ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের হেয় করার সুযোগ নেই

ছবি: সংগৃহীত

১৯ এপ্রিল প্রথম আলো অনলাইনে ‘প্রকৌশলীদের আর কত নামাবে সরকার’ শিরোনামে একটি মতামত প্রকাশিত হয়েছে। লেখাটি লিখেছেন সুবাইল বিন আলম।

মতামতটিতে সরকারের নীতিনির্ধারণী গণমুখী কিছু সিদ্ধান্ত ও উন্নয়ন-উৎপাদনে নিয়োজিত সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রকৌশলী এবং গণপ্রকৌশলীখ্যাত ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের চরমভাবে হেয়প্রতিপন্ন করা হয়েছে। আমাদের মনে হয়েছে, লেখক ঢালাওভাবে নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে সমালোচনা করেছেন।

 জনাব সুবাইল শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের ১৫ এপ্রিল তারিখের প্রজ্ঞাপনের ভুল ব্যাখ্যা করেছেন। লেখক বুঝতেই পারেননি যে শিক্ষা মন্ত্রণালয় কী উদ্দেশ্যে কমিটি গঠন করেছেন। লেখক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বিএসসি (পাস) ও বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিংকে একাকার করে ফেলেছেন বলে আমাদের মনে হয়েছে।

 বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং ও ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্স কারিকুলাম ও সিলেবাস অধ্যয়নের জন্য জনাব সুবাইলকে অনুরোধ জানাচ্ছি। বিএসসি প্রকৌশলী ও ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের মধ্যে একাডেমিক পার্থক্য উচ্চমাধ্যমিকের মাত্র দুই বছরের। অর্থাৎ উচ্চমাধ্যমিক পাসের পর শিক্ষার্থীরা চার বছরের বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে এবং মাধ্যমিক পাসের পর শিক্ষার্থীরা চার বছরের ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্সে ভর্তি হয়ে থাকেন।

কর্মক্ষেত্রে বিএসসি প্রকৌশলীরা ডিজাইন, প্ল্যানিং, গবেষণা এবং ডিপ্লোমা প্রকৌশলীরা এক্সিকিউশন, সুপারভিশন ও মেইনটেন্যান্সে কাজ করেন। অর্থাৎ বিএসসি প্রকৌশলীরা ডেস্কে এবং ডিপ্লোমা প্রকৌশলীরা মাঠপর্যায়ে কাজ করেন। লেখক এখানে মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট ও এমবিবিএস চিকিৎসকদের সঙ্গে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ার ও ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের গুলিয়ে ফেলেছেন।

মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্টরা এমবিবিএস কোর্সের বিষয়ের ওপর লেখাপড়া করেন না, তা ঠিক। কিন্তু বিএসসি প্রকৌশলী ও ডিপ্লোমা প্রকৌশলী উভয়েই প্রকৌশলী, এটা রাষ্ট্র কর্তৃক ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। শিক্ষাব্যবস্থার কোর্স কারিকুলামও তা–ই। আর সে কারণে ডিপ্লোমা প্রকৌশলীরা বিভিন্ন সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও সরকার নিয়ন্ত্রিত কোম্পানিতে উপসহকারী প্রকৌশলী পদে যোগদান করে অভিজ্ঞতা ও যোগ্যতাবলে চিফ ইঞ্জিনিয়ার এমনকি এমডি ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চেয়ারম্যানের পদ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করে থাকেন। তাঁরা সেসব দায়িত্ব অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে পালন করেছেন, এমন অনেক উদাহরণ আছে।

লেখক ‘পৃথিবীর কোনো দেশে এভাবে ডিগ্রি প্রদানের কোনো উদাহরণ নেই’ বলে উল্লেখ করেছেন। অথচ পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশেও শিক্ষানবিশ, রিকগনিশন, প্রিওর লার্নিংসহ বিভিন্ন বিষয় বিবেচনায় নিয়ে ডিগ্রি প্রদান করা হয় এবং শিক্ষার স্তরভুক্ত করা হয়।

এ ছাড়া বিশ্বের প্রায় সব দেশে লাইফ লং লার্নিংয়ের বিধান রাখা আছে। যেখানে যেকোনো স্তরের, যেকোনো যোগ্যপ্রার্থী, শিক্ষার্থী বা প্রশিক্ষণার্থী অনানুষ্ঠানিক বা অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বা অভিজ্ঞতার মাধ্যমে উচ্চতর শিক্ষা বা যোগ্যতা অর্জন করতে পারে।

বিএসসি (পাস) কোর্সের গণিত, পদার্থ ও রসায়ন ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্সে বিদ্যমান এবং অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। এ ছাড়া বিএসসি (পাস) কোর্সের মোট কন্ট্রাক্ট আওয়ার ও মোট ক্রেডিটের তুলনায় ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্সের মোট ক্রেডিট ও মোট কন্ট্রাক্ট আওয়ার বেশি। তাই সব দিক বিবেচনায় বিশেষ করে একাডেমিক বিষয় বিবেচনায় ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের বিএসসি (পাস) কোর্সের সমমান প্রদান করায় কোনো বাধা নেই।

 বাংলাদেশে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্সটি এসএসসি পাস শিক্ষার্থীদের জন্য ৪ বছর অর্থাৎ ৮ সেমিস্টার, এইচএসসি (বিজ্ঞান) শিক্ষার্থীদের জন্য ৩ বছর ৬ মাস বা ৬ সেমিস্টার এবং এইচএসসি ভকেশনাল শিক্ষার্থীদের জন্য ২ বছর ৬ মাস বা ৫ সেমিস্টার। এই প্রোগ্রামে ন্যূনতম স্কুলিং ১৪ বছর। এইচএসসি ভকেশনাল শিক্ষার্থীদের ১৪ বছর ৬ মাস এবং এইচএসসি (বিজ্ঞান) শিক্ষার্থীদের জন্য ১৫ বছর।

আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন দেশে ডিগ্রি প্রোগ্রামের ইয়ার অব স্কুলিং সর্বনিম্ন ১৪ বছর (ফার্স্ট ট্র্যাক ডিগ্রি)। পৃথিবীর অনেক দেশেই ডিগ্রি অর্জনের জন্য ১৪ বছর স্কুলিং বিদ্যমান।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় অত্যন্ত ন্যায়সংগতভাবেই ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের বিএসসি (পাস) সমমানের কথা বলেছেন এবং এটি কীভাবে বাস্তবায়ন করা যায়, সে উদ্দেশ্যে একটি কমিটি গঠন করেছেন।

প্রবন্ধ লেখক বিভিন্ন মনীষীর উদ্ধৃতি দিয়ে প্রকৌশলীদের কৃতকার্যের কথা বলতে গিয়ে ভুলে গেছেন যে পৃথিবীর সব দেশেই প্রকৌশলী দুই প্রকার, ডিগ্রি প্রকৌশলী ও ডিপ্লোমা প্রকৌশলী। তাই প্রকৌশল কর্মকাণ্ডের মধ্যে উভয় প্রকার প্রকৌশলীই জড়িত। তিনি ডিগ্রি প্রকৌশলীদের বিভিন্ন গবেষণার কৃতিত্বের কথা বলেছেন। এটাই তো তাদের কাজ। গবেষণা করবেন, দেশ সেই গবেষণার কারণে এগিয়ে যাবে, এটাই তো করা প্রয়োজন।

ডিপ্লোমা প্রকৌশলীরা তো ডিগ্রি প্রকৌশলীদের ডিজাইন, প্ল্যানিং নিয়েই মাঠপর্যায়ে কাজ করবেন বা বাস্তবায়ন করবেন। অতএব এখানে ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের ছোট করে দেখার কোনো অবকাশ নেই।

প্রবন্ধ লেখক ইন্টারভিউ বোর্ডের কথা উল্লেখ করে ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তার জানা থাকা দরকার, ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের পিএসসিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা দিয়ে নিয়োগ পেয়ে যোগ্যতা ও দক্ষতার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে।

লেখকের আরও জানা প্রয়োজন, গণপূর্ত অধিদপ্তর, সড়ক পরিবহন, রেলওয়ে, রাজউক, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর, বিএডিসি, এলজিইডি, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর, কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর, বিটিসিএল, মেট্রোরেল, পিডিবি, পিজিসিবি, ডিপিডিসিসহ বিভিন্ন বিদ্যুৎ  কোম্পানি, বিসিআইসিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়াররা তাঁদের যোগ্যতা দিয়ে দেশপ্রেমের অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।

লেখক উচ্চশিক্ষার কথা বলেছেন। তিনি কি জানেন পৃথিবীর প্রায় সব উন্নত দেশে ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের মাত্র দুই বছরে ডিগ্রি ইঞ্জিনিয়ারিং করার সুযোগ আছে।

বাংলাদেশের ডিপ্লোমা প্রকৌশলীরা অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন পলিটেকনিক, যেখানে ডিপ্লোমা থেকে পিএইচডি পর্যন্ত লেখাপড়া করানো হয়, সেই ইনস্টিটিউটে দুই বছরে ডিগ্রি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার যোগ্যতা অর্জন করেছে।

তা ছাড়া জার্মানি, চীনসহ অনেক দেশেই দুই বছরে ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের ডিগ্রি ইঞ্জিনিয়ারিং করার সুযোগ আছে এবং বাংলাদেশের ব্যাপকসংখ্যক ডিপ্লোমা প্রকৌশলী সেসব দেশে ডিগ্রি, মাস্টার্স ও পিএইচডি পর্যন্ত অর্জন করছেন।

আর তাই অত্যন্ত সংগত করণেই বাংলাদেশ সরকার শিক্ষানীতি ২০১০-এ ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের জন্য সব প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রয়োজনীয় ক্রেডিট ওয়েভার দিয়ে ডিগ্রি ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্সে অধ্যয়ন করার সুযোগ সৃষ্টির সুপারিশ করেছেন।

বাংলাদেশ সরকারের ২০৪১ সালের রূপকল্প বা উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ তথা স্মার্ট বাংলাদেশ নির্মাণের লক্ষ্যে দেশে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক  শিক্ষার ব্যাপক সম্প্রসারণ ও মান উন্নয়নের লক্ষ্যে ২০৩০ সালের মধ্যে মোট শিক্ষার্থীর ৩০ শতাংশ এবং ২০৪০ সালের মধ্যে ৫০ শতাংশে উন্নীত করে শিক্ষার মূল স্রোতোধারায় কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষাকে নিয়ে আসার জন্য কাজ করছেন।

একই লক্ষ্য অর্জনে এ শিক্ষায় শিক্ষার্থীদের জাতীয় স্বার্থে আকৃষ্ট করা ও ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য তাদেরকে বিএসসি (পাস) সমমান ঘোষণা করার উদ্যোগ সরকার গ্রহণ করেছে। মন্ত্রণালয় তো ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের ডিগ্রি প্রকৌশলীদের সমমান করতে চাইছে না বা তা বলেনি, তাহলে লেখক কেন এমন একটি অযাচিত লেখা লিখলেন, সেটি আমাদের বুঝে আসেনি।

আমরা ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের হেয় করার এমন অপচেষ্টার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি।

  •  মো. শামসুর রহমান সাধারণ সম্পাদক, কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি, ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স, বাংলাদেশ (আইডিইবি)