কোথায় গেল বাংলাদেশের সুখ

মানবজীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের একটি হলো সুখ। ঢেউখেলানো দুঃখের সাগরে বসবাস করা মানুষের জীবনে একচিলতে সুখ এনে দিতে পারে জীবন ধাঁচের কল্পনাতীত পরিবর্তন। অপর দিকে লাগাতার দুঃখ, কষ্ট, বেদনা ইত্যাদি নষ্ট করে মানুষের বেঁচে থাকার স্বপ্ন। প্রকৃত অর্থে সুখের সঙ্গে দুঃখের সম্পর্ক থাকলেও স্বর্গ থেকে আসে সুখ—এমন ধারণা রয়েছে আমাদের মধ্যে। পৃথিবীর সবাই যেমন দুঃখ ভোগ করে না, ঠিক তেমনি সবাই চিরসুখীও নয়।

সুখ-দুঃখের কথা উঠতেই আসতে হয় কারা সুখী আর কারা দুঃখী—সেই আলোচনায়। এসব প্রশ্নের উত্তর বের করা এখন সময়ের চাহিদা। অবশ্য জাতিসংঘ ২০১২ সালের পর থেকে বিশ্বের সুখী দেশের তালিকা প্রকাশ করে আসছে। তারই ধারাবাহিকতায় এবারও চলতি বছরের ২০ মার্চ বিশ্বের সুখী দেশের তালিকা প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ। সেই তালিকায় প্রায় ১১ ধাপ পিছিয়েছে বাংলাদেশ। জাতিসংঘ প্রকাশিত ২০২৪ সালের প্রতিবেদনে আমরা রয়েছি ১২৯তম অবস্থানে।

গত বছর আমাদের অবস্থান ছিল ১১৮তম স্থানে। ২০২৩ সালের আগের বছর, অর্থাৎ ২০২২ সালে আমরা ছিলাম সুখের তালিকার ৯৪তম অবস্থানে। দুঃখের বিষয় হলো, ২০২২ সালের পর আমাদের কপালের সুখ কমেছে প্রায় ৩৬ পয়েন্ট। কোথায় গেল বাংলাদেশের সুখ? এবার আসা যাক সেই আলোচনায়।

দেশের বাজারে এখনো লাগামহীন অবস্থায় রয়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম। ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট যেন কেড়ে নিয়েছে বাংলাদেশের সুখ। কোন পক্ষ ফিরিয়ে আনবে আমাদের সুখের ধারা? সেই প্রশ্নের উত্তর মেলা আজ বড় দায়। অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি দেশের আপামর জনসাধারণ। অবস্থা এমন, দেখে মনে হচ্ছে সরকারও রয়েছে এই অসাধু সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মিদশায়।

মানুষের পেট যত খালি রাখা সম্ভব—এমন প্রতিযোগিতায় নেমেছে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট ও সংশ্লিষ্ট পক্ষ। আবার দেখা যায়, কোনো ব্যবসায়ী কম দামে পণ্য বিক্রি করলে তিনি পড়েন সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট চক্রের রোষানলে। এ ক্ষেত্রে রাজধানী ঢাকার মাংস বিক্রেতা খলিল আমাদের জন্য জলজ্যান্ত উদাহরণ। মোদ্দাকথা হলো, সিন্ডিকেট আজ আমাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে পড়েছে। অবস্থা দাঁড়িয়েছে—‘সর্বাঙ্গে ব্যথা, মলম দেব কোথা’র মতো।

যদিও বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস), পিপিআরসি ও সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) গবেষণা ও জরিপে দেখা গেছে, করোনাকালীন দেশে দরিদ্রের সংখ্যা বেড়েছে অনেকটা উল্লেখযোগ্যসংখ্যায়। তাদের মতে, দারিদ্র্যের এই হার করোনা-পূর্ব সময়ের ২১ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৪১ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। অবশ্য সরকারের তরফ থেকে বলা হচ্ছে, এ হার অনেক কম। তবে সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) কাছে এর সমর্থনে নেই কোনো তথ্য।

২০২০ সালের অক্টোবরের বিবিএসের এক জরিপে দেখা যায়, বাংলাদেশের মানুষের আয় ২০ শতাংশ কমে গেছে। পরে ২০২১, ২০২২ ও ২০২৩ সালে এসে এই কম আয়ের ঘাড়ে চেপে বসে লাগামহীন বাজারব্যবস্থা, যা চলতি ২০২৪ সালেও রয়েছে ঘাড় কামড়ে ধরার অবস্থায়। নিত্যপণ্যের দাম বাড়লেও এমন অবস্থায় সরকারসহ রাষ্ট্রীয় সংশ্লিষ্ট পক্ষ কি নাকে তেল দিয়ে ঘুমিয়ে আছে? এমন চিন্তাও দিচ্ছে প্রশ্নের জন্ম। পণ্যের বাজার দিনকে দিন লাগামহীন হয়ে উঠলেও প্রসারিত হয়নি মানুষের আয়ের উৎস।

নিত্যপণ্য ছাড়াও অসুখী হওয়ার কারণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়, দেশে সর্বত্র মাদক ছড়িয়ে পড়েছে। হত্যা, লুটপাট, ধর্ষণ, কিশোর অপরাধ ইত্যাদি অপরাধ বেড়েছে, যাতে সামাজিক অস্থিরতা তৈরি হচ্ছে। আর দুর্নীতি, অনিয়ম ও রাজনৈতিক অস্থিরতা তো আছেই। প্রতিটা জায়গায় নৈরাজ্যে ভরে গেছে। মানুষের স্বস্তির নিশ্বাস ফেলার জায়গা নেই কোথাও।

২০২৩ সালের পর প্রায় ১১ ধাপ পিছিয়ে ২০২৪ সালে ১২৯তম স্থানে এসে আমরা যে কত সুখী অবস্থানে রয়েছি, তা নরম ভাষায় প্রকাশ করতে চাইলেও দেশ, দেশের জনগণ তথা আমাদের স্বার্থে তা আর পারছি না।

খাদ্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে মানুষের মুখের ভাষা কেড়ে নেওয়া বর্ণচোরা ও সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোকে ধিক্কার দেওয়া ছাড়া আমাদের আর কিছুই করার নেই। দেশের মানুষের মৌলিক অধিকার খাদ্যে ভোগান্তি কমিয়ে আনার পাশাপাশি অন্য সব বিষয় মাথায় রেখে সুখী–সমৃদ্ধ বাংলাদেশের জন্য কাজে লেগে পড়ার এখনই সময়।

এখনই সময় ঘুরে দাঁড়ানোর। নয়তো বেঁচে যাওয়া সুখ–টুকু থেকেও বঞ্চিত হবে দেশের শান্তিপ্রিয় মানুষ। দেশের সব ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতি রোধে আগের মতো জিরো-টলারেন্স নীতি অনুসরণের পাশাপাশি বাড়াতে হবে সব খাতে নজরদারি।

বাংলাদেশের বৃহত্তর সুখের প্রশ্নে কাউকে যেন আর ছাড় না দেওয়া হয়, সেটি নিশ্চিত করতে সরকারসহ রাষ্ট্রীয় সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে এগিয়ে আসতে হবে। কপালের সুখ এভাবে যাতে বিলীন না হয়ে যায়, সে বিষয়ে দিতে হবে প্রয়োজনীয় দৃষ্টি।

জিহাদ হোসেন রাহাত
শিক্ষার্থী, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, লক্ষ্মীপুর।