবেন, তার কোনো ঠিকঠিকানা নেই। লোকের কথা পায়ে না পিষে যথারীতি বলাই যায় ‘জন্মগ্রহণের চেয়ে জন্মনিবন্ধন ও জন্মনিবন্ধন সংশোধন করা কঠিন’।

উল্লিখিত প্রতিটি ঘটনার অভিজ্ঞতা আমার সঞ্চয় করা আছে। আমরা এখন স্বাধীনতা অর্জনের ৫০ বছর পার হয়ে এসেছি। ডিজিটাল যুগ পেরিয়ে আমরা এখন স্মার্ট বাংলাদেশের স্মার্ট নাগরিক। তবে এদিকটাতে কেন ব্যর্থতার গ্লানি। সাধারণ মানুষের জীবনযাপনকে আরও সহজ–সুন্দর সাবলীল করতে কর্তৃপক্ষের উচিত এদিকে নজর দেওয়া। স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনে স্মার্ট উপাদানের যথাযোগ্য প্রয়োগ ঘটিয়ে দেশকে আরও উন্নত ও সমাজের গতিধারাকে সহজ ও সচল রাখা। দেশ ও জাতিকে ভালো কিছু উপহার দিতে কর্তৃপক্ষের উচিত সমাজের সবাইকে সঙ্গে নিয়ে প্রকৃত স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনের প্রত্যয় নিয়ে সামনে অগ্রসর হওয়া।

মেহেদী হাসান মিরাজ
আইন বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
মেইল: mehedyhasanmiraz5@gmail