নতুন শিক্ষাক্রমের সমালোচনা ও সম্ভাবনা

শিক্ষা ছাড়া একটি সমাজের পরিবর্তন ভাবা যায় না। আমাদের সবারই কমবেশি জানা রয়েছে, এই শিক্ষা আমরা অর্জন করি তিনটি ধারায়। এর মধ্যে সবচেয়ে কম সময়কালীন, কিন্তু বেশি গুরুত্ব দিয়ে পরিচালিত ধারাটির নাম প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। আর যত বিপত্তি মূলত এই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাধারা নিয়েই।

বাংলাদেশে এখন সবচেয়ে বেশি আলোচনা–সমালোচনা হচ্ছে গত বছর থেকে সরকার দেশের পুরো শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে নতুন শিক্ষাক্রম প্রণয়ন এবং এর বাস্তবায়ন শুরু করেছে—এ বিষয় নিয়ে।

নতুন শিক্ষাক্রমের শ্রেণি কার্যক্রম পরিচালনার কলাকৌশল ও মূল্যায়ন নিয়ে আলোচনা–সমালোচনা চলছে সবখানেই। নতুন শিক্ষাক্রমের পাঠ পরিচালনার কলাকৌশল ও শিখন মূল্যায়ন বিষয়ে যে এত সমালোচনা হচ্ছে, এর সবটা সম্পর্কে কি আমাদের ধারণা পরিষ্কার?

আলোচনা বা সমালোচনা সবক্ষেত্রেই খারাপ, বিষয়টি এমন নয়; বরং এর মাধ্যমে সঠিক পথের সন্ধানও মেলে কখনো কখনো। নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন নিয়ে সমাজে যে সমালোচনার ঝড় বয়ে যাচ্ছে, সেসব বিষয়ে দু–চার কথা বলা অপ্রাসঙ্গিক হবে না নিশ্চয়ই।  

দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে যুগোপযোগী ও আধুনিক করে গড়ে তুলতে সরকার ‘জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা ২০২১: প্রাক্–প্রাথমিক থেকে দ্বাদশ শ্রেণি’ প্রণয়ন করেছে। এই রূপরেখার আলোকে পর্যায়ক্রমে শিক্ষাক্রম, পাঠ্যপুস্তক, শিক্ষক নির্দেশিকা, মূল্যায়ন নির্দেশিকাসহ প্রয়োজনীয় উপকরণ প্রস্তুত করেছে। ২০২৩ সাল থেকে  প্রাক্-প্রাথমিক ও প্রথম শ্রেণি এবং ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে পাঠ কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। ২০২৪ সালে দ্বিতীয়, তৃতীয়, অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে শ্রেণি কার্যক্রম বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।

নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন বিষয়ে চলমান আলোচনা–সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা যদি রূপকল্প–২০২১–এর ভিশনের দিকে তাকাই, তাহলে নতুন শিক্ষাক্রম বিষয়ে কিছুটা ধারণা পরিষ্কার হবে আশা করছি।

ভিশনে বলা হয়েছে, ‘এমন একটি প্রজন্ম তৈরি করা, যারা জাতীয় ইতিহাস, ঐতিহ্য, মূল্যবোধ ও সংস্কৃতি ধারণ করে পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিজেকে সৃজনশীল, উৎপাদনমুখী, সুখী ও বৈশ্বিক নাগরিক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পারবে।’

আর এই ভিশন পূরণের জন্য নির্দিষ্ট কিছু অভিলক্ষ্য নির্ধারণ করে এগিয়েছে নতুন শিক্ষাক্রম প্রণয়নের কাজ। এবার একটু চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক সেই অভিলক্ষ্য বা মিশনের দিকে, ‘প্রত্যেক শিক্ষার্থীর অন্তর্নিহিত সম্ভাবনা বিকাশে নমনীয় ও কার্যকর শিক্ষাক্রম প্রস্তুত; সংবেদনশীল, দায়িত্বশীল, জবাবদিহিমূলক ও অংশগ্রহণমূলক শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়ন; শিক্ষার সব পর্যায়ে দক্ষ, পেশাদার ও সংবেদনশীল, দায়িত্বশীল ও স্বতঃপ্রণোদিত জনশক্তি নিশ্চিত; শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে শিক্ষার্থীর অন্তর্নিহিত সম্ভাবনার বিকাশ ও উৎকর্ষের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত এবং প্রাতিষ্ঠানিক পরিবেশের বাইরে ও বহুমাত্রিক শিখনের সুযোগ ও স্বীকৃতি প্রদান করা।’

