ডিগ্রি (পাস) কোর্স কেন একটি অর্থহীন কোর্সে পরিণত হলো

প্রতীকী ছবি

গ্র্যাজুয়েট সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় দেশের সর্ববৃহৎ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। একটি সত্য ধারণা হচ্ছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি (অনার্স) কোর্স চার বছর হওয়ায় ডিগ্রি (পাস) কোর্সে (তিন বছরের) শিক্ষার্থীর সংখ্যা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে। খুব অল্পসংখ্যক কলেজে ডিগ্রি (পাস) কোর্সে শিক্ষার্থীর সংখ্যা (সর্বসাকল্যে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় বর্ষ) ১০০ থেকে ১৫০ হলেও অধিকাংশ কলেজে এ সংখ্যা ২০ থেকে ৩০–এর মধ্যে। মফস্‌সল এলাকার কলেজগুলোতে এ সংকট চোখে পড়ার মতো।

ডিগ্রি (পাস) কোর্সে তিনটি বিভাগ—বিএসএস, বিবিএস ও বিএসসি থাকলেও অধিকাংশ ডিগ্রি কলেজে বিএসসি কোর্স নেই। আবার যেসব কলেজে বিএসসি (পাস) কোর্স রয়েছে, সেখানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা একেবারে নাজুক অবস্থা—৫ থেকে ১০ জন। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অনেক কলেজে ডিগ্রি (পাস) কোর্সের পাঠদানের অনুমতি প্রদান করলেও কাম্য শিক্ষার্থীর (প্রতি বিভাগে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ন্যূনতম ১০০) অভাবে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ (মাউশি), শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক আর্থিক অনুদানভুক্ত, অর্থাৎ এমপিওভুক্ত হচ্ছে না। ফলে ডিগ্রি (পাস) কোর্স একটি অর্থহীন কোর্সে পরিণত হয়েছে এবং অধিকাংশ কলেজে নামমাত্র খুলে রাখা হয়েছে।

আগে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার মতো ডিগ্রি (পাস) পরীক্ষায়ও পুরো দেশে উৎসবমুখর থাকত। অথচ এই ডিগ্রি (পাস) পরীক্ষা আজ জনবিচ্ছিন্ন ও অবহেলিত হয়ে পড়েছে। এমপিওভুক্ত ডিগ্রি কলেজগুলোতে প্রতি বিষয়ে দুজন শিক্ষক এমপিওভুক্ত হওয়ার বিধান রয়েছে [একজন উচ্চমাধ্যমিক শাখার এবং অপর জন ডিগ্রি (পাস) কোর্সের জন্য]।

এখন উচ্চমাধ্যমিক শাখার শিক্ষক অবসরপ্রাপ্ত হলে ডিগ্রি শাখার শিক্ষক বিধানমতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে উচ্চমাধ্যমিক শাখার সংশ্লিষ্ট বিষয়ের জন্য নির্দিষ্ট হয়ে যান। কিন্তু ডিগ্রি (পাস) কোর্সে কাম্যসংখ্যক শিক্ষার্থী (বিষয়ভিত্তিক ডিগ্রি তিন বছর মিলে মফস্‌সলে ৬০ জন এবং জেলা সদরে ও সিটি করপোরেশনে ৭৫ জন) না থাকলে এমপিওভুক্ত শূন্যপদে শিক্ষকের জন্য এনটিআরসিএতে (বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও সার্টিফিকেট কর্তৃপক্ষ) চাহিদা প্রেরণ করা যায় না। ফলে এই এমপিওভুক্ত শূন্যপদটি আর পূরণ হয় না। মফস্‌সল এলাকার প্রায় সব ডিগ্রি কলেজে এ সংকট খুবই লক্ষণীয়।

এদিকে বিআইডিএসের গবেষণায় দেখা গেছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজগুলো থেকে পাস করার তিন বছর পরও ২৮ দশমিক ৮৪ শতাংশ শিক্ষার্থী বেকার থাকছেন। বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পড়াশোনা শেষ করে মাত্র ১ শতাংশ কলেজ গ্র্যাজুয়েট স্বকর্মসংস্থানে যুক্ত হচ্ছেন। গ্র্যাজুয়েশন শেষ করার পর তিন বছর ধরে চাকরির সন্ধান করতে হচ্ছে ৪৬ শতাংশ কলেজ গ্র্যাজুয়েটকে। তাঁদের মধ্যে বেকারত্বের হারও সবচেয়ে বেশি (৭১ শতাংশ)।

এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য আমি মনে করি, ডিগ্রি (পাস) কোর্স দুই বছর চালু করে শিক্ষার্থীদের আইসিটি দক্ষতা ও আন্তর্জাতিক ভাষা দক্ষতা লাভের জন্য ছয় মাসব্যাপী দুটি কোর্স বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন। বর্তমানে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সব কলেজেই আইসিটি ল্যাব স্থাপিত হয়েছে। ফলে সহজে শিক্ষার্থীরা আইসিটি দক্ষতা অর্জন করতে পারবে।

এখন কলেজগুলোতে ল্যাঙ্গুয়েজ ল্যাব বা ল্যাঙ্গুয়েজ ক্লাব প্রতিষ্ঠা/স্থাপন করা প্রয়োজন, যেখানে শিক্ষার্থীরা ইংরেজি, জাপানিজ, চায়নিজ, কোরিয়ান, জার্মানি, ফ্রেঞ্চ ইত্যাদি ভাষায় দক্ষতা অর্জন করতে পারবেন। ইতিমধ্যে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে সিইডিপি প্রকল্পের মাধ্যমে অনেক কলেজ ল্যাঙ্গুয়েজ ল্যাব স্থাপন করেছে। যেসব কলেজের সক্ষমতা নেই, সেগুলোর কয়েকটি মিলে ইংলিশ এক্সপার্ট দিয়ে একটি ল্যাঙ্গুয়েজ ক্লাব প্রতিষ্ঠা করা সহজ। অথবা বিকল্প হিসেবে জেলা বা উপজেলা সদরে রেজিস্ট্রি করা অনুমোদিত অনেক প্রতিষ্ঠান আছে, যেখানে বিভিন্ন ভাষায় দক্ষতা অর্জনের কোর্স করানো হয়। এসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আন্তর্জাতিক ভাষা দক্ষতা অর্জন করা সম্ভব। প্রয়োজন শুধু সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা ও তা বাস্তবায়নের জন্য আন্তরিকতা।

এমতাবস্থায় ডিগ্রি (পাস) কোর্স তিন বছরের পরিবর্তে দুই বছর চালু করে শিক্ষার্থীদের আইসিটি দক্ষতা ও আন্তর্জাতিক ভাষা দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে তাঁদের দক্ষ মানবসম্পদে রূপান্তরিত করা সম্ভব। ফলে ডিগ্রি (পাস) কোর্স অর্জনকারীরা অল্প সময়ে দেশি ও আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে কর্মসংস্থান অর্জন করতে সক্ষম হবেন এবং দেশ শিক্ষিত বেকারের ভার থেকে মুক্তি পাবে, বৈদেশিক রেমিট্যান্স বৃদ্ধিসহ দেশীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটবে।

এতে ডিগ্রি (পাস) কোর্স অর্থবহ হয়ে উঠবে, শিক্ষার্থীর সংখ্যাও ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাবে এবং এনটিআরসিএর মাধ্যমে অনেক শিক্ষকও নিয়োগপ্রাপ্ত হবেন। যেসব শিক্ষার্থী মাস্টার্স কোর্সে ভর্তি হতে ইচ্ছুক, তাঁদের জন্য দুই বছরের প্রিলিমিনারি এবং এক বছরের মাস্টার্স শেষ পর্ব কোর্স চালু করা যেতে পারে।

এ ছাড়া ডিগ্রি (পাস) কোর্সে কম গুরুত্বপূর্ণ আবশ্যিক বিষয়গুলোর পরিবর্তে আইসিটি ও ইংরেজি আবশ্যিক বিষয় হিসেবে চালু রাখার/করার পাশাপাশি আইসিটি দক্ষতা ও আন্তর্জাতিক ভাষা দক্ষতা দুটি কোর্স বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে। নতুন নিয়মে বাস্তবসম্মত ইনকোর্স পরীক্ষা চালু শিক্ষার্থীদের উপস্থিতিতে ব্যাপক সাড়া পড়েছে।

এ ছাড়া অনলাইনভিত্তিক শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি নিশ্চিত করা এবং আর্থিক ব্যবস্থাপনা সচ্ছতার লক্ষ্যে সিএমআইএস (কলেজ ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম) এবং শিক্ষার্থীদের কর্মদক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ইন্ডাস্ট্রিয়াল লিংকেজ প্রতিষ্ঠা ডিগ্রি (পাস) কোর্সকে আরও তাৎপর্যপূর্ণ করে তুলবে। লক্ষণীয়ভাবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সব কোর্সে নোট–গাইড ব্যবহার রহিত করা উচিত বলে আমি মনে করি।

মো. আবু হানিফ ভূঁইয়া

উপাধ্যক্ষ

চান্দিনা রেদোয়ান আহমেদ কলেজ

চান্দিনা, কুমিল্লা