বিদেশে পিএইচডি ডিগ্রি নিতে যাওয়া কি অপরাধ

দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বিদেশে নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি ডিগ্রি নিতে যাওয়া কি অপরাধ, এই প্রশ্ন উঠেছে একটি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পদোন্নতিকে কেন্দ্র করে।

বাছাই বোর্ডের সুপারিশ এবং সিন্ডিকেটের ৯৯তম সভার অনুমোদনক্রমে সহযোগী অধ্যাপক পদের যোগ্যতা পূরণকারী সহকারী অধ্যাপক পদমর্যাদার শিক্ষকদের ‘সহযোগী অধ্যাপক’ পদে সম্প্রতি পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে।

বর্তমানে চাকরিরত ও দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি অধ্যয়নরত অথচ ডেপুটেশনে (শিক্ষাছুটিতে) থাকা শিক্ষকেরা সবাই প্রমোশন বা পদোন্নতি পেয়েছেন, কিন্তু যেসব যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক বিদেশের বিভিন্ন নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি গবেষণায় শিক্ষাছুটিতে আছেন, তাঁদের পদোন্নতির জন্য বিবেচনা করা হয়নি (অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনে সেটি দিতে কোনো সমস্যা নেই)। উচ্চশিক্ষার জন্য এটি অশনিসংকেত বলে মনে করা হয়।

কিন্তু দেশে অবস্থান করাটাই বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে একজন শিক্ষকের পদোন্নতির জন্য পূর্বশর্ত  হওয়াটা দুর্ভাগ্যজনক। এর মাধ্যমে তারা যে বার্তাটি দিলেন, তা নবীন শিক্ষকদের জন্য নেতিবাচক। বিদেশি উচ্চশিক্ষা ও গবেষণাকে এর মাধ্যমে মূলত নিরুৎসাহিত করা হলো। যেখানে দেশে থাকা শিক্ষকেরা পিএইচডি না করে কিংবা পিএইচডি গবেষণাকাজের জন্য ছুটিতে থাকার পরও পদোন্নতি পাচ্ছেন, সেখানে বিশ্বের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পিএইচডি গবেষণার জন্য বিদেশে অবস্থানরত শিক্ষকেরা এ অধিকার থেকে বঞ্চিত হতে পারেন না।

বিশ্বায়নের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য আমাদের দরকার দক্ষ মানবসম্পদ। কিন্তু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে খুব বেশি যোগ্য গ্র্যাজুয়েট তৈরি করতে পারছে না। ফলে আমাদের দেশের বেসরকারি করপোরেট খাতে কাজ করছেন প্রচুর বিদেশি কর্মী। এ বাস্তবতাই  বলে দিচ্ছে যে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে বের হওয়া শিক্ষার্থীদের ওপর করপোরেটে আস্থা কম। দক্ষ গ্র্যাজুয়েট তৈরির অন্যতম উপায় হলো বিশ্বের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করা যোগ্যতাসম্পন্ন লোককে নিয়োগ দেওয়া। দ্বিতীয় উপায় হলো, বিদ্যমান শিক্ষকদের বিদেশের মানসম্পন্ন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পিএইচডি ডিগ্রি নিতে উৎসাহিত করা।

বাংলাদেশ থেকে বিদেশের ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডির জন্য মনোনীত শিক্ষকদের অনেক পরিশ্রম করে যোগ্যতা অর্জন করতে হয়। তাঁদের আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়, যাঁরা পরবর্তী সময়ে দেশের শিক্ষার্থীদের বিদেশি উচ্চশিক্ষা সহায়তার জন্য ভূমিকা রাখতে পারবেন, শিক্ষার্থীদের যোগ্য হিসেবে গড়ে তুলতে পারবেন। পাশাপাশি বিশ্ব র‌্যাঙ্কিংয়ের প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করা অত্যন্ত শ্রমসাধ্য বিষয়। তাঁদের শ্রম, নিষ্ঠা ও নিজেদের উন্নতি করার প্রচেষ্টাকে যথাযথ মূল্যায়ন করুন। তাই শিক্ষকদের বিদেশি মানসম্মত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি নিতে নিরুৎসাহিত তো করা উচিতই নয়, বরং তাঁদের নানাভাবে বাড়তি প্রণোদনা দিয়ে উৎসাহিত করা উচিত।

এটা খুবই দুঃখজনক যে আমাদের দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষকদের প্রমোশনের জন্য যে মানদণ্ড রয়েছে, তাতে এসব ডিগ্রির (মাস্টার্স বা পিএইচডি) কোনো মূল্যায়ন নেই। এ অবস্থা চলতে থাকলে কোনো শিক্ষকই কষ্ট করে বিদেশ থেকে পিএইচডি ডিগ্রি নিতে উৎসাহিত হবেন না। কারণ, এখানে শুধু নির্দিষ্ট কয়েক বছর শিক্ষকতা ও মানহীন কিছু পাবলিকেশন করলেই প্রমোশন পাওয়া যায়। বিদেশের পিএইচডি ডিগ্রির জন্য আলাদা কোনো প্রণোদনা তো নেই-ই, বরং আরও বঞ্চনার শিকার হতে হয়।

আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষা ও গবেষণাকাজে যথেষ্ট অর্থ বরাদ্দ পায় না। তাই দেশের উচ্চশিক্ষাব্যবস্থা অনেকটাই ক্লাসরুমভিত্তিক। দেশের একজন শিক্ষক বিদেশি যে বিভাগে পিএইচডি করেন, অনেক সময় দেখা যায়, সেই বিভাগের বাজেট আমাদের দেশের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট (সব বিভাগের) বাজেটের সমান।

এমতাবস্থায় সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন হঠকারী সিদ্ধান্ত যদি শিক্ষকদের বিদেশি পিএইচডি করতে নিরুৎসাহিত করে, তাহলে সমগ্র শিক্ষামানের ওপর এর ব্যাপক প্রভাব পড়বে। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে যেহেতু একটি গবেষণাধর্মী বিশ্ববিদ্যালয়, সে ক্ষেত্রে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য বিদেশের ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি গবেষণার অভিজ্ঞতা জরুরি।

  • রাজীব কামাল সহকারী অধ্যাপক, ম্যানেজমেন্টে অ্যান্ড ফাইন্যান্স বিভাগ, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
    ই–মেইল: [email protected]