মূলত এসব লক্ষ্য পূরণ করার লক্ষ্যে শিখনের বিষয়বস্তুতে যেমন পরিবর্তন আনা হয়েছে, তেমনি শ্রেণি কার্যক্রমে জোর দেওয়া হয়েছে অভিজ্ঞতানির্ভর শিখন-শেখানো পদ্ধতির প্রতি। অভিজ্ঞতানির্ভর শিখন-শেখানো কৌশলের প্রতি বেশি জোর দেওয়ার অন্যতম কারণ হলো, শিক্ষার্থীদের হাতে–কলমে শিখতে উদ্বুদ্ধ করার পাশাপাশি দক্ষতা বিকাশ নিশ্চিত করা।

এখন একটু শিক্ষা নিয়ে আলোচনা করা যাক। শিক্ষা হলো অভিজ্ঞতার ফলে আচরণের পরিবর্তন। প্রতিটি আচরণের পরিবর্তন একেকটি শিক্ষা এবং এগুলো দক্ষতাও বটে। যেমন কেউ বই পড়তে পারেন। এই বই পড়তে পারাটা কি তাঁর একটি দক্ষতা নয়? যিনি লিখতে পারেন, এই লিখতে পারাটাও তাঁর একটি দক্ষতা।

আবার কেউ একজন ভালো রান্না করতে পারেন, সেটি নিশ্চয়ই তাঁর একটি দক্ষতা। তাহলে যা দক্ষতা, তা–ই আসলে শিক্ষা। একজন মানুষ সারা জীবন বহু অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যান, কিন্তু সব অভিজ্ঞতার ফলে তাঁর আচরণের পরিবর্তন ঘটে না। ক্ষেত্রবিশেষে আচরণের পরিবর্তন ঘটলেও তা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে স্থায়ী হয় না।

ফলে সব অভিজ্ঞার ফলে ব্যক্তির আচরণের পরিবর্তন স্থায়ীভাবে ঘটে না। আর যেখানে আচরণের পরিবর্তন ঘটে না, সেখানে শিক্ষা কিংবা দক্ষতা কোনোটাই অর্জিত হয় না।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, দক্ষতা কীভাবে অর্জিত হয়?

এ–প্রসঙ্গে চীনা দার্শনিক ও রাজনৈতিক সংস্কারক কনফুসিয়াস বহু শত বছর আগে একটি কথা বলেছেন, সেটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ শিখন–শেখানো কলাকৌশল প্রসঙ্গে। তিনি যা বলেছেন তার বাংলা তরজমা করলে এমন দাঁড়ায়, ‘আমি শুনলাম এবং ভুলে গেলাম, আমি দেখলাম এবং একটু একটু মনে করতে পারি; কিন্তু আমি যখন নিজে করলাম তখন বুঝতে পারলাম।’

একবার যখন কেউ কোনো কিছু বুঝতে পারেন, তখন তাঁর পক্ষে সেটা প্রকাশ করা সহজ। আর যখন সেটা প্রকাশিত হয়, সেটাই তো দক্ষতা। আর এসব কারণে নতুন শিক্ষাক্রমে অভিজ্ঞতানির্ভর শিক্ষাপদ্ধতির প্রতি বেশি জোর দেওয়া হয়েছে। জোর দেওয়া হয়েছে শিক্ষার্থীদের হাতে–কলমে বিদ্যালয়গুলোতে কাজ করার মাধ্যমে অভিজ্ঞতা অর্জনের পরিবেশ তৈরির প্রতি। ফলে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীরা যে নানা ধরনের পরীক্ষা–নিরীক্ষা করছে, প্রজেক্ট করছে, অ্যাসাইনমেন্ট করছে—এর মূলে রয়েছে নিজ নিজ ক্ষেত্রে দক্ষতা অর্জন। দক্ষতা ছাড়া একবিংশ শতাব্দীতে টিকে থাকা সম্ভব নয়। ফলে যেসব অভিভাবক চিন্তিত তাঁদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে, তাঁদের উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে।

