পঞ্চাশের দশকের পয়লা বৈশাখের সেই ছেলেবেলা ভুলি কী করে

‘এবারের বৈশাখের প্রথম দিনে এদিক-সেদিক ঘুরেও কোনো দিকে মেলাটেলা চোখে পড়ল না।’
ছবি: প্রথম আলো

বাংলা ১৪৩০ সালের শুরুর দিনের দৃশ্য দেখে বলতে হয়, যেভাবে বাঙালির জীবন থেকে পয়লা বৈশাখ তার জৌলুস হারাচ্ছে, তাতে বাংলা পঞ্জিকার অস্তিত্ব আদৌ থাকবে কি না, সন্দেহ। ১৪৩০ বঙ্গাব্দের পয়লা বৈশাখে দোকানে দোকানে হালখাতা দেখা গেল না বললেই চলে। আর পাড়ামহল্লায় পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে মিছিল বা শোভাযাত্রা তো দূরের কথা, এবারের বৈশাখের প্রথম দিনে এদিক-সেদিক ঘুরেও কোনো দিকে মেলাটেলা চোখে পড়ল না। হায়রে পয়লা বৈশাখ!

ক্যালেন্ডার বা পঞ্জিকা মানুষের সৃষ্টি করা। মুঘল আমলে প্রশাসনিক প্রয়োজনেই বাংলা পঞ্জিকার সৃষ্টি হয়েছিল কৃষকদের কাছ থেকে কর আদায়ের জন্য। হালখাতা পয়লা বৈশাখের একটি বৈশিষ্ট্য ছিল একসময়, কিন্তু সেটি এখন আর তেমন নজরে আসে না। পয়লা বৈশাখ উদ্‌যাপনের সমারোহকে কী করে আরও বর্ণময় করা যায়, তা তো ভেবে দেখতে পারে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।

দুঃখ হলেও সত্য যে একটা সময় পয়লা বৈশাখে ভোর থেকে পাড়ায় পাড়ায় বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা বের করার চল ছিল, বহুদিন আগেই তা গত হয়েছে। অথচ শোভাযাত্রা ও হালখাতার মতো বাংলা নববর্ষের দুটি পরিচিত উদ্‌যাপন প্রায় উঠে যাওয়ায় বাঙালি পয়লা বৈশাখকে ভুলতে বসেছে।

আসলে বাঙালি বাংলাদেশি হয়ে নিজ সংস্কৃতি ভুলে পরসংস্কৃতিতে মজেছে। বাংলা নববর্ষের দিন শোভাযাত্রা হয় বটে, গান–নৃত্য–আবৃত্তিতে বাংলা সংস্কৃতিকে তুলে ধরা হয় বটে, কিন্তু তা সংখ্যায় খুব বেশি নয়।

মনে আছে পিরোজপুরের সেই স্মৃতিগুলো, নববর্ষের দিন দোকানদারদের হালখাতার দিন ছিল। হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা তাঁদের মতো করে নানা পূজা–পার্বণের মাধ্যমে পহেলা বৈশাখকে বরণ করে নিতেন। সেসব দৃশ্য এখনো চোখে ভাসে। আজ মাঝেমধ্যে মনে হয়, কোথায় হারিয়ে গেল বাংলা নববর্ষের সেই ঐতিহ্যের দিনগুলো। আজ পয়লা বৈশাখ বছর ঘুরে আসে, কিন্তু টের পাই না। আর দোকানে দোকানে সেদিনের মতো হালখাতা উদ্‌যাপন যেন আজ কল্পনা ছাড়া কিছুই নয়। কীই–না সোনালি দিন পেছনে ফেলে এলাম।

পয়লা বৈশাখ এলে ছোটবেলায় সেই ১৯৫৮ সালে বাবার হাত ধরে সন্ধ্যাবেলা দোকানে দোকানে হালখাতা করার স্মৃতি মনে পড়ে যায়। এক দোকান থেকে আরেক দোকান—সব দোকান থেকেই দেওয়া হতো বাংলা ক্যালেন্ডার ও একটি বড় সাইজের মিষ্টির প্যাকেট। ব্যাগ ভর্তি হয়ে যেত ক্যালেন্ডার আর মিষ্টির প্যাকেটে। ভারি আনন্দ হতো। কোনো কোনো দোকানদার আবার শরবত খাওয়াতেন।

আরও মনে পড়ে, এদিন গ্রামের রাস্তায়, গাছের ছায়ায় বা বাঁশের মাচানের ওপর ছাউনি করে, মাটির জালা বা কুজো ভরে রাখা হতো পানি, সঙ্গে রসগোল্লা-বাতাসাও। জ্যাঠা মশাই সেই জল–বাতাসা, রসগোল্লা নিয়ে বসে থাকতেন। তৃষ্ণার্ত যাঁরা আসতেন, মগে করে পানি তুলে গ্লাসে ভরে ধরিয়ে দিতেন বাতাসা বা রসগোল্লা। দু-চার মিনিট সেখানে বিশ্রাম নিয়ে পথিক হাঁটা দিতেন আবার, চোখেমুখে একটা তৃপ্তির ছাপ থাকত। সেদিন এ জীবনে আর কখনো ফিরে আসবে না!

জীবনের শেষ প্রান্তে এসে একটি প্রশ্ন জাগে, বাংলাদেশের দোকানদারদের পয়লা বৈশাখে হালখাতা ও ক্রেতাদের মিষ্টিমুখ করানো চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে গেল? এর পেছনে কি ব্যবসায়িক মন্দা কাজ করছে, নাকি সাংস্কৃতিক কোনো পরিবর্তন?

লিয়াকত হোসেন খোকন

রূপনগর, ঢাকা, বাংলাদেশ