দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীকে গাছে ঝুলিয়ে নির্যাতনের দৃষ্টান্তমূলক বিচার চাই

সিলেটের কোম্পানীগঞ্জে চোর সন্দেহে গাছে ঝুলিয়ে নির্যাতন করা হয় দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী এক যুবককে।ছবি: ভিডিও থেকে সংগৃহীত

সম্মানিত পাঠক, একবার চোখ বন্ধ করে ভাবুন তো একজন ২৭ বছর বয়সী দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী যুবককে দুই হাত বেঁধে গাছে ঝুলিয়ে কিছু মানুষ নির্যাতন করছে। আমি বিশ্বাস করি, একজন সুস্থ মানুষ হিসেবে এ ঘটনা দৃশ্যায়ন করা যেকোনো পাঠকের কাছে কঠিন; কিন্তু এমন একটি ঘটনার সাক্ষী হয়েছে সিলেট জেলার কোম্পানীগঞ্জ এলাকার মানুষ।

৫ ডিসেম্বর সিলেট জেলার কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার দক্ষিণ বুড়দেও গ্রামের জালাল মিয়া নামের এক দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে টাকা চুরির অভিযোগ এনে অমানবিক নির্যাতন করা হয়। নির্যাতনের ঘটনাটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ইতিমধ্যে ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়েছে। ব্যবহারকারীরা নির্যাতকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন। ইতোমধ্যে একজন অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

এ বছর ৩ ডিসেম্বর সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশও ৩৪তম আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস ও ২৭তম জাতীয় প্রতিবন্ধী দিবস নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে উদ্‌যাপন করেছে।

এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘প্রতিবন্ধিতা অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গড়ি, সামাজিক অগ্রগতি ত্বরান্বিত করি।’ দিবসের দুই দিন পর এমন নৃশংস ঘটনাটি ঘটে; যা একজন সচেতন পাঠক হিসেবে আমাকে যেমন শিহরিত করে, তেমনি প্রশ্ন জাগে প্রতিবন্ধীবান্ধব সমাজ কি আদৌ সৃজন সম্ভব!

সমাজসেবা অধিদপ্তরের প্রতিবন্ধিতা শনাক্তকরণ জরিপের তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রায় ১২ ধরনের ৩৬ লাখ প্রতিবন্ধী ব্যক্তি রয়েছেন। প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ক্রমবর্ধমান এই সংখ্যা দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে যে ব্যাপক অবদান রাখতে পারে, সেটি সহজে অনুমেয়। শারীরিক প্রতিবন্ধী জিতু রায় দেশের একজন সফল উদ্যোক্তা। ফ্রিল্যান্সিংয়ের পাশাপাশি উদ্যোক্তা হয়ে শিশুদের কাপড় তৈরি করে অনলাইনে বিক্রি করেন। তাঁর কারখানায় প্রায় ৭০ জন কাজ করেন।

জিতুর প্রতিবন্ধিত্ব জয়ের গল্পটি প্রথম আলোর মাধ্যমেই আমরা জানতে পারি। তাঁর নাম উল্লাস পাল। হাত ও পা বাঁকা। ডান হাতে কোনো শক্তি না থাকায় লিখতে ও পা বাঁকা হওয়ায় চলতে সমস্যা হয়। শারীরিক প্রতিবন্ধী হিসেবে নেননি কোনো কোটা–সুবিধা। ৪৪তম বিসিএস পরীক্ষায় সফলতার সঙ্গে পেলেন প্রশাসন ক্যাডার—এমন সব গল্প পাঠককে যেমন আন্দোলিত করে, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী জালাল মিয়ার গল্প তেমনই আমাদের ব্যথিত করে।

বাংলাদেশের সংবিধানে সব নাগরিকের সম–অধিকার, মানবসত্তার মর্যাদা, মৌলিক মানবাধিকার ও সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে। বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর অধিকারসংক্রান্ত জাতিসংঘ সনদ কনভেনশন অন দ্য রাইটস অব পারসনস উইথ ডিজঅ্যাবিলিটিস (ইউএনসিআরপিডি)–এ ২০০৭ সালের ৯ মে স্বাক্ষর এবং ৩০ নভেম্বর অনুসমর্থন করে।

প্রতিবন্ধিতাবিষয়ক আন্তর্জাতিক দলিল ইউএনসিআরপিডির আলোকে ২০০১ সালে প্রণীত প্রতিবন্ধী কল্যাণ আইন যুগোপযোগী করে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন ২০১৩ এবং প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা বিধিমালা-২০১৫ প্রণয়ন করা হয়েছে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সাংবিধানিক অঙ্গীকার বাস্তবায়ন এবং আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতি পূরণে বাংলাদেশ বহুলাংশে এগিয়ে যাচ্ছে। তবে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রতি রাষ্ট্র মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করলেও সমাজ এখনো প্রতিবন্ধীদের প্রতি উদার হতে পারেনি। তাই জালাল মিয়ারা এখনো নির্যাতনের শিকার হয়।

সমাজের প্রতিটি অংশের মতো প্রতিবন্ধীদের মানবিক অধিকার, ন্যায্যতা ও সাম্যতা সুনিশ্চিত করার দায়িত্ব যেমন রাষ্ট্রের, তেমনি কল্যাণমূলক সমাজ সৃজনে প্রতিবন্ধীদের পাশে থেকে তাঁদের এগিয়ে নেওয়ার দায়িত্বও আমাদের।

এ ক্ষেত্রে সমাজের দায়িত্বশীল অংশের আরও বেশি প্রতিনিধিত্বমূলক অবদান রাখা সর্বাগ্রে প্রয়োজন। পরিবার থেকে শুরু করে সামাজিক, ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রতিবন্ধীসহ পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর অনুকূলে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি লালন করার চর্চা করতে হবে। মনে রাখা প্রয়োজন—প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সফল অন্তর্ভুক্তিই ত্বরান্বিত করতে পারে আর্থসামাজিক অগ্রগতি।

  • এস ডি টিটু সমাজ–উন্নয়নকর্মী