অন্য আরও একটি বড় বিষয় নিয়ে আলোচনা–সমালোচনা হচ্ছে, সেটি হচ্ছে মূল্যায়নের কৌশল। অনেকেই বলছেন, এখন পরীক্ষা নেই, ফলে শিশুরা আর পড়তে চাইছে না। এবার বুঝি উচ্ছন্নে গেল আমাদের সন্তানেরা। পরীক্ষা বা মূল্যায়ন নেই, কথাটি সঠিক নয়। মূল্যায়ন বা পরীক্ষা যেটাই বলেন না কেন এটি আছে এবং বেশ ভালোভাবেই আছে। তবে এর কৌশলে পরিবর্তন এসেছে।

আগের শিক্ষাক্রমটি ছিল অভিজ্ঞা বা ধারণাভিত্তিক। ফলে শিক্ষার্থীর জ্ঞান বা ধারণা পরিমাপ করার জন্য লিখিত পরীক্ষাই ছিল একমাত্র মূল্যায়নের কৌশল। কিন্তু নতুন শিক্ষাক্রমটিতে দক্ষতার ওপর বেশি জোর দেওয়া হয়েছে। তাই একে বলা হচ্ছে দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষাক্রম। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, একজন একটি বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করেছে, সেটি পরিমাপ করার জন্য শুধু লিখিত পরীক্ষার মাধ্যমে কি তার এই অর্জিত দক্ষতা পরিমাপ করা সম্ভব?

দক্ষতার ধরন অনুযায়ী মূল্যায়নের কৌশল ও উপকরণ ঠিক করতে হবে। ভিন্ন ভিন্ন দক্ষতার জন্য ভিন্ন ভিন্ন কৌশল ও উপকরণ দরকার হবে। যেমন ভাষার একটি দক্ষতা হলো বলার দক্ষতা। এটি কি লিখিত পরীক্ষার মাধ্যমে পরিমাপ করা সম্ভব? সম্ভব নয়। বলার দক্ষতা পরিমাপ করার জন্য তাকে বলতে দিয়ে পরিমাপ করতে হবে। আবার পড়ার দক্ষতার ক্ষেত্রে লিখিত প্রশ্ন বা পরীক্ষার মাধ্যমে এটি পরিমাপ করা যাবে না।

অন্যদিকে লেখার দক্ষতা পরিমাপ করার জন্য অবশ্যই লিখিত পরীক্ষার বিকল্প নেই। এসব কারণে নতুন শিক্ষাক্রমে মূল্যায়নে বড় পরিবর্তন আনা হয়েছে। কিছু দক্ষতা মূল্যায়ন করা হবে ধারাবাহিক মূল্যায়নব্যবস্থা তথা শ্রেণি কার্যক্রম পরিচালনার সঙ্গে সঙ্গে। প্রতিদিন শিক্ষার্থী যে যে দক্ষতা অর্জন করছে, সেগুলো ধারাবাহিকভাবে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জন্য পৃথক তথ্য সংরক্ষণ ফরমে সংরক্ষণ করে বছর বা সেশন শেষে সেগুলো একত্র করে প্রকাশ করার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।

এই ব্যবস্থাকে বলা হচ্ছে ধারাবাহিক মূল্যায়ন। আর যেসব দক্ষতার জন্য লিখিত পরীক্ষার প্রয়োজন হবে, সেগুলো পরীক্ষাপদ্ধতির মাধ্যমে করা হবে। এটিকে বলা হচ্ছে চূড়ান্ত মূল্যায়ন। ধারাবাহিক ও পরীক্ষার মাধ্যমে মূল্যায়ন শেষে শিক্ষার্থীর পারদর্শিতার মাত্রা আকারে প্রকাশ করা হবে।

নতুন শিক্ষাক্রমের উদ্দেশ্য, শ্রেণি কার্যক্রম পরিচালনার কলাকৌশল ও মূল্যায়নব্যবস্থা পর্যালোচনা করে এটা পরিষ্কার যে ইতিপূর্বে যেসব শিক্ষাক্রম দেশে বাস্তবায়িত হয়েছে, তার তুলনায় নতুন শিক্ষাক্রমটি অনেকটা বিজ্ঞানভিত্তিক, সময়–উপযোগী এবং ভালো—এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।  

  • মো. সাইফুজ্জামান শিক্ষাবিষয়ক উন্নয়নকর্মী

ই-মেইল: [email protected]